আজ || মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
শিরোনাম :
  গোপালপুরে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালিত       গোপালপুরে ছাগল পালনে স্বাবলম্বী শিল্পী রাণী এবং আন্না বেগম       গোপালপুরের ঝাওয়াইলে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ       গোপালপুরে দিনব্যাপী হাজী সম্মেলন অনুষ্ঠিত       গোপালপুরে বারেক মেম্বারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন       গোপালপুরে বিদ্যুৎপৃষ্টে স্কুল ছাত্রের মৃত্যু       গোপালপুরে ওয়ার্ডমাস্টার প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদান       গোপালপুরে সরকারি জমি দখল নিতে দুই পক্ষের উত্তেজনা, সড়ক অবরোধ       গোপালপুরে নূরানী মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত       দেড় যুগ পরে গোপালপুরে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সমাবেশ    
 


রাজা যায়, রাজ্যের মানচিত্রও বদলায়, টিকে থাকে মোসাহেব, চাটুকার ও চামচা

::: জয়নাল আবেদীন :::
রাজা যায়। রাজ্যের মানচিত্রও বদলায়। কিন্তু রাজনীতি চলমান থাকে। সেই চলমান রাজনীতির সিড়ির একপ্রান্ত দিয়ে এক রাজা নামেন। আর অন্য প্রান্ত বেয়ে আরেকজন গিয়ে রাজ সিংহাসনে বসেন। এই যে রাজসিংহাসনে আরোহণ বা প্রস্থান সেটিই রাজ ইতিহাস। সেই রাজ ইতিহাসে প্রজাদের কথা কমই থাকে। রাজা, রাজ্য, রাজতন্ত্র, রাজপ্রাসাদ, রাজ্যপাট, রাজক্ষমতা এ ছয় বিষয় সেখানে মুখ্য। আর যে কূটচালের মাধ্যমে এসব চলে সেটির নাম রাজনীতি।

রাজার যুগ সেই কবে চলে গেছে। তবু রাজত্ব, রাজভান্ডার, রাজভোগ, রাজ কর্মচারি, রাজনীতি টিকে আছে। রাজসিংহাসন বদলে গদি। রাজ্য বদলে রাষ্ট্র, রাজপ্রাসাদ বদলে রাষ্ট্রীয় ভবন। রাজভান্ডার বদলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। রাজভোগ বদলে রাষ্ট্রীয় ভোজ। রাজকর্মচারি বদলে রাষ্ট্রীয় কর্মচারি হয়েছে। কিন্তু ‘রাজার নীতি রাজনীতি’ এখনো সেটি টিকে আছে। তবে ভিন্ন নামে ভিন্ন খোলসে।

রাজসিংহাসন দখলের জন্য আগেকার দিনে রাজপুরুষরা যেমন রাজ্যময় যুদ্ধ করে বেড়াতেন, প্রজার ফসল, বাড়িঘর, উদ্যান, নগর, বন্দর, জনপদ তছনছ করতেন, তেমনি এ যুগের রাজপুরুষরাও গদির লড়াইয়ে ষড়যন্ত্র, গুমখুন, হরতাল, অবরোধ, বাস, ট্রেন, ট্রাকে অগ্নিসংযোগ, গ্রেনেড বা বোমা হামলা অথবা বালির ট্রাক দিয়ে রাস্তা অবরোধ করা হয়।

আগের দিনে রাজারা রাজভান্ডারের অর্থসম্পদ খেয়াল খুশিতে ব্যয় করতেন। কারণ রাজারা ছিলেন রাজভান্ডারের একচ্ছত্র মালিক। রাজা, রাণী, রাজপুত্র বা রাজকণ্যারা প্রজা কল্যাণের নামে যদৃচ্ছা অর্থ ব্যয় করতেন। এ যুগেও রাজভান্ডার বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটের সুযোগ থাকে। এখনকার রাজভান্ডার লোটা হয় উন্নয়নের নামে। ব্যংক ঋণ, পুঁজি বাজার অথবা বিদেশী আমদানীর নামে। রাষ্ট্রীয় সিন্ডিকেট তেলেসমাতি করে এ কাজ করে থাকেন। আগের রাজপুরুষরা রাজভান্ডারের অর্থে দেশেই শীত বা গ্রীস্মাবাস অথবা রাজপ্রাসাদ বানাতেন। আর এ কালের লুটেরা সিন্ডিকেটরা বা রাজপুরুষরা বিদেশে রাজবাড়ি বানান। সেই যুগে রাজললনাদের প্রাসাদ ছিল জেনানামহল। আর এখনকার লুটেরাদের রাজবাড়ী পরিচিত বেগম পাড়া নামে।

