আজ || রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


ভালোবাসার ভায়োলিন

:: অজেয় চৌধুরী ::

এক. জানালা কাচ ভেদ করে সূর্যের আলোটা মুখের ওপর পরতেই ঘুম ভেঙে গেল রবিনের। পাশ ফিরে সাইড টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট ঘড়িটার দিকে চেয়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে নামল। আরে আটটা বেজে গেছে। এগারোটায় তো ইন্টারভিউ। কমপক্ষে দু ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হতে হবে তাকে। নাহলে ঢাকার রাস্তার যে অবস্থা, তাতে জ্যাম কাটিয়ে সঠিক সময়ে ইন্টারভিউয়ের স্থানে পৌঁছানো যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ওয়্যারড্রোব থেকে পছন্দের স্কাই ব্লু শার্টটা বের করল। সাথে নীল টাই ও অফহোয়াইট প্যান্ট। ড্রেসআপ শেষ করে কিচেনে গিয়ে চায়ের পানি বসাল। ডাইনিংয়ে বসে এক স্লাইস ব্রেডে জেলি মিশিয়ে কোনো রকমে খেল। চা বানানোর জন্য গরম পানি মগে ঢালল সে। টি-ব্যাগ মগে দিয়ে কৌটা খুলে হাফ চামচ চিনি দিল। মাত্র চায়ে একটা চুমুক দিয়েছে এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সে বিরক্ত ভাব নিয়ে রুমে গিয়ে ফোনটা উঠিয়ে দেখল আলো ভাবির কল। রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, ‘ভাবী, এত সকালে! কোনো সমস্যা? জামিল ভাইয়ের শরীর ভালো তো।’ ওপাশ থেকে আলো ভাবি বললেন, ‘হ্যাঁ, ওর শরীর ভালোই আছে। সময় করে আজ বিকেলে একটু বাসায় এসো। তোমার সাথে কথা আছে।’ রবিন, ‘ঠিক আছে, আসব ভাবি।’ ফোনটা রেখে আবার চায়ের মগে দুটো চুমুক দিয়ে রেখে দিল। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে রবিনের মেজাজটা হালকা খারাপ হলো। আজ শনিবার অথচ মতিঝিল যাওয়ার একটা বাসও নেই। দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা বাস থামল। কিন্তু যাত্রীতে বোঝাই বলে সে উঠল না। এই ভিড় বাসে উঠলে একবারে ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা হবে তার। ইন্টারভিউতে অন্তত ফ্রেশ লুকে থাকাটা জরুরি। হাতঘড়িতে সময় দেখল- নয়টা পঞ্চাশ। সময় কেন যে এত দ্রুত যায়। ঠিক টাইমে সে পৌঁছতে পারবে তো? কিছুটা টেনশন মনের কোণে উঁকি দিল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে মনে মনে বলল, ‘অবশ্যই ঠিক টাইমে যেতে পারব।’ পজেটিভ থিংকিংটা অলটাইম রাখতে হবে। সাভার থেকে আসা একটা বিআরটিসি বাস থামল। মাথা উঁচু করে এক পলকে রবিন দেখল বাসটি মোটামুটি ফাঁকাই। ভিতরে খালি সিটও আছে। আল্লাহ্র নাম নিয়ে বাসে উঠল।

