আজ || রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
শিরোনাম :
  অবশেষে গোপালপুরে বিরল রোগে আক্রান্ত পরিবার সুচিকিৎসা পাচ্ছেন       গোপালপুর-ভূঞাপুর যমুনা চরাঞ্চল এখন মাদক আর দুস্কৃতকারিদের অভয়ারণ্য       গোপালপুরে কৃষক জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করতে কৃষক সমাবেশ       খোরশেদুজ্জামান মন্টুকে এলাকাবাসি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসাবে দেখতে চান       গোপালপুর উপজেলা পরিষদ স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা       গোপালপুরে কুরতুবী মাদ্রাসার উদ্ধোধন       সালাম পিন্টুর মুক্তির আনন্দে গোপালপুরে মোটরসাইকেল র‍্যালি       গোপালপুরে জাসাস এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত       গোপালপুরে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সম্মেলন       গোপালপুরে বিনামূল্যে সহস্রাধিক শীতবস্ত্র বিতরণ    
 


চোরেরও ধর্ম আছে

::: মোঃ শামছুল আলম চৌধুরী :::
সেই এক চোর। নাম তার গফুর। এলাকার লোকজনের কাছে গফুর সম্রাট হিসেবেই পরিচিত ছিল। সুন্দর দীর্ঘ দেহী, উজ্জ্বল বর্নের হালকা পাতলা ধরনের গফুর। বাড়ি তার জামালুপর জেলার ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের রামভদ্রা গ্রামে। কিন্তু তার ঘাঁটি ছিল ব্রক্ষ্মপুত্রের উত্তরে দূর্গম ডিগ্রীচর এলাকায়। মাটির নিচে বাংকার করে সেখানে চোরাই গরু-মহিষ রাখা হতো। চোর হলেও ডিগ্রীচর এলাকার সকল পুরুষ-মহিলা তাকে পছন্দ করত।  এই লোকটির কাহিনী সে সময়ে এলাকার চাউড় ছিল। তিনি নাকি ঐন্দজালীক শক্তিতে বলিয়ানও ছিলেন। পুলিশ তার টিকিটিও ধরতে পারতোনা। কিন্তু একদিন বিধিবাম। সে এবং তার এক সাগরেদসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ল।

সময়টি ছিল ১৯৬৮ সাল। শোনা গেল গফুর সম্রাট পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। ইসলামপুর থানার হাজতখানা থেকে ধরা পড়ার পরের দিন বিকেল বেলায় গফুর ও তার সাগরেদকে থানা কম্পাউন্ডে বের করা হল। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। থানার মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখলাম দুইজন লোককে পুলিশ কোমরে দড়ি ও হাতকড়া দিয়ে থানা কম্পাউন্ডে নিয়ে এসেছে। আমরা কিছু কিশোর বালক তাদের সামনে জড়ো হলাম। একে একে আরো উৎসুক জনতা এসে ভিড় করলো। দুই দারোগা, একজন বড় অপরজন ছোট। বড় জন ওসি এবং ছোট জন সেকেন্ড অফিসার। এরেই মাঝে গফুর আমাদেরকে দেখে কথাবার্তা শুরু করলো। আমাকে জিজ্ঞাসকরলো তুমি কোন ক্লাসে পড়?
আমি বললাম ক্লাস সিক্স এ পড়ি।
ফাইভে বৃত্তি পেয়েছ?
হ্যাঁ।
খুবই ভালো!
মাস্টারদেরকে সম্মান করবে। বাবা-মার কথা শুনবে। যাতে তাদের আশা পূরণ হয়।
দোয়া করবেন।
ঠিক আছে।
তার হ্যান্ডক্যাপটি তখন খোলা। কিন্তু কোমড়ে রশি বাঁধা ছিল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল দোয়া করি ভালো থাক।
এরপর ছোট দারোগা এসে তাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করলো এবং বেদম প্রহার শুরু করলো। আর বড় দারোগা শুধু তাকে গালমন্দ দিল। কিন্ত প্রহার করলো না। তিনি শুধু ঐ গফুরের সাগরেদকে মারলেন। ছোট দারোগার কঠিন পিটুনির চোটে গফুর রক্তাক্ত হয়ে গেল। ভীড়ের ভিতর থেকে কেউ একজন বলল “দারোগা গফুরের গায়ে হাত তোলার মজা বুঝবে”। কিন্তু সে লোকটিকে পুশিল আর খুঁজে পেল না। সেই রাতেই থানা কম্পাউন্ডে ছোট দারোগার বাসায় দুধর্ষ ডাকাতি হয়ে গেল। বাসার সকল স্বর্ণালংকার, অর্থ ও রিভলবার ডাকাতি করে নিয়ে গেল। ভোর বেলায় বিষয়টা জানাজানি হয়ে যায়। আমরাও গঠনাস্থলে ছুটে যাই। ছোট দারোগাকে খুবই বিমর্ষ ও ভাবলেষহীন দেখাচ্ছাছিল। এরই মাঝে কোন এক লোক এসে জালে ভেসে উঠা দারোগার লাল রেডিওটি দিয়ে যায়। এই ঘটনাটি সে সময় পুরো এলাকাতে চানচল্লের সৃষ্টি করেছিল।

