অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় কুকুরের দুধ পানে বড় হওয়া বিস্ময়কর বালকের এক অবিশ্বাস্য গল্প নয় এটি-জীবন কাহিনী। বিখ্যাত ইংলিশ মুভি টার্জান ও মুগলির সাথে তুলনীয় অনেকটা। এ কুকুর বালকের প্রকৃত নাম ফখরুদ্দীন ওরফে ফখরা। মা জমেলা বেগমের মুখ দিয়েই ফখরার গল্পটা শোনা যাক। “জন্মের ছয় মাসের মাথায় ওর বাবা আমাকে তালাক দেয়। অভাবী সংসারের ঘানি টানতে মধুপুর শহরের হাটবাজারে ময়লাআবর্জনা সাফের কাজ নেই। হাটের অপরিচ্ছন্ন সরু রাস্তার ধারে অনাদরে বসিয়ে রাখতাম মাসুম ফখরাকে। ক্ষুধায় কাঁদলে হাতের কাজ ফেলে পান করাতাম বুকের দুধ। ক‘দিন পর খেয়াল করলাম অনাদরে পড়ে থাকা ফখরার বেজায় ভাব বেওয়ারিশ কুকুরের সাথে। তখন থেকে বুকের দুধ পানের ব্যাকুলতা কমতে থাকে। দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। একদিন অবাক কান্ড দেখে হতবাক হয়ে যাই। হাটের আবর্জনার স্তুপের আড়ালে দুই ছানার সাথে কুকুরের স্তন চুষছে ফখরা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। টেনেহিচড়ে সরিয়ে নেই তাকে।
এরপর রাস্তার উপর বসিয়ে রাখা ফখরাকে কাজের সময়েও কড়া নজরে রাখতাম। কিন্তু সুযোগ পেলেই দল বাধা নেড়ি কুকুর ছুটে আসতো। আর ফখরা নির্ভয়ে পান করতো কুকুরের স্তন। রাগেক্ষোভে প্রায়ই মারপিট করতাম। একদিন ফখরা হারিয়ে যায়। টানা দুদিন পর সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায় মধুপুর পৌরশহরের সওদাগর পট্রির জঙ্গলে। এভাবেই কুকুরের সাথে বাড়বাড়ন্তের গল্প ফখরার। পৌর শহরের সব কুকুর এখন ওর খেলার সাথী। বিশ্বস্ত বন্ধু। আসলে কুকুরের দুধ পান করেই বড় হয়ে উঠেছে ফখরা।” এভাবেই ফখরার জীবন ঘনিষ্ঠ গল্পের আক্ষরিক বর্ণনা দেন জমেলা বেগম।
প্রিয় পাঠক, মনে করবেন না গল্পটা একটু বাড়িয়ে বলছি। অথবা শব্দের গাঁথুনিতে সাত রঙা রুপকল্প তৈরি করছি। আমি গল্পকার নই। সাংবাদিক। তাই বর্ণনায় বস্তুনিষ্ঠতার ছোঁয়া রয়েছে পুরোটাতে। মানবিক ও অভূতপূর্ব বিষয়কে সুন্দর বিণ্যাসে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
জমেলার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌরসভার কাজী পাড়ায়। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে জটাবাড়ির আলীম উদ্দীনের সাথে। তিন মেয়ের পর ফখরার জন্ম ২০১১ সালে। অভাবের সংসারে জমেলার মাথা গোজার ঠাঁই ভাইয়ের ভিটায়। বলা অনাবশ্যক, দেড় বছর বয়স থেকে কুকুরের সাথে হাটাচলা, মেলামেশা অবিশ্বাস্য সখ্যতায় রুপ নেয়। চব্বিশ প্রহর পথ চলা, আহারবিহার ও নিশিযাপনে তৈরি হয় অবিচ্ছেদ্য রজু। পাড়ার সব বেওয়ারিশ কুকুরের সাথে ভাব হলেও আদুরী আর বাবুলি সর্বক্ষনের সাথী। ওদের নিয়ে মধুপুর পৌরশহর ছাড়াও গাঙ্গাইর, রক্তিপাড়া, আশ্রা, মোটের