অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : আজ আপনাদের এমন একজন মহৎ নারীর সুকীর্তির বর্ণনা দেবো, যিনি তার কমিউনিটির মধ্যে সুপরিচিত ও আদৃত। তিনি হলেন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আাদিবাসি গারো অধ্যুষিত ইদিলপুর গ্রামের চিরকুমারি প্রতিভা সাংমা।
বলা অনাবশ্যক, বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত আদিবাসি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির অস্তিত্ব¡ দেখা যায়। এদের মধ্যে মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরা অন্যতম। সর্বশেষ তথ্যে তাদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দরুন অন্যাণ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির তুলনায় গারোদের জীবন ব্যবস্থা অনেকটা বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য। ওরা মান্দি নামেও পরিচিত। বৃহৎ পরিসরে বলতে গেলে ওরা মোঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠির মানুষ। আদি নিবাস ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। সম্ভবত সুলতানি আমলে গোষ্ঠি দ্বন্ধে ভীত গারোদের ক্ষুদ্র অংশ ব্রম্মপুত্র পার হয়ে মধুপুর বনাঞ্চলে প্রবেশ করে। পরে এখানেই থিতু হয় তারা।
গারো ভাষার নাম আচিক। লেখ্যরুপ নেই। মুখে মুখেই চলেছে পুরুষানুুক্রমে। ওরা পচানব্বই শতাংশই খৃস্টান। অবশিষ্টরা প্রকৃতি পূজারি বা সাংসারেক। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মিশনারী কার্যক্রমে গারোরা ধর্মান্তরিত হতে থাকে। বর্তমানে শিক্ষার হার ৯০ ভাগ। আচার-আচরণে সহজ সরল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা সম্পত্তির মালিক। অরণ্যানি সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠা গারো সমাজে দু’একজন সাহসী নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। যারা শত প্রতিকূলতা ঠেলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এদেরই একজন প্রতিভা সাংমা। যার সাতকাহণ বলার ইচ্ছে আমার।
আগেই বলেছি প্রতিভার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পাহাড়ি গ্রাম ইদিলপুরে। লালমাটির টিলা, নিচুু বাইদ, সারি সারি কাঁঠাল, আনারস আর লিচু বাগান নিয়ে গড়া জনপদ ইদিলপুর। কাকরাইদ থেকে যে সর্পিল রাস্তা গারো বাজার হয়ে সাগরদীঘি গিয়েছে তা ধরে দুই কিলো সামনে এগুলেই ইদিলপুর বাজার। বাজারে নেমে লাল মাটির রাস্তা ধরে এগুলেই গারো পাড়া। ইদিলপুর হাইস্কুল, খৃস্ট চার্চ, খৃস্ট অরফানেজ ও মিশনারী স্কুল পাড়ি দিয়ে ডানে দেড়শ গজ সামনে পেরুলে হাতের ডানে গাছগাছালিতে ছাওয়া নির্জন বাড়ি। মাটির দেয়ালে ঘেরা ছনে ছাওয়া দুটি ঘর। পরিচ্ছন্ন বাড়ির সামনে পিছনে আনারস বাগান। ফলফুলে সাজানো চকচকে আঙ্গিনা। দেখলেই দুদন্ড বসতে ইচ্ছে করে। এ বাড়ির যিনি কর্ত্রী তার নাম প্রতিভা সাংমা। বয়স ৮৬। জন্ম ১৯৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর। বাবা মৃত সনাতন মৃ। মাতা মৃত বংগবালা চাম্বুগং।
প্রতিভা দেখতে সুন্দরী ও পরিপাটি হওয়ায় সবার কাছেই ছিলেন আদরনীয়। কৈশোর স্মৃতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ঘন গজারি বনে ঢাকা ছিল গ্রাম। থাকতো চিতা বাঘ, বণ্যশূকর, মহিষ, ময়ূর, বন মুরগী, বানর-হনুমানসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। সন্ধ্যা হলেই বাঘের গর্জনে পাহাড়ি টিলা কেঁপে উঠতো। মা বংগবালা ছিলেন আদিবাসি সংস্কৃতির সমঝদার। মায়ের হাত ধরেই পড়ালেখা শুরু। ১৯৩৮ সালে ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি। হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা। ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন। ৫১ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট। উচ্চশিক্ষা গ্রহনের ইচ্ছা থাকলেও মায়ের নির্দেশে ১৯৫২ সালে প্রথমে ময়মনসিংহ শহরের হলিফ্যামিলি এবং পরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