দুই. দিলশাদ গ্রুপের অফিসে প্রবেশ করে রবিনের মনটা শান্ত হয়ে গেল ভিতরের মনোরম পরিবেশ দেখে। পুরো অফিসে সুনসান নিরবতা। কার্পেট মোড়ানো মেঝে যেন একটু বেশি পরিষ্কার। দেয়ালজুড়ে নানা চিত্রকর্ম। প্রতিটি কর্নারে শোভা পাচ্ছে সোনালি টবে লাগানো সবুজ গাছ। রিসিপশনে গিয়ে দাঁড়াতেই ফ্রন্ট ডেক্সের পরিপাটি স্মার্ট মেয়েটি সুন্দর করে হাসল। রবিন তাকে বলল ইন্টারভিউয়ের জন্য এসেছে। মেয়েটি কোনো কথা না বলে হাতের ইশারায় পাশের রুমে যেতে বলল। সে দরজা ঠেলে রুমে গিয়ে দেখল আরও চারজন অপেক্ষা করছে। একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সাইলেন্ট মুড করল। একে একে চারজন ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলো। এবার রবিনের পালা। সে বড় একটা শ্বাস নিয়ে আবারও মহান আল্লাহকে স্মরণ করে ভিতরে ঢুকল। সালাম দিয়ে সে চেয়ারে বসল। বড় টেবিলের অপর প্রান্তে তিনজন বসে আছেন। মাঝে স্যুট পরা চোখে সানগ্লাস দেওয়া মহিলাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল তার। কোথায় যেন দেখাও হয়েছে। ধ্যাৎ, উনি তার চেনা হতে যাবে কেন? সে তো চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। তিনজনই তার কাগজপত্র মনোযোগ সহকারে দেখছেন। বাম পাশের লোকটি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম?’ রবিন উত্তর দিল, ‘সৈয়দ রবিন সরকার।’ ডান পাশের লোকটির কাছ থেকে প্রশ্ন এলো, ‘মাস্টার্স কোথায় করেছেন?’ প্রশ্ন শুনে রবিন কিছুটা বিরক্ত হলো। কেননা তার সার্টিফিকেটে লেখাই আছে সে কোথা থেকে মাস্টার্স করেছে। তবু বিরক্ত ভাবটা চেহারায় প্রকাশ না করে উত্তর দিলো, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, স্যার।’ রবিন এবার মাঝের মহিলা বসের কাছ থেকে প্রশ্ন আশা করল। তাই মুখ তুলে একবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু তিনি কোনো প্রশ্ন করলেন না। বরং তিনি রবিনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। এবার তিনজনই একসঙ্গে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে রবিনকে বিদায় জানালেন। রুম থেকে বের হয়ে রবিন বুঝতে পারল, এই চাকরিটা তার কপালে নেই। কেননা আগের প্রার্থীরা প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট করে ইন্টারভিউ দিলো। আর তাকে কিনা মাত্র পাঁচ মিনিটেই বিদায় জানাল। কিন্তু চাকরিটা তার খুবই দরকার ছিল। আগের চাকরিটা রাগ করে ছেড়ে সে বিপদেই পড়েছে। চাকরি ছাড়া গত চার মাসে চলতে গিয়ে তাকে বেশ কিছু লোন করতে হয়েছে। এই মুহূর্তে একটা চাকরি না মিললে ঢাকা শহরে থাকাটাই মুশকিল হয়ে যাবে।

তিন. ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে বের হলো রবিন। হাতঘড়িতে সময় দেখল তিনটা পাঁচ মিনিট। পাশের দোকান থেকে একটা সাদা বেনসন নিয়ে ধরাল। পরপর দুটো জোরে টান দিয়ে একগাল ধোঁয়া ছাড়ল। মানিব্যাগ থেকে একটা বিশ টাকার নোট দোকানিকে দিলো। দোকানদার ছেলেটি বলল, ‘ছ্যার, এক খান মিষ্টি পান দিমু?’ রবিন তার দিকে চেয়ে উত্তর দিলো, ‘দাও, বাকি টাকার পান দাও।’ মিষ্টি পান ধরে সে প্রথমে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধটা ভিতরে পাঠিয়ে তারপর মুখে পুরে ফেলল। আয়েশ করে পান চিবাতে চিবাতে সিগারেটে টান দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে মিষ্টি পান খেতে ভালোই লাগে তার। হেঁটে শাপলা চত্বরে এসে উত্তরার একটা বাসে উঠে বসল। উদ্দেশ্য আলো ভাবির বাসা। সকালে ফোন করে উনি যেতে বললেন। নিজের ভাবি না হলেও উনি তাকে আপন ছোট ভাইয়ের মতো আদর করেন। বাসায় গেলে না খাইয়ে ছাড়েন না। ফার্মগেটে এসে রবিনের বাস জ্যামে আটকে রইল। কিছুক্ষণ পর তার মাথায় আবারও ‘চাকরি’ শব্দটা ঢুকে গেল। কীভাবে একটা চাকরি ম্যানেজ করা যায় ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ তার সীমার কথা মনে পড়ল। তার সাথে রবিনের পরিচয়টা আলো ভাবির বাসায়। শুনেছে একটা কোম্পানির এমডি। ওই দিনেই চা খেতে খেতে সীমা তার ফোন নম্বরটা নিয়েছিল। দুদিন পর সীমা ঠিকই ফোন দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলেছিল কোনো প্রয়োজন হলেই যোগাযোগ করতে। এরপর সপ্তাহ তিনেক পার হয়েছে। আর ফোন করেনি সে। রবিনও নিজ থেকে কল দেয়নি সীমাকে। আর সে কিছুটা লাজুকও। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে মেয়েদের সাথে মিশতে পছন্দ করে না। একবার ভাবছে তাকে ফোন করবে চাকরির জন্য। আবার ভাবছে সেটা কি ঠিক হবে? এতদিন আর কল দেয়নি রবিন। এখন নিজের প্রয়োজনে চাকরি চাইতে কল দিবে ঠিক করল। থাক, কল দিবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিলো সে। যা আছে কপালে, তাই হবে।

চার. আলো ভাবির বাসার কলিং বেলে চাপ দিলো রবিন। দরজা খুললেন ভাবিই। হেসে বললেন, ‘ইন্টারভিউ কেমন হলো?’ ভিতরে ঢুকে রবিন উল্টো প্রশ্ন করল, ‘আমার ইন্টারভিউ ছিল বুঝলে কীভাবে?’ আলো বলল, ‘শোনো, তোমাকে যেহেতু ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করি, তখন সব খবরই রাখতে হয় আমার। হুম, তাই তো দেখছি…’ রবিন হেসে বলল, ‘ভাবি, ইন্টারভিউয়ের কথা আর বলো না। হবে না কিছুই।’ ভাবি, ‘কেন হবে না?’ ‘অন্যদের ইন্টারভিউ নিয়েছে আধা ঘণ্টা, আর আমার সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। সো বুঝতেই পারছ,’ বলল রবিন। উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে আলো বলল, ‘আমি বললাম তো, তোমার এই চাকরিটা হবে।’ বিস্ময়ে চোখদুটো বড় করে রবিন প্রশ্ন করল, ‘মানে!?’ ‘অত মানে টানে বুঝি না,’ বলে ড্রয়িংরুম থেকে ডাইনিংয়ে চলে এলেন আলো ভাবি। পিছন পিছন রবিনও। ‘তুমি বসো, আগে নাস্তা করো। বাকি কথা পরে হবে।’ রবিন চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢেলে খেল। এরমধ্যে ভাবিও আরেকটা চেয়ারে বসে প্লেটে খাবার সাজিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘নাও, তোমার পছন্দের গাজরের হালুয়া। খাও, বেশ হয়েছে আজকেরটা। ’সে প্লেটটা নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে এক চামচ হালুয়া খেয়ে বলল, ‘সত্যিই, ভাবি তোমার রান্না অসাধারণ।’ ভাবি হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমার ভাইও তাই বলে আসছে বিয়ের পর থেকেই।’ ‘তুলি, এই তুলি’ বলে ভাবি চিৎকার করে বলল, ‘আমাদের চা দিয়ে যাও।’ এক মিনিটের মধ্যেই কাজের পিচ্চি মেয়ে তুলি দুই কাপ চা নিয়ে হাজির। মাঝেমধ্যে ভাবির বাসায় এসে অবাক হয় রবিন। ভাবি যখন যা চায়, তখনই হাজির হয়। সব যেন আগে থেকেই রেডি থাকে। হালুয়া খেয়ে রবিন চায়ে চুমুক দিলো। ভাবিও বেশ আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ভাবি মৃদু হেসে বলল, ‘চাকরিটা তোমার হয়ে যাবে।’ ‘বলো না ভাবি, কীভাবে তুমি এতটা শিওর হয়ে বলছ।’ কিছুটা রহস্যের ভাব নিয়ে ভাবি বলল, ‘হুম, শিওর। তবে শর্ত প্রযোজ্য।’ রবিন বলল, ‘শর্ত মানে, বুঝলাম না।’ ভাবি উত্তর দিলেন, ‘তুমি চাকরিটা পাবে যদি একটা শর্ত মেনে নাও।’ ‘কী রকম শর্ত আমাকে খুলে বলা যায়,’ জানতে চাইল রবিন। ভাবি বলল, ‘চাকরিটা তোমাকে যে দেবে, সেই বলবে শর্তটা কী?’ ‘ভাবি, তুমি আর রহস্য করো না তো। প্লিজ আমাকে খুলে বলো। ইউ নো, এই মুহূর্তে একটা চাকরি আমার কতটা প্রয়োজন,’ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলল রবিন। কলিংবেলের শব্দে তাদের কথাবার্তার ছেদ ঘটল।