বাজার, গারো বাজারসহ উপজেলার হাটবাজার ও গঞ্জ চষে বেড়ায় ফখরা। দুরের রাস্তায় কুকুরের পিঠে পাড়ি দেয়। যেন ঘোড়সওয়ার। বন্ধুর মতো গড়াগড়ি, গলাগলি, কামড়াকামড়ি ও কসরত দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাঁচদশ টাকা বখশিস মেলে। তাতে কেনা হয় কলা-পাউরুটি। ভাগাভাগি করে খাওয়া। এভাবেই কলা আর পাউরুটিতে দিন কাটে সবান্ধব ফখরার।
অনেক সময় খাবারের লোভে দল বাধা কুকুর পিঁছু নেয় ফখরার। আর শহরে নবাগত অতিথিদের সাথে ভাব জমাতে সময় লাগেনা তার। মহল্লায় নবাগত আর মনিব অনুগত দু‘দল কুকুরের আবহমান ঝগড়ায় দাত খেঁচিয়ে সেই গালি “কেন আইলি” প্রত্যুত্তরে “ যাইস খাইস” বিবাদ মেটাতে তৎপর থাকে ফখরা। ডজন খানেক ‘যাইশ খাইশ’ বন্ধু নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় শহরবাসি কেউ কেউ কুত্তার বাচ্চা তুলে গালি দেয়। তাতে গায়ে মাখে না ফখরা। দিনাবসানে মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাতে কুকুরের সাথে কুন্ডলি পাকিয়ে আরামসে সময় কাটায় এ কুকুর বালক। মা জমেলা এখনো মধুপুর বাসষ্টান্ডের পরিচ্ছন্ন কর্মী। তিনি জানান, ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন। লাভ হয়নি। কুকুর না দেখলে উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। তাই ওকে ওর মতো করে ছেড়ে দিয়েছি।
মধুপুর বাসস্টান্ডের পরিবহন শ্রমিক নির্মল জানান, রাতে এক ডজন কুকুরের কড়া পাহারায় বাড়ি ফেরে ফখরা। মায়ের রান্না করা খাবার ভাগ করে খায়। কাক ডাকা ভোরে আবার দলবেঁধে বাসস্টান্ডে। ফখরার তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে।
বড় বোন শাহেদার আক্ষেপ, কুকুরের সাথে থাকা-খাওয়ায় পড়শিরা বিরক্ত। ঘৃণা করে। বকাঝকা করে। কেউ মেশেনা। এমনকি আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে আসেনা। কিন্তু ফখরার ওসবে তোয়াক্কা নেই।
জমেলা বলেন, ‘আবাল্য মেশামেশিতে অবুঝ প্রাণীর সাথে এখন নাড়ির বন্ধন। বোবা প্রাণী ওর আপনজন। ওদেও ভাষা বুঝে। আকার ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করে। কুকুরের সাথে জামাতে খাবার না দিলে অঝোর ধারায় কাঁদে ফখরা। বেশি ক্ষেপলে হাড়িপাতিল ভাঙ্গে। অস্বাভাবিক আচরণ করে। তখন ভয় লাগে।
গত ডিসেম্বরে মধুপুর পৌরশহরে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন নিয়ে লঙ্কাকান্ড বাধায় ফখরা। প্রিয় সহকর্মী কালু ও ভুলু নিধন হয় অভিযানে। এতে ক্ষেপে যায় ফখরা। বাড়িতে অস্বাভাবিক চেঁচামেচি শুরু করে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে মায়ের পরামর্শে একদঙ্গল কুকুর নিয়ে পৌর ভবনে মেয়র মাসুদ পাভেজের সাথে সাক্ষাৎ করে।
