আজ || রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


গণগ্রেফতার কোন সমাধান নয়

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার :

ak

“বিরোধীদের গণগ্রেফতারে উদ্বেগ, পাঁচ দিনে আটক পাঁচ হাজার”-সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল এটি। আজকাল চরম অনিশ্চয়তা চারদিকে, তাই শহর ও নগরের অধিকাংশ মানুষ সর্বশেষ সংবাদ জেনেই বাসা থেকে বের হন বলেই ধারণা করি। সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নেই বলেই সর্বদা দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কেননা, গত দু’সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী আবারও গণগ্রেফতার শুরু হয়েছে। এতে ২০ দলীয় পাঁচ হাজারের অধিক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গ্রেফতারের সংবাদ প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি দুই বিদেশি, প্রকাশক ও পুলিশ হত্যা এবং তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা ও আসন্ন পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সন্দেহজনকভাবে এই গণগ্রেফতার অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে সবাই যে সেসব কারণেই গ্রেফতার হচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। কেননা, এাঁ সব সময়ই দেখা গেছে যে, এমন গণগ্রেফতারের সুযোগ পেলেই পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য যাকে তাকে গেফতার করে অনৈতিক বাণিজ্যে নেমে পড়ে। ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ সর্বদাই কোন না কোন ভাবে গ্রেফতার করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এছাড়া বিরোধী দলের প্রতি শাসকশ্রেণির নেতিবাচক মনোভাবের কথা তো জানাই আছে। আর পুলিশ সদস্যরা তো  উপরের নির্দেশ মানতে বাধ্য।

অন্যদিকে দেশের প্রতিটি কারাগারেই ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি রয়েছে। এসব বন্দিদের মধ্যে অধিকাংশ হলো রাজনৈতিক মামলার আসামি। কারা মহাপরিদর্শকের হিসেব অনুযায়ী সারাদেশে মোট বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৩৪ হাজার ৬৮১ জন। বন্দির সংখ্যা ৭১ হাজারের অধিক, যা দ্বিগুণেরও বেশি। (ইনকিলাব, ৯ অক্টোবর,’১৫)। তবে গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী সে সংখ্যাটি প্রায় লক্ষাধীক। অতিরিক্ত বন্দির কারণে সবারই থাকা খাওয়ার সমস্যা হচ্ছে। অধিকাংশ বন্দি দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়লেও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা। তবে টাকা থাকলে সেখানে মিলে হাসপাতালে থাকার সুবিধাসহ মাদক গ্রহণের সুযোগও। সেই অনিয়মটিও সেখানে নিয়মের অংশ। কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও গোসলের সুযোগ পাওয়া যায় না। কারাগারের পরিভাষায় ‘ইলিশ কাতে’ অনেক কষ্ট করে এক জনের স্থানে  পাঁচ জনকে থাকতে হচ্ছে। যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। নির্ঘুম থাকতে হয়।  কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসা মেলে না। বারান্দা, বড় সেলের বারান্দা, গোডাউন, এমনকি যেসব সেলের বাথরুমগুলো বড় সেগুলোকে সেল বানিয়ে বন্দি রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। (মানবজমিন, ১৮ জানুয়ারি, ’১৫)। খাদ্য, চিকিৎসা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সংকট বেড়েই চলছে। এছাড়া মশার উপদ্রব তো দীর্ঘ দিনের সমস্যা। ফলে কারাগারে মানবিক বিপর্যয়ের অবস্থা দীর্ঘ হচ্ছে। স্বজনরা বাহির থেকে চাহিদা মাফিক টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে কেউ কেউ হয়তো একটু ভাল থাকতে পারেন। কারাগার কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় অস্বিকার করলেও ভূক্তভোগিরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন, তবুও নেই তার প্রতিকার।

 