আজ রাজারা নেই। তবে মন্ত্রী আছেন। উজিররা নেই এমপিরা  রয়েছেন। নাজিররা নেই আমলারা আছেন। দারোগা ই ডাকচৌকি নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। ভাঁড়রা নেই কিন্তু মোসাহেব, তাবেদার, চাটুকার বা চামচারা রয়েছেন।

রাজার পর সম্রাট এসেছে, সম্রাটের পর সুলতান, নবাবরা এসেছেন। নবাবের পর শ্বেতাঙ্গ গভর্নররা এসেছেন। ফলে সাত দশক আগেই শ্বেতাঙ্গ বা সামন্তযুগ শেষ হয়ে আধাসামন্তে আমরা প্রবেশ করি। আর কালক্রমে রাজ্যের পরিচয়  হতে থাকে বঙ্গ, সুবে বাঙ্গালা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, যুক্ত বাংলা, পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ।

কিন্তু বাংলাদেশের সৃষ্টি একাত্তরের সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবের পর আধা সামন্তযুগের সেই ঘুণে ধরা সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি পাল্টাতে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব অপরিহার্য ছিল সেটি অসমাপ্তই থেকে যায়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক জাগরণ ও বিপ্লব এখন অসম্ভবই বলা যায়। মুক্ত চিন্তা, প্রগতিশীল ভাবনা, বিজ্ঞান নির্ভরতা খাঁচায় বন্দী। তাই সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এক পক্ষ লুটেরা সংস্কৃতিতে প্যাকেটজাত করছে। আরেক পক্ষ শুধূ মাত্র ধর্মীয় নীতি আদর্শ দ্বারা সব কিছু পরিচালিত করার দৃষ্টিভঙ্গি বাড়াচ্ছে। ফলে গণতন্ত্র ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। সরকার বা বিরোধী দল গণতন্ত্র নয় শুধু ক্ষমতা আর ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করছে।

আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংঘবদ্ধ লুটেরা, ধর্মব্যবসায়ী এবং বাজিকররা পলিটিক্সের জমিন একে একে দখল করে নিচ্ছে। তারা রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রশাসনে মোসাহেব, চামচা, তোষামোদকারি ও ধর্মীয় উগ্র সমর্থক তৈরি করছেন। যিনি যতো বড়, ততো বেশি তার মোসাহেব ও চামচা। তাই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা এখন না আধা পুঁজিবাদ বা আধা সামন্তবাদ। বলা যায় খিচুড়িবাদ, তোষামোদীবাদ ও সুবিধাবাদে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে। এ সুযোগে বিশেষ গোষ্ঠি কখনোসখনো দেশকে বিরাজনীতিকরণে ঠেলে দেয়। এ জন্য দেশে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে জলপাইরা যখন অসৎ নেতা, লুটেরা আমলা, ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগতকারিদের কোমড়ে দড়ি বেঁধে আদালতে বা নিরাপদ হেফাজতে নেন তখন প্রজারা পুলকিত হয়।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় ভাঁড়, চামচা, মোসাহেবদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। টিআর, কাবিটা, দুঃস্থদের রিলিফ, ফেয়ার প্রাইজের  চাল, অনুদানের ডাল, ন্যায্য মূল্যের সার, দুস্প্রাপ্য বীজ, আমদানী করা সয়াবীন, প্যাকেটজাত চিনি, গরীবের আটা পাচার করেন মোসাহেব, তোষামোদকারি ও চামচারা।