মধুপুর বনাঞ্চলের গারো সমাজ সে সময় শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। নিজ সম্প্রদায়ের কথা ভেবে ১৯৬৫ সালে হালুয়াঘাটের সেন্টমেরি মিশনারী হাইস্কুলের চাকরি ইস্তফা দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। মিশনারীদের সৌজন্যে গড়ে উঠা ভুটিয়া প্রাইমারি স্কুলে বিনাবেতনে শিক্ষকতা নেন। ছিলেন আশপাশের দুটি মিশন স্কুলে অতিথি শিক্ষক। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও যাতে স্কুলে আসে এজন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে গারো মহিলাদের উব্দুদ্ধ করতেন। তার ভাষায়, ‘আমি অনেক গারো বাড়িতে গিয়েছি। মা-বোনদের বলেছি তোমরা জেগে উঠো, সন্তানদের স্কুলে পাঠাও। শিক্ষিত না হলে তোমাদের অভাব যাবেনা, নিজেরা টিকে থাকতে পারবেনা।’
তিনি গারো পল্লীতে মিশনারী স্কুল স্থাপনে হেডম্যান ও পাদ্রীদের সাথে বৈঠক করতেন। তার স্বপ্ন পরবর্তীতে সফল হয়। মধুপুর বনাঞ্চলে শতাধিক মিশনারীরা প্রাইমারি ও তিনটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়াও ২০টি সরকারি ও রেজিস্ট্রিপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন শত শত গারো শিশু পড়ালেখা করে। সত্তরের দশকে তার হাতে গড়া আদিবাসি নারী, যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নারী আন্দোলনে ভূমিকা রাখছে তারা হলেন জলছত্র কর্পোস খৃস্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মারিয়া চিরান, পীরগাছা মিশন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নীলিমা থিগিদি এবং গারো নারী সংগঠন আচিকমিচিক সোসাইটির প্রধান সুলেখা ম্রং।
মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরা খৃস্টান হওয়ার পর তরুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুরাগী হয়ে উঠে। নিজ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ভুলে অত্যাধুনিক হওয়ার চেষ্টা করে। তিনি তরুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে উপদেশ দেন, ‘তোমরা ধর্মীয়ভাবে খৃস্টান হলেও নৃতাত্বিকভাবে গারো। গারো পরিচয় সব সময় গর্বের। গারো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভুললে পথ হারাবে। শেকড়কে আকড়ে ধরো। তাহলেই সাফল্য ধরা দেবে।’ সভাসেমিনার বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে তিনি গারো সংস্কৃতি রক্ষায় উচ্চকিত হওয়ার আহবান জানান। সংস্কৃতি চর্চার প্রতি তার আগ্রহ দেখে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সরকার আদিবাসি কোটায় গার্লস গাইডের নেত্রী হিসাবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাঠিয়েছিলেন।
৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। একাত্তুরের মার্চে মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বে সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মধুপুর জঙ্গলে অবস্থান নিলে গারোরা নানাভাবে সহযোগিতা করেন। দেশে পুরো মাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিভা আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। জলছত্র খৃস্টদেহ ধর্মপল্লীর ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতেন। দেশের র্দুদিনে প্রতিভা গার্লস গাইডের প্রশিক্ষন কাজে লাগান। ধর্মপল্লীতে নার্স হিসাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন।
স্বাধীনতার পর শিক্ষকতায় ফিরে যান। ৭২ সালে মধুপুর গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। এখান থেকেই ৯১ সালে অবসর নেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলেও সমাজের দায়দায়িত্ব থেকে গুটিয়ে নেননি। মিশনারী স্কুলে গারো ছেলেরা দল বেঁধে ক্লাসে এলেও মেয়ের সংখ্যা ছিল কম। এমতাবস্থায় নারী শিক্ষার মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গারো সমাজপতি বা হেডম্যানদের বুঝাতে থাকেন। মিশনের ধর্মযাজকগন তাকে সমর্থন করেন। তিনি ইদিলপুর ও আশপাশের গারো গ্রামের মেয়েদের স্কুল গমনে উৎসাহিত করার জন্য এখনো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। এখনো ইদিলপুর গ্রামের প্রতিটি আদিবাসি পরিবারের শিশুদের লেখা পড়ার খোঁজখবর রাখেন। পাড়ার