পাঁচ. তুলি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ড্রয়িংরুমে সীমাকে ঢুকতে দেখে ‘এসো এসো’ বলে ডাকলেন ভাবি। সীমার নামটা শুনে রবিন তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। কয়েক সেকেন্ড তার পলক পড়ল না। আর হাঁ করে থাকারই তো কথা। সীমা এমনিতেই অসম্ভব সুন্দর। আজ সে পরেছে স্লিভলেস ব্লাউজ ও গাঢ় নীল রঙের সিফন জর্জেট। কাঁধে ছড়ানো রেশমি চুলগুলো ফ্রেঞ্চ স্টাইলে বাঁধা। সব মিলিয়ে ঊর্বশীর মতো লাগছে। ভাবি বলল, ‘রবিন, হাঁ করে আছ কেন?’ কথাটা শুনে সে কিছুটা লজ্জা পেল। রবিন, ‘না, ভাবি ঠিক আছি।’ সীমা এসে তার পাশের চেয়ারটায় বসেছে। তার শরীর থেকে প্যারিসের দামি পারফিউমের সুবাস ছড়াচ্ছে। পরিবেশ হালকা করতে ভাবি সীমাকে বলল, ‘আসতে অসুবিধা হয়নি তো, জ্যাম ছিল কি রাস্তায়?’ খুব আস্তে করে সীমা উত্তর দিলো, ‘না, ভাবি।’ ভাবি সীমাকে হালুয়া খেতে দিলেন। সেও খুব সাবধানে অল্প অল্প করে খাচ্ছে। তুলি চা দিয়ে গেল সীমার জন্য। চায়েও দু’বার চুমুক দিলো সীমা। ভাবি বলল, ‘রবিন, তোমাকে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। দিতে পারে সীমা। আজ তুমি যে ইন্টারভিউটা দিয়েছ, ওটা আসলে সীমার ফার্ম। ও ছিল সকালে ইন্টারভিউ বোর্ডে।’ ‘ও ছিল’ শব্দটা কানে যেতেই দিলশাদ গ্রুপে ইন্টারভিউয়ের সব দৃশ্য রবিনের চোখের সামনের দিয়ে একে একে পার হয়ে গেল। এবার সে বুঝল কেন মহিলা বসটি তাকে ওইভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তখন সীমাকে ভালো মতো দেখেনি বলে চিনতে পারেনি সে। ‘কী ভাবছ?’ ভাবীর প্রশ্ন শুনে রবিন উত্তর দিল, ‘না, কিছু না।’ ভাবী বলল, ‘শর্ত মানলে চাকরিটা তুমি পাবে।’ ভাবি আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন বুঝে রবিন তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘যদি শর্ত না মানি, তবে কি চাকরি হবে না?’ ভাবী বলল, ‘রবিন, তোমাকে আমি ছোট ভাইয়ের মতো ¯েœহ করি। তাই আমি চাই তুমি চাকরিটা পাও। শর্ত না মানলে কী হবে, সেটা যার শর্ত সেই বলতে পারবে। সীমাকে আমি অনেক আগে থেকে যতটুকু চিনি, ও খুব ভালো একটা মেয়ে। আসলে ও তোমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি তোমাকে সেজন্যই ডেকেছি।’ ভাবির সব কথা শুনে রবিন একবার সীমার দিকে তাকাল। সীমা মাথা নিচু করে বসে আছে চেহারায় কেমন যেন অপরাধী ভাব। ভাবি বলল, ‘তোমরা ওই বারান্দায় গিয়ে বসো, কথা বলো। আমি রাতের রান্নাটা সেরে ফেলি। দুজনেই রাতে খেয়ে যাবে।’ কথা শেষ করেই ভাবি রান্নাঘরে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর প্রথমে সীমা চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। তার পিছন পিছন ধীর পায়ে হেঁটে গেল রবিন।