এত কিছু জেনেও রাজনৈতিক চিন্তায় গ্রেফতার অভিযান অব্যহত রয়েছে। গোটা দেশের ১৩টি কেন্দ্রিয় কারাগারসহ ছোট-বড় ৬৮টি কারাগারের সর্বত্রই একই অবস্থা। যেভাবে গ্রেফতার করার প্রতিযোগীতা চলছে তা অব্যাহত থাকলে কারাগারগুলোতে অতিরিক্ত বন্দিজনিত কারণে বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। কারাগারে বন্দি আটকের দিকে থেকে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করা হচ্ছে। ওয়াসিংটন পোস্ট পত্রিকার সূত্র মতে, ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী ডিগ্রি দেয় এমন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৯৯টি। অন্যদিকে মোট কারাগারের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। এককথায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কারাগার বেশি। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, বন্দির সংখ্যার হিসেবে  যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে এক নম্বর। (প্রথম আলো, ৮জানুয়ারি,’১৫)। তেমনিভাবে কোন কোন অযুহাতে বিরোধী দলকে দমনের জন্য গ্রেতার অভিযান চালানো হচ্ছে। বাসা, বাড়ি, মসজিদ, মাদ্রসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবখানেই যেন গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে ইদানিং অতি মাত্রায় মাহফিল থেকে বক্তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গত ৩০ অক্টোবর মাহফিল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাদ্দিস আমিরুল ইসলাম বেলালীকে গ্রেফতার করাই যার নিকটতম উদাহরণ। এভাবে অসংখ্য নাগরিক বিনা অপরাধে দিনের পর দিন কারাবরণ করছেন বলেও সংবাদ পাওয়া গেছে। বাসা, বাড়ি, মেস কিংবা মাদ্রাসা, মসজিদে ইসলামি সাহিত্য থাকলেই সন্দেহ করা হয় এরা জামায়াত-শিবিরের লোক। এছাড়া মসজিদে নিয়মিত জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করলে, পরিহীত প্যান্ট টাখনুর উপরে থাকলে, নামাজের আগে বা পড়ে মসজিদের সামনে কারও অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকলে, ধূমপান না করলে, বই-পত্র সাথে বহন করলে জামায়াত শিবির সন্দেহে গ্রেফতার করায় নাগরিকদের  স্বাভাবিক চলাফেরা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

 

আবার অন্যায়ভাবে যারা গ্রফতার তারা উচ্চ আদালতের জামিনের নির্দেশ পেলেও তাদের অনেকেই আবার কাগারের বাইরের ফটক থেকে পূণরায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। আরও অভিযোগ আচে যে, জামিনে বেড়িয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কারাগারের ভেতর থেকে বন্দির বাড়িতে মোবাইলে যোগাযোগ করার সুযোগ দিয়ে বন্দির মাধ্যমে চাহিদা মাফিক টাকা চাওয়া হয়। বন্দি সেই টাকা দিতে অপারগ হলে আসামী যেই থানা থেকে গ্রেফতার হয়েছিল সেই থানায় পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানেও আবার মুিক্তর জন্য টাকা দাবির ঘটনা ঘটে। তখন কেউ টাকা না দিলে কিংবা দিতে অপারগ হলে অথবা স্থানীয় সরকার দলীয় নেতাদের নির্দেশে তাকে নতুন কোন সাজানো মামলায় গ্রেফতার দেখিযে  পূণরায় কোর্টে চালান দেয়া হয়।

 

এ দেশটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র হলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে পদে-পদে খর্ব করা হচ্ছে। লিখিত আইনের বাস্তবায়ন না থাকলেও শাসক শ্রেণির অলিখিত আইন এমনভাবে কার্যকর করা হচ্ছে যা বলা ও লেখা খুবই বিপজ্জনক। রাষ্ট্র শক্তির কাছে একজন নাগরিকের শক্তি খুবই নগন্য, অথচ সেই নাগরিকের সামান্য কথা ও লিখনিকে সহ্য করবার ক্ষমতা ও ধৈর্য সরকারের নেই। কিন্তু কেন?

