-সন্তোষ কুমার দত্ত
‘৭১ আমাদের স্বাধীনতার বছর, ডিসেম্বর বিজয়ের মাস আর মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস।’ বাঙালির হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মীদের অবদান রয়েছে। তবে চূড়ান্ত বিজয়টি অর্জিত হয়েছে একাত্তরের শেখ মুজিবের অলৌকিক নেতৃত্বে। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব আসলেই ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। কোন কোন রাজনৈতিক গবেষক ও ইতিহাসবিদের মতে প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণেই পাকিস্তান ভেঙে যায়। সত্তর’র নির্বাচনে পূর্ব বাংলার প্রায় শতভাগ মানুষ মুজিবের দলকে ভোট দেয়। যা বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। অসহযোগ আন্দোলনের ২৫ দিন দেশের সামরিক সরকার বহাল থাকা অবস্থায় পূর্ব বাংলা মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হয়। মূলত ১ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ ঐ ২৬ দিনেই বাংলাদেশ এক স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দ্বারা গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয় মাস শত্রুর দ্বারা বন্দি থাকা সত্ত্বেও এই কালজয়ী নেতার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্বের দ্বিতীয় কোন নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি ? বিরোধী দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭১’ এর ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে। একজন বিরোধী নেতার প্রায় এক মাস এভাবে দেশ শাসন করার কোন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতার মহানায়ক হচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেন তিনি। বাংলা ও বাংলার মানুষের সৌভাগ্য তারা শেখ মুজিবের মত অসাধারণ গুণসম্পন্ন একজন নেতা পেয়েছিল। সাহসে-সততায়, শৌর্যে-বীর্যে, দুরদর্শিতা-যোগত্য, কৌশলে-দেশপ্রেমে যার কোন তুলনা হয় না। শেখ মুজিব ছিলেন একজন দূরদর্শি রাজনীতিবিদ। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত শাসনের দাবীতে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ দফা দাবী জাতির সামনে পেশ করেন। মাত্র কয়েক মাসেই ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে এ সময় গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানীরা ৬ দফা না মানলে তা এক দফায় পরিণত হবে। শেষ পর্যন্ত একাত্তর সালে তাই হয়।
১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ১ নম্বর আসামী করা হয় শেখ মুজিবরকে। ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনে মুজিবসহ রাজবন্দীরা মুক্তি পায়। এরই মধ্যে মুজিবের ৬ দফা বাঙালির বাঁচার দাবীতে পরিণত হয়ে যায়। তথাকথিত লৌহ মানব আইয়ুব খান গদি টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে লাহোরের রাজনীতিবিদদের গোলটেবিলে বৈঠকে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানায়। গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে মুজিব বাঙালির দাবী দাওয়ার প্রশ্নে অটল থাকেন। শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আইয়ুব-মোনায়েম চক্র তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর আসামী করেছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ক্ষমতায় টিকে থাকতে সেই আইয়ুব খানকেই মুজিবের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। গভর্ণর মোনায়েম খান গর্ব করে ঘোষণা করেছিল আমি যতদিন গভর্ণর থাকব শেখ মুজিবকে ততদিন জেলেই থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব-মোনায়েমকে পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। আর আপোষহীন শেখ মুজিব বাংলার মুকুটহীন রাজায় পরিণত হন। শেখ মুজিব কোনদিনই বাংলা ও বাঙালির দাবীর প্রশ্নে আপোষ করেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবসময়ই জনগণের পাশে থেকেছে। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের সেলের পাশে কবর খোড়া হয়। সেই নয়মাস পাকিস্তানী চক্র মুজিবের মুখ দিয়ে একটি কথাও বের করতে পারেনি। মুজিবের এক কথা কোন কিছু বলতে হলে আমাকে আমার জনগণের কাছে যেতে হবে। ক্ষমতার পালাবদলে জেনারেল ইয়াহিয়া বিদায় নিল। প্রেসিডেন্ট পদ দখল করে জেড.এ ভূট্টো দ্বারস্থ হয় মুজিবের। বাংলার সঙ্গে কনফেডারেশনের জন্য ভূট্টোর কি আকুতি মিনতি। এদিকে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়ে গেছে তা বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়নি। পাকিস্তানি চক্র বঙ্গবন্ধুকে গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু ভূট্টোকে কোন প্রতিশ্রুতিই দেননি মুজিব। সেই আগের কথা মুজিবের ভূট্টোকে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন আমার জনগণ কি চায় আমার তা জানতে হবে। এভাবে দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, আপোষহীনতা এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের দাবীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকাই ছিল মুজিবের নেতৃত্বের বৈশিষ্ঠ্য। ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ দুবারই পাকিস্তানি শাসক ও শোষকচক্র সাজানো রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু শেখ মুজিব ক্ষমতা ও আপোষের পরিবর্তে ফাঁসির দঁড়িকেই বেছে নেয়। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই সামরিক চক্র গ্রেফতার করে। সামরিক বাহিনীর গাড়িতে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অকুতোভয় শেখ মুজিব জেলগেটে এক মুঠো মাটি কপালে ছুঁয়ে শুধু এই কামনা করেন এদেশেতে জন্ম আমার, এদেশেতেই যেন মৃত্যু হয়। একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কারাগারে মুজিবকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়। তখনো তিনি বলেন ফাঁসির পরে আমার লাশটা আমার বাংলায় পাঠিয়ে দিয়ো। যে মানুষ মরতে চায় তাকে কেউ মারতে পারে না। ১৯৭১’র ৭ মার্চ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন আমরা যখন মরতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। এভাবেই শেখ মুজিব মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন। ১৯৬৮ সালে জেলগেট থেকে গভীর রাতে সামরিক যানে ওঠার আগে মুজিব কি বলেছিলেন তার বর্ণনায় রয়েছে শেখ মুজিব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন বুঝলাম সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি। বঙ্গবন্ধু বিদায়ের পূর্বে কারাকক্ষের সঙ্গী আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- ‘ভাই, বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানি না কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে। হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাওয়ার সময় আপনাকে শুধু একটা কথা বলে গেলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে আমি কোনদিন বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, কোনদিন করবো না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইলো। এদেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতা আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য।’ এই ছিলেন শেখ মুজিব। স্বাধীন বাংলাদেশ হঠাৎ করে আকাশ থেকে পরেনি। মুজিব তার সমগ্র জীবন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে লালন করেছে। আর লক্ষ্য নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিয়েছেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু মুজিবই যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে দুয়েকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কোন দেশের মুক্তি সংগ্রাম একদিনে হয় না। ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। আর যে কেউ ইচ্ছা করলে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন না। স্বাধীনতা ঘোষণা করার এখতিয়ার থাকতে হয়। যে কোন একজন স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেই কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে না। ৭০’র নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষ ভোট দিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলার অধিকার একমাত্র শেখ মুজিবকেই দিয়েছিল। কাজেই একাত্তরে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র শেখ মুজিবকেই দিয়েছে অন্য কাউকে নয়। তাছাড়া কোন অপরিচিত ব্যক্তির কথায়, ডাকে বা আহবানে জনগণ জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় না। একাত্তরের ১৫ মার্চ বিখ্যাত টাইম সাময়িকী লিখেছিল আসন্ন বিভক্তি অর্থাৎ পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করার পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে শেখ মুজিব। একাত্তরের ২৭ মার্চ ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রথম পাতায় লেখা হয় শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ৭১’র ৫ এপ্রিল আমেরিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী নিউজ ইউ.কে প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছেপে বলা হয় ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। একইভাবে শেখ মুজিবকে রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামীদামী অসংখ্য পত্রিকা, ম্যাগাজিনে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ছাপানো হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের নামকরণও করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৯’র ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দীর স্মরণ সভায় শেখ মুজিব বলেন আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বেই ২৩ বছরের আন্দোলন, সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ২০০৪ সালে বিবিসির বিশ্বব্যাপি বাংলাভাষী শ্রোতা জরিপে বঙ্গবন্ধু মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসের ৪৪ বছর পূর্তিতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের প্রতি সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা, অভিনন্দন।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।