ছয়. পশ্চিম দিকের বারান্দাটা বেশ বড়। রেলিং ঘেষে বেশ কিছু ফুলের টব সাজানো। দশ তলা এই ব্লিডিংয়ের আশপাশে কোনো উঁচু বাসা নেই। সামনের আকাশজুড়ে গোধূলি বেলার হালকা লাল রং অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। রবিন ও সীমা বসে আছে পাশাপাশি চেয়ারে। প্রায় বিশ মিনিট সময় পার হয়ে গেছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দুজনে চেয়ে আছে সামনের আকাশের দিকে। সীমা নিজের সঙ্গে থাকা বড় পার্সটা খুলে একটা খাম বের করে রবিনের হাতে দিয়ে বলল, ‘ধরো।’ রবিন খামটা নিয়েই দেখল সেখানে দিলশাদ গ্রুপের মনোগ্রাম দেওয়া। খামের ওপরে ‘সৈয়দ রবিন সরকার’ নাম লেখা দেখে বুঝতে পারল ওটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। সীমার দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, ‘আপনার শর্তটা তো জানলাম না।’ প্রশ্ন শুনে সীমা অসহায়ের মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘সার্টিফিকেট ও জব এক্সপিরিয়েন্স বিবেচনা করেই তোমাকে আমরা সিলেক্ট করেছি। তুমি কাল থেকে জয়েন করতে পারবে।’ রবিন কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘শর্ত ছাড়াই কি আমার চাকরি হয়েছে? নাকি শর্ত প্রযোজ্য?’ সীমা ডান হাত দিয়ে রবিনের বাম হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘আমাকে আর ছোট করো না, প্লিজ। কিছু মনে না করলে তোমাকে আমার কয়েকটা কথা বলার আছে।’ রবিন, ‘বলুন, আমি শুনতে চাই।’ সীমা চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়াল। পাশের মানুষটির কাছ থেকে নিজেকে একটু আড়াল করতেই এমন উঠে যাওয়া। আকাশের দিকে চেয়ে কয়েক সেকেন্ডে ঠিকই নিজেকে সামলে নিয়ে সীমা বলল, ‘রবিন তোমার সাথে গত বাইশ দিনে এখনসহ মাত্র তিন বার দেখা হয়েছে। তুমি আমাকে যতটুকু দেখছ তাতে সবটা চেনা বা জানার কথা নয়। আমার সবকিছুই আছে, তারপর একটা দুঃখবোধ আছে। প্রথম যেদিন তোমাকে আমি এখানে দেখি, তখনই মনের ভিতর একটা আলোর ঝলকানি উঠেছিল। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। যার জন্য তোমার ফোন নম্বরটা চেয়েও নিয়েছিলাম। একদিন ফোনও করেছিলাম। কিন্তু তোমার দিক থেকে সেভাবে সাড়া পাইনি। তবু তোমাকে বলেছিলাম প্রয়োজন মনে করলে ফোন করো। তুমি আর ফোন দাওনি। একদিন অফিসে গিয়ে যখন দেখলাম তোমার অ্যাপ্লিকেশন আমার টেবিলে, তখন আমি খুশি হয়েছিলাম। গতকাল রাতে আলো ভাবিকে তোমার কথা বললাম। উনি তোমার কথা শুনে চাকরিটা দিতে বলল। আমি তখন উনাকে ঠাট্টা করে বলি যে, চাকরি দিবো তবে আমার একটা শর্ত আছে। সেটা কেমন জানতে চাইলে বললাম, আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে এবং প্রয়োজনে বেড পার্টনারও। কথা শুনে উনি কষ্ট পেয়েছিলেন। আবার আমার কষ্টটা উনি জানেন বলে হয়তো কিছু বলেননি। তবে আজ চান্স পেয়ে উনি আমাকে ঠিকই কথা শুনিয়ে দিয়েছেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে সীমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে নিজের অজান্তে। রবিন কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা খেয়াল করেনি সীমা। রবিন ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই সীমা ঘুরে তাকাল। এবার রবিনের চোখে পড়ল সীমা কাঁদছে। রবিন তর্জনী দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি চাকরিতে জয়েন করব, তবে আমার একটা শর্ত আছে।’ সীমা উদ্বেগভরা কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘শর্ত মানে! তোমার আবার শর্ত কেন?’ রবিন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, ‘আগে ছিল তোমার শর্ত, এখন আমার শর্ত।’ সীমা বলল, ‘আমি তো ওটা ঠাট্টা করে বলেছিলাম।’ রবিন সিরিয়াস কণ্ঠে জবাব দিলো, ‘আমারটা সিরিয়াস, নো ঠাট্টা… নো ইয়ার্কি।’ সীমা বলল, ‘বলো, শুনি।’ ‘আমি ভায়োলিন খুব ভালোবাসি। শুনতে ও বাজাতে। সো, তুমি যদি আমার সেই ভালোবাসার ভায়োলিন শোনার বন্ধুত্ব গ্রহণ করো, তবেই তোমার ফার্মে জয়েন করব,’ বলেই রবিন হো-হো করে হাসতে শুরু করল। রবিনের বুকে দু’হাতে হালকা ঘুসি মেরে সীমা বলল, ‘তুমি একটা পাগল।’

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!