রাজনীতিতে পুরনোরা যায় নতুনরা আসে। চামচার তোষামোদিতে নেতারা ভাবেন তিনারা দৃশ্যপট থেকে সরে গেলে সব অর্জন নষ্ট হবে। সব সাফল্য ম্লান হবে। সভা, সেমিনার ও গণসমাবেশে নেতারা দাবি করেন তারাই শুধু দেশপ্রেমিক। চাল চোর, ডালচোর, গম চোর, রিলিফ চোর, ঘুষখোররাও যখন মঞ্চে নেতাকে ঘিরে শ্লোগাণ ধরেন, ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে‘ তখন আমপাবলিকই নয় রেসের অশ্বরাও হ্রেষারব করে।

তোষামোদকারিদের তেলবাজিতে নিজ দলের মধ্যে নেতারা ক্রমাগত দ্বন্ধ তৈরি করেন। সেখানে নীতি আদর্শের বালাই থাকেনা। লক্ষ শুধু ক্ষমতা আর লালসা। তাই দলের কর্মীরা দলের নেতা কর্মীদের হাতে খুন হলেও সেটির বিচার কাজ সহজে শেষ হয়না। আর দলের মধ্যে যতো খুন, যতো মারামারি চামচামির ততো সুযোগ। ততো লাভ। ততো বিস্তৃতি।

ফারসী চামচহ থেকে চামচা শব্দের উৎপত্তি। রান্নাঘরে বা শেলফে বড় চামচের চেয়ে ছোট চামচ বেশি থাকে। বড় চামচ নেতা, আর ছোট চামচ সাগরেদ। বড় নেতার আশপাশে ঘুর ঘুর করে ছোটরা প্রভূ বন্দনায় ব্যস্ত থাকে। এ খুচরারাই হলো চামচা।

চামচা বা তোষামোদকারির একটি গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। মিশরের ফাতেমীয় খলিফা আল হাকাম (৯৯৬-১০২৩খৃঃ) খুব স্তুতি পছন্দ করতেন। স্তুতিকারিরা কালক্রমে এতো প্রভাব বিস্তার করেন যে, আমীরুল মোমেনীন খলিফা হাকাম একদিন রাজাজ্ঞা জারী করেন যে, দিনের বেলা সবাইকে নিদ্রামগ্ন থাকতে হবে এবং নিশিতে হাটবাজার, বেচাকেনা, অফিসআদালতসহ সকল কাজকর্ম সম্পাদন করতে হবে। তিনি অমুসলিমদের বিশেষ পোষাক নির্ধারণ এবং হযরত মাবিয়া এবং হযরত আয়েশার পছন্দের সালাদ ও খাবার মিশরে নিষিদ্ধ করেন।
তোষামোদকারিরা খলিফাকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, খলিফা সাধারণ মানুষ নন। তিনি বিশুদ্ধ আত্মার অধিকারি এবং নানা ঐশী গুণে গুণান্বিত। স্তাবকদের প্রশংসনায় সত্যিই, ভাবতে থাকেন তিনি একজন ঐশী পুরুষ। আসামন থেকে আসা বিশেষ অবতার। এক রাতে ঐশী জ্ঞাণ পূর্ণের জন্য তিনি মুত্তাকিম পাহাড়ে যান। সেখান থেকেই রহস্যজনকভাবে তিনি চিরতরে নিখোঁজ হন। খলিফার নিখোঁজের খবর ধর্মীয় মোড়কে প্রচারপ্রচারনা চলে। বলা হয় যে, স্বর্গীয় অবতার হাকাম ঐশী গুণে আসমানে গেছেন। তাকে ধমার্বতার ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, জীবিত হাকামের চেয়ে স্বর্গীয় হাকাম অনেক বেশি শক্তিশালী। দিনে দিনে তার অনুসারী বাড়তে থাকে। খলিফা হাকামের অনুসারীরা এখন দ্রুজ মুসলিম নামে পরিচিত। প্যালেস্টাইন ও লেবাননে এখনো প্রায় ৫০ লক্ষ দ্রুজ মুসলিম তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করেন। সুতরাং চামচা বা তোষামোদকারিদের থেকে সাবধান।

প্রবন্ধকার :
অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, গোপালপুর প্রেসক্লাব ও উত্তর টাঙ্গাইল সাংবাদিক ফোরোমের সভাপতি এবং দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!