অধ্যাপক ড. শেখ জিনাত আলী
সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তৎকালীন হিজরি সালকে পরিবর্তন করে সৌর বছর হিসেবে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এখানে উল্লেখ করতে হয় হিজরি হচ্ছে মুসলমালেন চাঁদ্র মাস, অথচ ফসল তোলার মাস হিসেবে সৌরবছর প্রবর্তন করা ছাড়া উপায় ছিল না সসষ্ট আকবরের। মনে রাখতে হবে কৃষকরা সে সময় ফসলে খাজনা পরিশোধ করতেন। বঙ্গাব্দের প্রচলন এভাবে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী বাঙলা ও বাঙালির সংস্কৃতিতে পরিবর্তনে নতুন মাত্রা সংযোজিত করে। কৃষক শব্দটিতে একটি অসাম্প্রদায়িক যোজনা রয়েছে। কৃষক সকল ধর্ম সম্প্রদায় নৃতত্ব নির্বিশেষে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাভাষায় একটি শব্দ হিসেবে নয় শুধু, কেন না এই কৃষক থেকেই বাংলার কৃষি-সংস্কৃতির জন্ম, যা স¤œয়ধর্মী। মজার ব্যাপার হলো বঙ্গাব্দের মাস ও দিনগুলো গ্রহ-নক্ষত্রর নামানুরে হয়েছে। যেমন বিশেখার না থেকে বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ কেন সকল মানুষকে একত্র করে , কেমন করে তার মুলটা এখানে নিহিত। সার্বজনিনতা এজন্য এর প্রাপ্য।
সার্বজনিনতা পৃথিবীর কোন দেশে এককভাবে পাওয়া যায় না, দেখা যায় না। আসলে বাস্তবেও তা নেই। এ ধরণের সার্বজনিন আচার অনুষ্ঠান তথা পহেলা বৈশাখ উদযাপন কোন কাকতালীয় বিষয় অবশ্য নয়। এ কারণে বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকরা সহ সকল বিদেশী শাসকরা একে ভয় পেত। পাকিস্তান তো কথায় কথায় তাদের শাসণমলে পহেলা বৈশাখ রবীন্দ্রনাথকে চর্চা করা ভয় পেতনা শুধু না, রীতিমত নিষিদ্ধ করে রেখেছিল এবং পূর্ববাংলার মুসলমানদের চোখে ধর্মের নামে ঠুলি পড়িয়ে রাখার হেন প্রচেষ্টা নেই যা অবলম্বন করে নি। পাকিস্তানি শাসকরা দ্বি-জাতিতত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রথম বাধা পায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, যে আন্দোলনে ১৯৫২ তে বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত ঝড়ায় ঢাকার রাজপথে। বাঙালি জাতীয়তার প্রশ্নে বাংলার অকোতভয় সন্তানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঙালিত্বের সূচনা ঘটায়, যদিও রাষ্ট্র ভাষার দাবি ১৯৪৮র ১১ মার্চ প্রথম উত্থাপিত হয়। এর পর অনেক রক্ত, অনেক সংগ্রাম। অবশেষে ১৯৭১র সশস্ত্র মৃক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তথা বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পৃথিবীর এই অঞ্চলের এক অনবদ্য অর্জন। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে যেমন রইলো না আর কোন বাধা তেমনি বাঙালির সার্বিক বিকাশ দ্বার খুলে গেল এক অনাবিল সুন্দরের পথে। না, এই অবস্থা বেশি দিন রইলো না বাঙালির ও অপরাপর ক্ষুদ্র পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষগুলোর জন্য। সাড়ে তিন বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তি তার কালো হাত আবার আমাদের সব অর্জন কেড়ে নিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমোনকে সবংশ হত্যার মধ্যদিয়ে। আবার অপশক্তি আমাদের কাঁধে চড়ে বসলো, আর আমাদের মুক্তির আকাঙ্খা তিরোহিত হলো যেমন।
কিন্তু না, ২০০৮ খ্রীস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে না না সীমাবদ্দতার বোঝা ও ২৬ বছরের সৃষ্ট জঞ্জাল কাঁধে নিয়ে। গত তিন মাসে ৫ জানুয়ারির পর যে পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে শতাধিক গরিব লোককে ও হাজারের অধিক গাড়ী-যান বাহন ধ্বংস করা হলো সে হোলিখেলা আপাতত বন্ধ হলো সরকারের সীমাবদ্ধ প্রচেষ্টাও জনগণের সাহসী প্রতিরোধের ফলে। তাই এ বারের পহেলা বৈশাখ উদঘাপন সার্বজনিনতায় আবার ভরে উঠলো। এই সার্বজনিন আনন্দ মেলা যেন থাকে অটুন্ট আগামী দিনগুলোতেও সেই কামনা করি দেশের সকল ধর্ম, বর্ণ, নৃ-গোষ্ঠী জনগণের কাছে, বিশেষত নবপ্রজন্মের প্রত্যেকটি সদস্যের প্রতিরইলো আমার অকৃত্রিম প্রত্যাশা। এসো হে বৈশাখ এসো, এসো—। অশুভ শক্তিকে পরাভূত করতেই হবে আমাদের।