:: নয়ন আদিত্য ::
মাথার ভেতরটা শিরশির করছে। ঠান্ডা পানি চুলের গোড়া হয়ে যেন মগজ ধুয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটের কোনায় কেমন যেন তীব্র লবণাক্ত স্বাদ। এতগুলো অনুভূতি একবারে সক্রিয় হয় না বহুদিন। তবে এর আগে এমন কবে হয়েছিল? মনে করতে পারলে ভালো হতো। নাহ। চোখের পাতাগুলোও কেমন ভারী হয়ে আছে। কতক্ষণই তো হলো চোখ মেলতে পারছি না। আচ্ছা এটা কি ঘুম? কিন্তু ঘুমিয়ে ছিলাম কবে? বিছানাটাও পরিচিত না। এমন শক্ত? ঘাড় কোমর কেমন যেন ধরে আছে। এসব ভাবনার মধ্যে দিয়ে অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটেছিল কবে? নাহ মনে হচ্ছে স্বপ্নেই আছি। দীর্ঘ স্বপ্ন। বিজ্ঞান শাস্ত্র তো বলে মানুষের স্বপ্নের স্থায়িত্ব কয়েক সেকেন্ড। সেই কয়েক সেকেন্ড এত দীর্ঘ হয়? হয়। যেদিন প্রথম ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে ছিলাম, পিস্তল ঠেকিয়ে দুটি ছেলে সবকিছু নিয়ে গেল। মোবাইল, মানিব্যাগ, ঘড়ি, ল্যাপটপ… মনে হয়েছিল একজোড়া শুয়োর কুঁইকুঁই করতে করতে মাটি খুড়ছিল সময় নিয়ে। যদিও পরে বুঝতে পারি শুয়োর জোড়ার সময় লেগেছিল মাত্র এক জোড়া মিনিট।… এখন কি সেই মুহূর্ত! নাহ আমি তো শুয়েই আছি। এবার মনে হচ্ছে চুলের গোড়া দিয়ে পানি ঢুকতে ঢুকতে খুলির মধ্যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। কেমন যেন কলকল শব্দ হচ্ছে। শান্ত অথচ তীব্র স্রোতওয়ালা নদীতেই এমন শব্দ পাওয়া যায়। তাহলে কি আমি মাঝ নদীতে? কোনো নৌকায়? নাহ, নৌকায় ওঠা হয় না ১০ বছরের বেশি হবে। এই অসহ্য গরমের সময়ে শীত করছে কেন? নাহ শরীর তো ঘামে কাকভেজা! তাহলে কি আমি অসুস্থ? জ্বর! জ্বর হলো কবে থেকে। নাহ খুব বেশি সময় পার হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। রাত এখনো অনেক বাকি। ভোর ছয়টায় তো শারমিন ঘুম থেকে ওঠে। আমাকে ছবি পাঠায়। কল করে। তার কোনো লক্ষণই তো দেখি না। আর অসুস্থ হলে তো শারমিন অনবরত কল অথবা মিস কল দিতে থাকে। কই মোবাইল তো কোনো আওয়াজ করে না?
মনে পড়েছে। ছিনতাইয়ের আগেও এতগুলো অনুভূতি একবার সক্রিয় হয়েছিল। যেদিন শারমিনকে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম। সেদিনও শরীর ঘামে কাকভেজা হয়েছিল। তাহলে কি এতক্ষণ শারমিনের ঠোঁটের মধ্যেই ছিলাম। কই না তো? ঠোঁটের কোনায় শুধু মাত্র লবণের স্বাদ। তাও জমে থাকা লবণের। একি এতক্ষণ হাঁ করে ঘুমাচ্ছিলাম নাকি? কোথাও ভুল হচ্ছে। পুরো মুখের ভেতরেই এখন ঘন লবণ। বোটকা গন্ধ আর স্বাদ পেটের ভিতর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। শারমিনের কথা ভাবতে ইচ্ছা করছে। কোনো কিছুই মনে করতে পারছি না। চেহারটা অন্তত! শুধু কপালের কালো টিপটাই মনে পড়ছে।
এমন যন্ত্রণায় আগে পড়া হয়নি। মা বলত অসুস্থ হলে অনেক জানা জিনিস, কাছের মানুষের চেহারাও ভুল হয়। কিন্তু মা’র কথা, লম্বা—ধবধবে মহিলাটার চোহারা ঠিকই মনে করতে পারছি। তার মানে আমি অসুস্থ না। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে মদ খেয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। মহিলাটি কিচ্ছু না বলে খাবার বেড়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালে মা’র রাতজাগা কান্না ভেজা চেহারাটা! এই তো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে। তাহলে শারমিনকে কেন মনে করতে পারছি না? ওর হাত ধরে কখনো সমুদ্র বা নদীতে ভিজেছি? নাহ কিছুই মনে করতে পারছি না।
এইতো শারমিনের হাত। আমার পেট আমার বুক স্পর্শ করছে। শীতল হাত। বরাবরের মতোই। আমার শরীর ছুঁলেই নাকি রক্তের সঞ্চালন বাড়ে। কিন্তু এই অন্ধকার শক্ত বিছানায় সে কী করছে?