বক্স অফিস হিট ৭০ দশকের হিন্দী সিনেমা ‘শোলে’ (Sholay) হয়তো অনেকেই দেখেছেন। সেই সিনেমার দুই চোর জই (অমিতাভ বচ্চন) আর বীরুর (ধর্মেন্দ্র) কাহিনী অনেকেই জানেন। তাদেরও নীতিবোধ ও সাহস ছিল। আবার চুরি করাও ছিল তাদের পেশা। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ঠাকুর বালদীপ সিং (সঞ্জিভ কুমার) কুখ্যাত দুধর্ষ ডাকাত গব্বর সিংকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় ধরে আনার জন্য দুই চোর জই (অমিতাভ বচ্চন) আর বীরু (ধর্মেন্দ্র)কে অগ্রিম অর্থ দিলেও তারা কাজ শেষ না করে অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাননি। এই দুই চোরেরও অনেক রসালো ও নীতিবোধের কাহিনী শোলেতে স্থান পেয়েছে। রমেশ সিপির পরিচালনায় এই হিন্দী ফিল্মটি ২০২৪ সাল পর্যান্ত ব্যবসা সফল ও জনপ্রিয় সিনেমা হিসেবে বিবেচিত।

হিন্দী ছবির ‍গল্পের মত ‍চুরি আর আর্দশের একটা সংমিশ্রন গফুরের জীবনেও ছিল। ডিগ্রীচর এলাকার অনেক লোকজনকে সে অর্থ দিয়ে সাহায্য করত। গরিবের সন্তানকে অর্থ দিয়ে লেখাপড়ায় সাহায্য করতো। অথর্চ সে নিজে লেখাপড়া জানতো না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যে, চোরাই গরু থেকে কোন অর্থ না পেলে সেই গরু গ্রামের লোকজনদেরকে ‘মেন্দা’ রান্না করে খাওয়াতো। জামালপুর, টাঙ্গাইল এলাকার অত্যন্ত উপাদেয় খাবার হলো এই মেন্দা বা মিল্লী। মূলতঃ মেন্দার সুতিকাগার বলতে ডিগ্রীরচর এলাকাকে বলা যেতে পারে। আর গফুর ছিলেন এটার আয়োজক। তিনি এলাকার লোকজনদেরকে মাঝে মধ্যেই মেন্দা খাওয়াতেন। তাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল নোয়ারপড়ার হারগিলা গ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম ওয়াদুদ মাস্টারের পুত্র সৌদি এয়ারলাইন্সের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীন কর্মকর্তা জনাব আনোয়ারুল কালাম আলমের সাথে। গফুরকে তিনি নিজেও দেখেছেন এবং তার অনেক কেরামতি, দুধর্ষপনা ও পরোপকারের কাহিনীও শুনেছেন বলে জানান। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে গফুর নিহত হন। এভাবেই ন্যায়-অন্যায়ে গড়া এক চোরের আলোচিত অধ্যায়ের অবসান ঘটে।

লেখক পরিচিত :
মোঃ শামছুল আলম চৌধুরী
যুগ্ম-সচিব (অব:)
বিশেষ সংবাদদাতা, গোপালপুর বার্তা।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!