মেয়রকে জানায়, বন্ধু কালু আর ভুলু কখনো মানুষ কামড়াতো না। তাহলে কেন তারা নিধন হলো। মেয়র আগে থেকেই ফখরাকে চেনেন। তাই আদরসোহাগ সাঁধিয়ে বিদায় করেন এ বালককে।
ফখরা জানায়, মেয়র তাকে খুব আদর করেন। তাকে কথা দিয়েছেন। বন্ধুদের আর নিধন করা হবেনা। এজন্য সে খুবই খুশি। এ ব্যাপারে মেয়র মাসুদ পারভেজ ফখরার কুকুর প্রীতি ও কুকুরের দুধ পানে বেড়ে হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক অবাক কান্ড ঘটে। এটি তার অন্যতম। কুকুর নিধনের প্রতিবাদে ফখরার পৌর অফিসে আসার কথা স্বীকার করে মেয়র বলেন, “কুকুরের সাথে মানুষ হওয়া এ শিশুটির চাওয়া ছিল মানবিক। আসলে বিনা কারণে কুকুর নিধন না করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্টের।
গত ডিসেম্বরে নিধন অভিযানের পর মধুপুর পৌর শহরে বেওয়ারিশ কুকুর কমে যায়। তবে গ্রাম থেকে আসা নবাগত কুকুরের সাথে ফখরার মিতালি গড়ে উঠে সমতালে। পৌর শহরের পাইলট মার্কেটের দোকানি রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ফখরাকে ছোট্রকাল থেকেই কুকুরের সাথে বড় হতে দেখেছি। কুকুরের দুধ পান করার দৃশ্য অনেকেই অবলোকন করেছেন। মধুপুর পাইলট মার্কেটের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ভুট্রো সরকার বলেন, ‘আজন্ম কুকুরের সাথে মিতালির দরুন কখনো কখনো ওর মধ্যে অসহিষ্ণু ও ক্ষিপ্ত আচরণ দৃষ্ট হয়। রাগলে গলা দিয়ে অস্বাভাবিক স্বর বের হয়। সর্বক্ষন জিহ্বা বের করে রাখতে পছন্দ। হাটা ও পা ফেলার স্টাইলে কুকুরের অনুকরণ লক্ষনীয়। চোখের নির্বিকার চাহনিতে ক্রুরতা দৃশ্যমান। খুবই ছটফটে ও দুরন্ত স্বভাবের। কোথাও এক দন্ড স্থায়ী হতে চায়না।
মা জমেলা বলেন, ‘ওর কুকুর সঙ্গ বিরত রাখা বিফলে গেছে। জরুরী চিকিৎসা দরকার। আমরা খুবই গরীব। এক বেলা খাবারই জুটেনা। আমার বুকের মানিকের চিকিৎসা করাবো কিভাবে। মানুষে-কুকুরে এ মিতালি বিস্ময়কর না হলেও স্বভাবে হিংস্র ও মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত ফখরার সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহৃদয়বানদের এগিয়ে আসার আর্তি জানান মাতা জমেলা বেগম।
প্রিয় পাঠক, ফখরার মতো অসহায় শিশুকে নিয়ে এ লেখা কেমন লাগলো আপনাদের? আমাদের চারপাশে এমন বিস্ময়কর ও বৈচিত্র্যময় যাপিত জীবনের চিত্র অনেক রয়েছে। আমরা কেউ সেসব নিয়ে দৃষ্টি দিতে চাইনা। তাই সেসব লোক চক্ষুর অর্ন্তরালে থেকে যায়। লেখাটি ভালো লেগে থাকলে যতো পারুন শেয়ার করুন। আমাদের সকলের ভাবনার দুয়ার খুলে যাক। আমরা ফখরাকে ঘৃণা না করে ভালোবাসি। প্রগৈতিহাসিক যুগের অবসান ঘটাই।
প্রতিবেদক : দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, সম্পাদক, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম, উত্তর টাঙ্গাইল সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।