এরকম পরিবেশে তো আমাদের থাকবার কথা না। আমার জন্য বেবি খালার বাসায় অপেক্ষা করার কথা। রাতে একসাথে কোথাও খাবার কথা। আক্ষেপ করে বলেছিল, কতদিন বাইরে খাওয়া হয় না। আমি অফিস থেকে ফিরে ওকে নিয়ে বের হবার কথা। আমরা কি বের হয়েছিলাম? আমার বাইকটা কই? লোনের তিন কিস্তি এখনো বাকি। ওটা শেষ করতে পারলে ভালো একটা ফ্রিজ কিনবার কথা। বর্তমানটা থেকে নাকি মাথা ধরানো আওয়াজ বের হয়। যে দু-এক ঘণ্টার জন্য শারমিন আমার ডেরায় আসে তাতেই নাকি ওর মাথায় যন্ত্রণা হয়। হ্যাঁ এখন মনে পড়েছে, মনে পড়ছে শারমিনের চোখ, ঠোঁট, চুল, বুক সব। এগুলো তো আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত এলাকা। আমি ঘুরে বেরিয়েছি দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। কোথাও একটুও হোঁচট খেতে হয় না। চোখ বন্ধ করেও আমি চলতে পারি ওই পথে।
হ্যাঁ আমি তো গিয়েছিলাম বেবি খালার বাসায়। কিন্তু ওখানে কি শারমিন ছিল? আবার চিন্তাশক্তি ভোঁতা করে দিচ্ছে অনুভূতিগুলো। ঠান্ডা শিরশির, নদীর কলকল শব্দ আর তীব্র লোনা স্বাদ। বুকের লোমগুলো শক্ত করে টানছে কে? এটা তো শারমিনের হাত! ও এভাবে পাগলের মতো আচরণ করবে
কেন? ওর তো শাড়ি পরে তৈরি হয়ে থাকবার কথা। কিন্তু ওর সাথে কি আমার দেখা হয়নি?
এটা একটা ভালো কাজ হয়েছে, কানদুটো কাজ করা শুরু করেছে। অনেক আওয়াজ। মধুর আওয়াজ। হৈ চৈ। অনেক পাখি সমস্বরে শহুরে সকাল অথবা সন্ধ্যাকে স্বাগত জানাচ্ছে। না আবারো কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! এটা তো সাইরেন। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। অ্যাম্বুলেন্সের দুলুনি। এই দুলুনির
সঙ্গে আমি পরিচিত। সে-বার নানাকে নিয়েছিলাম হাসপাতালে। আমি কি তাহলে হাসপাতালে যাচ্ছি? হ্যাঁ, ওই তো শারমিন আমার পাশে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। ওর আবার কী হলো? এই বিষয়টাই খুব বিরক্ত লাগে। বেবি খালাও কাঁদছে। তোমরা কাঁদছ কেন? দেখো, সজীব কেমন শক্ত হয়ে বসে আছে। পুরুষরা যেভাবে শক্ত থাকে। ও নিশ্চই বুঝেছে আমার কিছুই হয়নি।
শারমিন আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। শুধু তোমাকে অন্যের বুকে দেখে একটু খারাপ লেগেছিল। তাই বাইক ঘুরিয়ে কোথায় যাব সেটা ঠিক করার আগেই সিগন্যালে আটকাতে হলো। কী যেন ব্যস্ততা নিয়ে আসা এক সফেদ কার আমাকে বাইকসহ টেনে নিয়ে যেতে চাইল। কোনো কথাই শুনতে চায়নি। বুঝতে চায়নি আমি এখন উদ্দেশ্যহীন। তিন কিস্তি এখনো বাকি। তাই বাইকটা ছাড়াতে গিয়ে দেখি প্যান্ট আটকে গেছে কারের বনেটের সঙ্গে। বিশ্বাস করো শারমিন আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম এই মুহূর্তে। কিন্তু সফেদ ওয়ালাদের তাড়া আর প্যান্টের আটকে থাকার কারণে বেশ কিছু পথ রাস্তায় শুয়ে তীব্র গতিতে চলতে হয়ছে। এই দেখো, তোমার দেয়া হেলমেটের সামনের অংশের কিছুই হয়নি। শুধু তোমার ভালোবাসা স্মৃতি যে মগজ বহন করত তা ওই রাস্তায় পড়ে আছে।