দরিদ্র ছেলেমেয়েদেও বিনা বেতনে পড়ান। পড়ালেখার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত হওয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমানে এ গ্রামে একটি মিশনারি স্কুল, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়, শিশু পল্লী ও শিক্ষায়তন এবং হাইস্কুল গড়ে উঠেছে। গ্রামের সব শিশুর সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ‘শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নাই’ এই শ্লোগান গারো কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এ বয়সেও প্রতিভা যথেষ্ট মানসিক শক্তির অধিকারি। চশমা ছাড়াই পড়াশুনা করেন। ভোরে উঠে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে গারো শিশুদের লেখাপড়ার খোঁজ নেন। ২০০১ সালে অগ্নিকান্ডে ১০ ভরি স্বর্ণালংকারসহ পারিবারিক পাঠাগার পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার কষ্ট ভুলে গেলেও মূল্যবান ও দু¯প্রাপ্য গ্রন্থের পাঠাগারটি বিনষ্টের কষ্ট ভুলতে পারেননি। সারা জীবন অন্যের ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের ঘর বাঁধা হয়নি। আজীবন কুমারীই রয়ে গেছেন। আদিবাসি সমাজেও কুমারী হয়ে জীবন কাটানো কঠিন। নিজে মা হতে না পারলেও দুঃখ নেই। গ্রামের সব শিশুরাই তার সন্তান। প্রতিভা জানান, নিকট আত্মীয়দের সকলকেই লেখাপড়া শিখিয়েছেন। নিজ খরচে বিয়েথা দিয়েছেন। সম্পত্তি বন্টন করে দিয়েছেন। বর্তমানে পালক পুত্র জেনেট মৃ, পুত্র বধূ এবং পাঁচ নাতিনাতনিকে নিয়ে সুখেই কাটছে দিন।
গারোরা এখন শিক্ষাদীক্ষায় বাঙ্গালীদের ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষায় গারো নারীদের সফলতা ঈর্ষণীয়। মধুপুরের গজারি বন ক্রমান্বয়ে উজাড় হওয়ায় বনবাসি গারোদের আবহমান সংস্কৃতি, জীবনজীবিকা ও আয়রোজগারে প্রভাব পড়েছে। বেশ কবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সত্বেও গারো জীবন থেমে থাকেনি। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এ ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠি টিকে আছে।
ইদিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক জানান, প্রতিভা দিদি গারো জনপদের শিক্ষার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। গারোরা এক সময়ে বুনো এবং নিম্ন জাতের বলে পরিগনিত হতো। কিন্তু প্রতিভার মত ত্যাগি নারী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে শিক্ষিাদীক্ষায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আচিকমিচিক সোসাইটির সভানেত্রী সুলেখা ম্রং জানান, দিদি অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে লেখাপড়া শিখেছেন। গারো সমাজকে শিক্ষিত করার জন্য নিজে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন। বেসরকারি সংস্থা কারিতাস ১৯৯৬ সালে এবং জয়েনশাহী আদিবাসি উন্নয়ন পরিষদ ২০০২ সালে তাকে সম্মাননা প্রদান করেন।
তিনি জানান, গারো শিশুরা নিজ ভাষায় পড়াশোনা করতে পারেনা। বর্ণমালা না থাকায় নিজস্ব শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রাত্যহিক প্রয়োজনে অনুভূতিকে লেখ্যরূপ দিতে পারেনা। একটি গারো শিশু বাড়িতে মাতৃ ভাষায় কথা বলে। স্কুলে সহপাঠিদের সাথে বাংলায়। আর পড়াশুনা করে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে। এভাবে তিন তিনটি ভাষায় পড়াশুনা করতে গিয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপ পড়ে। ফলে গারো শিশুরা পড়ালেখায় ভালো করতে পারেনা। এজন্য তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের হার কম। তিনি গারো শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃ ভাষায় চালুর দাবি জানান। প্রতিভা দিদিকে নিয়ে আমার এ লেখাটা অনেক লম্বা হলো। তার পরও ভালো লেগেছে কী আপনাদের?
প্রতিবেদক : দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, এডিটর, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এবং সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ, মধুপুর কলেজ, টাঙ্গাইল।