বাংলার প্রাচীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের একাল-সেকাল (২)
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : মিরজাফর। বাংলার ইতিহাসে এক বিশ্বাসঘাতকের নাম। এটি এতই ঘৃণিত যে সারা বাংলা মুলুকে এ নামে কাউকে খুঁজে পাবেন না। উভয় বাংলায় এ নাম এখন হীন গালির পর্যায়ভূক্ত। মিরজাফরের প্রকৃত নাম মির জাফর আলী খান। পিতার নাম আহমেদ নাজাফি। পিতামহ হোসেন নাজাফি। বংশের বাইশতম পূর্ব পুরুষ ইব্রাহিম তাবতাবাই ছিলেন ইরাকের নাজাফ প্রদেশের বাসিন্দা। জাফর পরিবার বংশপঞ্জিকায় দাবি করেন, ইব্রাহিম তাবতাবাই ছিলেন ইমাম হোসেনের বংশধর। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকদের গবেষণায় দেখা যায়, তাবতাবাই এর পূর্ব পুরুষরা ইমাম হোসেন নয়- বরং কারবালার কসাই ইয়াজিদের সমর্থকদের অন্তর্গত ছিলেন। পরবর্তীতে তারা শিয়া মতবাদ গ্রহন করে নিজেদের ইমাম হোসেনের বংশধর দাবি করেন। সুতরাং মিরজাফরের স্বভাবচরিত্রে কুখ্যাত ইয়াজিদ ও সীমারের বদ খাসিলত বিদ্যমান থাকা অসম্ভব ছিলনা। বাংলার তদানিন্তন রাজধানী মুর্শিদাবাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মিরজাফরের আনুপূর্বিক ভূমিকা পর্যালোচনায় এ ধারনাকে একবারে বাতিল করার অবকাশ নেই।
ভারত তথা বাংলা তখন ছিল ধন-ধাণ্যে-পুস্পে ভরা। তুর্কি, মুঘল, আফগান, পাঠান ছাড়াও আরব জাতিগোষ্ঠি দাবিদার মিরজাফরের পিতামহ হোসেন নাজাফি স¤্রাট শাহজাহানের সুবর্ণ যুগে ভারত বর্ষে আগমন করেন। যেমন এসেছিলেন ইরানের খোরাসানের বাসিন্দা মির্জা মোহাম্মদ শাহ কুলি খান, যিনি ছিলেন নবাব আলীবর্দি খানের পিতা। এরা প্রত্যেকেই প্রথমে দিল্লীতে মুঘল দরবারে হরেক কিসিমের চাকরি করে সৌভাগ্যক্রমে বাংলায় আসেন। কারণ বঙ্গে-ই-সুবা তথা বাংলা ছিল তখন সমগ্র ভারতের মধ্যে নেয়ামত ভরা উদ্যান। এজন্য মুঘল শাসনের দুর্বলতার যুগে বাংলায় আফগান, ইরানী আর এরাবিয়ান জাতিগোষ্ঠির মানুষের ভোগবিলাসের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়াও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, হত্যা ও ক্ষমতার অসূস্থ লড়াই চলছিল। এ লড়াইয়ে ইরানী বংশোদ্ভত আলীবর্দির গোষ্ঠির সিরাজ পরাজিত ও নিহত হন। আর এরাবিয়ান দাবিদার মিরজাফর ব্রিটিশ বেনিয়ার কূটচালে নামে মাত্র নবাব সেজে বাংলার মসনদে বসেন।
মিরজাফররা ছিলো ৬ ভাই, দুই বোন। ক্রমানুসারে দ্বিতীয় মিরজাফর বাল্য থেকেই কূটচালে অভ্যস্ত ছিলেন। কৈশোরে তরবারি চালনার দক্ষতা দেখে মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেব তার প্রশংসা করেছিলেন। বাবা আহমেদ নাজাফি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন কূটনীতিতে সিদ্ধহস্ত এবং অসি চালানোতে পারদর্শি মিরজাফর একদিন হিন্দুস্থানের কোনো না কোনো রাজ্যের কর্ণধার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবেন। বাবা আহমেদ নাজাফির কথা ফলেছিল। পিতার মৃত্যুর তিন দশক পর মিরজাফর ভারতবর্ষের বাংলা মুলুকের পুতুল নবাব হয়েছিলেন। তাও কূটনৈতিক প্রজ্ঞায় নয়- ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রভূ হত্যার সিড়ি পেরিয়ে। আর অসি চালানোর পারদর্শিতার কথা? মিরজাফর জীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য যুদ্ধেই জয় লাভ করেননি। মহারাস্ট্রের মারাঠা, যারা বাংলায় বর্গী দস্যু নামে পরিচিত ছিল। তাদের দমনে নবাব আলীবর্দি সেনাপতি মিরজাফরকে মেদেনীপুর পাঠান। বর্গীদের দাপট দেখে মিরজাফর যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে মুর্শিদাবাদ ফেরেন। অগত্যা বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দি খান দৌহিত্র সিরাজকে সাথে নিয়ে বর্গীদের পরাস্ত এবং বাংলা থেকে বিতাড়ন করেন। এ যুদ্ধে তরুন সিরাজ অপরিসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। আর পলাশির যুদ্ধ? বাংলা ও বাঙ্গালীর ভাগ্যনির্ধারণকারি সেই যুদ্ধে মিরজাফর কতটা সাহসিকতা আর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিলেন তা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই।
মিরজাফর ১৬৯১ সালে মতান্তরে ১৬৯৩ সালে দিল্লীতে জন্মগ্রহন করেন। মারা যান ১৭৬৫ সালে মুর্শিদাবাদে। তিনি ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী, ফর্সা, সুঠাম দেহের অধিকারি। সব সময় দামি পোষাক ও হিরাজহরতের অলঙ্কারে সুসজ্জিত থাকতেন। ফিস ফিস করে কথা বলতে পছন্দ করতেন। আর দরবারে বসে কানাকানির অভ্যাস ছিল। তবে ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন মিরজাফর। যা করতেন ধীরে-সুস্থে রয়ে-সয়ে। যেমন, আলীবর্দির জলসা ঘরের সুন্দরী রমণী মুন্নী বাঈকে চোখে ধরে মিরজাফরের। প্রধান সেনাপতি থাকাবস্থায় ওই বাইজীকে নিয়ে স্ফুর্তি করলেও তাতে মন ভরেনি মিরজাফরের। বিয়ে ঘরে তোলার খায়েশ ছিল তার। কিন্তু প্রচলিত রাজকীয় রীতিনুযায়ী জলসা ঘরের নতর্কী বিয়ে করা অভিজাত মুসলমানের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। মিরজাফর তার দীর্ঘ দিনের এ খায়েশ পূরণ করেন পলাশী যুদ্ধের পর পুতুল নবাব হয়ে। এ সময়ে পুত্র মিরন বজ্রপাতে মারা গেলে এবং প্রথম স্ত্রী শাহ বেগম ইন্তেকাল করলে কুমতলব হাসিল করার সুযোগ পান মিরজাফর। সকল লোকলজ্জার মাথা খেয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মিরজাফর শুধু মন্নী বাঈকেই নয়- অপর বাঈজী বাব্বী বেগমকেও এক সপ্তাহের ব্যবধানে সাদী করে বেগমের মর্যাদা দেন। এভাবে মুর্শিদবাদের জেনানা মহলে শুরু হয় বাঈজী থেকে বেগম হওয়ার অধঃপতিত ও ঘৃণিত কাহিনী। এ কাহিনীরও নায়ক সেই মিরজাফর।
বাঈজী মুন্নীর ঘরে জন্ম নেয় পুত্র নাজিমুদ্দৌলাহ। কথিত রয়েছে দুশ্চরিত্রা মুন্নী বাঈ লর্ড ক্লাইভকে রুপে বিমোহিত করে নাবালক পুত্র নাজিমের জন্য বাংলার নবাবী পদ নিশ্চিত করেন। নাজিম ইংরেজদের অনুকম্পায় পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদের নবাব হন। মঁসিয়ে লা মিরজাফরকে ফাঁসেক এবং নি¤œরুচির বলে উল্লেখ করেছেন। এক সাথে দুই বাঈজীকে বেগম বানিয়ে নবাবী মহলে স্থান দেয়ার ঘটনা মিরজাফরকে শুধু বিশ্বাসঘাতক নয়- নির্লজ্জ এবং বেশরম বলে আখ্যায়িত করেছেন ঐতিহাসিক কর্ণেল মেলিশন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় দেখা যায়, রাজকীয় কাজের সময় তিনি অনেকের সামনে প্রশংসা করতেন, আর আড়াল হলেই বিরুপ মন্তব্য ছুড়ে দিতেন। এজন্য রাজদরবারে সৎ বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কোনো আমত্য তার প্রকৃত বন্ধু ছিলনা। ‘মানিকে মানিক চিনে’ এ বহুল প্রবাদের মতো সূদখোর জগৎশেঠ, নারদ খ্যাত উমিচাঁদ, লোভী ইয়ার লতিফ এবং প্রতারক লর্ড ক্লাইভ তার বন্ধু হয়েছিল। আর এরা সবাই মিলে রচনা করেছিল পলাশী যুদ্ধের নাটক। সমসাময়িক ঐতিহাসিক করম আলী খান রচিত মোজাফফরনামা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মিরজাফর সুরাপানে অভ্যস্থ ছিলেন। হেরেমে নারী নিয়ে সব সময় স্ফূর্তি করতেন। বৃদ্ধ বয়সে সূরা পানের অভ্যাস আরো বেড়ে যায়। দ্বিতীয় দফা নবাব হওয়ার পর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মিরজাফর নিতে পারতেন না। মুন্নী বাঈ সব কাজের সিদ্ধান্ত দিতেন। এভাবে বাংলার নবাবী চালাতো ইংরেজ আর এক নাচনেওয়ালী।
মিরজাফর আলীবর্দি খানের সৎবোন শাহ খানমকে ১৬২৭ মতান্তরে ১৬২৮ সালে বিয়ে করেন। শাহ খানম ছিলেন মিরনের মাতা। আর মিরন ছিলেন সিরাজের বাল্যবন্ধু। আলীবর্দির প্রাসাদে ভগ্নি শাহ খানম বেড়াতে গেলে পুত্র মিরনকে সাথে নিয়ে যেতেন। সমবয়সী মিরন ছিলেন সিরাজের খেলার সাথী। আলীবর্দির কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় কনিষ্ঠ কণ্যা আমেনা খাতুনের দ্বিতীয় পুত্র সিরাজকে দত্তক নিয়ে আসেন। সেহেতু সিরাজ দাদুর অতি আদরে রাজপ্রাসাদেই বিনা শাসনে বেড়ে উঠেন। আর সেখানেই বাল্যে মিরনের সাথে সখ্যতা। মিরজাফর পুত্র মিরন এ সখ্যতা বেশি দিন রাখেননি। পলাশী যুদ্ধের পর সিরাজ বন্দী হলে মিরনের নির্দেশেই মোহাম্মদী বেগ তাকে হত্যা করেন। আর এ হত্যার পেছনে ইন্ধন জোগান ক্ষমতালোভী মিরজাফর আলী খান।
ভারতীয় লেখক সঞ্জীব ঘোষ তার ‘দেশপ্রেমিক’ উপন্যাসে মিরজাফর চরিত্র রচনা করেছেন এভাবে- ‘সব দেশেই সব যুগেই মিরজাফররা আসেন। সিরাজরাও থাকেন। মিরজাফরা সুযোগমতো সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সমাজ ও রাষ্ট্রে এজন্য মিরজাফর ও সিরাজের লড়াই চলে নিরন্তর’ যতদিন সিরাজরা দেশ ও রাষ্ট্রের অতন্ত্র প্রহরায় থাকবেন- ততদিন মিরজাফররা রাতের আঁধারে ষড়যন্ত্রের জাল বুনবেন। এটিই ইতিহাসের চলমান ও স্বাভাবিক গতিধারা।
আগামী পর্বে মিরজাফর চরিতনামার ইতিটানা হবে। চোখ রাখুন- গোপালপুর বার্তায়।
প্রতিবেদক : সম্পাদক, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম, গোপালপুর সংবাদদাতা, দৈনিক ইত্তেফাক এবং সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ, মধুপুর কলেজ, টাঙ্গাইল।
তথ্য সূত্র : * তারিখ-ই-বঙ্গালা – মুন্সি সলিমুললাহ * মোজাফফরনামা – করম আলী খান * সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন – সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাবতবায়ি * রিয়াজ-উস-সালাতিন – গোলাম হোসেন সলিম * তারিখ-ই-মনসুরি- সাইদ আলী * সিরাজদ্দৌলা – অক্ষয় কুমার মৈত্র * মুর্শিদাবাদ কাহিনী – নিখিলনাথ রায় * পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ – ড. রজতকান্ত রায় * ইন্দোস্তান – রবার্ট ওরোমি * ডিসাইসিভ ব্যাটলস অব ইন্ডিয়া – কর্ণেল মেলিসন * মেমোয়েরস অব মঁসিয় লা * নবাবী অন্দর মহল – কল্পনা ভৌমিক * নবাব ও নবাবী – ফজলুল হক।