 

কারাগারে বন্দি ধারণ ক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি হলেও থেমে নেই গণগ্রেফতার। কেরানীগঞ্জের ১৯৪ দশমিক ৪১ একর জায়গার ওপর নির্মিত কারাগারটি নভেম্বরেই উদ্বোধন করা হবে। এই কারাগারে ৫ হাজার পুরুষ ও ২০০ নারী বন্দির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। যা এশিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার দিল্লির ‘তেহার জেল’ এর ধারণ ক্ষমতার সমান। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এশিয়ার সর্ববৃহৎ কারাগারটি আসন্ন নির্বাচনের আগে চালু হলে ধরপাকড়ের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার তথ্য মতে, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজারের অধিক বন্দি অবস্থান করছেন। ইতোমধ্যে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৮০ হাজার এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ২১ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামী হয়েছেন কয়েক লাখ। জিহাদী বই, বিস্ফোরক, দেশীয় অস্ত্র, আগ্নেয়াস্্র সহ গ্রেফতারের নাটকের শেষ কোথায় তা জানা নেই। ছাত্রদল-বিএনপি কিংবা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সর্বদাই নাকি গোপন বৈঠক ও নাশকতার পরিকল্পনা করে থাকেন।  আর গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতায় মুহূর্তেই পুলিশ তা গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারে। এজন্য সাধুবাদ জানাই তাদেরকে। পুলিশ ও বিদেশি নাগরিকের হত্যাসহ দেশের মধ্যে পরপর কয়েকটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পালিয়ে গেল অথচ মূল আসামীরা ধরা পড়লনা কিংবা ওইসব সদস্যদের গোপন বৈঠকের কথা পুলিশ জানলনা এটা কি কওে সম্ভব? আর নাশকতা করার পরিকপনা করে ২০ দল কিংবা জামায়াত-শিবির অথচ অস্ত্রসহ ছবি ছাপা হয় সরকার সমর্থীত বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। এটিই সত্যিই উদ্বেগজনক।

 

কাউকে উস্কে দেয়া ঠিক নয়। সে চাই নাগরিক বা পুলিশ হোক। দীর্ঘদিন থেকে পুলিশের একাংশ বেপরোয়া। তদুপুরি, ‘প্রয়োজনে গুলি করতে পিছপা হওয়া যাবে না, এর জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই।’ এমন নির্দেশনা দেশের পরিস্থিতি আরো অবণতি হচ্ছে। পিরোজপুরে পুলিশ কনস্টেবল নিখোঁজ।(মানবজমিন, ১১ নভেম্বও’১৫) এবং  চেকপোস্টে মিলিটারি পুলিশের ওপর হামলা (সমকাল,১১ নভেম্বর, ’১৫)। আমরা মনে করি, গ্রেফতার, যুলুম, নির্যাতন, গুম, ক্রস ফায়ার ইত্যাদি অব্যহত রেখে গণতন্ত্র কায়েম করার স্বপ্ন দেখা নিরর্থক। শাসক শ্রেণির মনে রাখা দরকার অত্যাচারের ফল ভালো হয় না।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’(অনুচ্ছেদ ২৭),  চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৯) বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও সাধারণ নাগরিকরা সে সুবিধা পাচ্ছে না। এই গণগ্রেফতারের শেষ কোথায়? অনেকেই মনে করেন পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী পক্ষকে দুর্বল করতেই পরিকল্পনামাফিক ২০দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তার সত্যতা পাওয়া যায় গণেেগ্রফতার বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু এবং নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করতে দেশব্যাপী ধরপাকড় চলছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘গণগ্রেফতার হচ্ছে না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যারা দেশে বোমাবাজি করে ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী করতে চায় তাদের আমরা ধরে থাকি।’ গ্রেফতার করা আমাদের রুটিন মাফিক কার্যক্রম বলা হলেও অনুসন্ধানের বিষয় সে রুটিন কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে করেছেন? অপরাধী সনাক্ত করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন ভবিষ্যৎবাণী করা হয় তখন গ্রেফতার সংখ্যা বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

 

ইতোমধ্যে গণগ্রেফতার বন্ধে সরকারের প্রতি আহবান জানয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা-হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। তাদের এই আহব্বানকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তাছাড়া কেউ কারো প্রতি যুলুম করলে তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এটাও বিবেচনায় রাখা কর্তব্য সকল পক্ষেরই।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!