অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : কথায় বলে ধর্মের ঢাক আপনি বাজে। আর পাপের সাজা হয় প্রাকৃতিকভাবেই। পলাশী যুদ্ধের ষড়যন্ত্রকারি ও বিশ্বাসঘাতকরা প্রাকৃতিকভাবেই সাজা পেয়েছিলেন। সজ্জনরা বলে থাকেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক, খলনায়ক, ষড়যন্ত্রকারি ও নরাধমরা কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না। এজন্যই নবাব সিরাজ আর মীরজাফররা যুগে যুগে রাস্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় স্ব স্ব চরিত্রে বারংবার ফিরে আসেন। আর ইতিহাস নীরবে সবাইকে শুধু সতর্ক করে যায়।
পলাশী যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রকারি ও বিশ্বাসঘাতক ছিলেন মীরজাফর আলী খান। বাংলার বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী পরলোকগমনের আগে প্রিয় দৌহিত্র সিরাজকে উত্তরাধিকার নির্বাচন করার সময় প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানকে নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেন। কারণ মীরজাফর বর্গী দমনের সময়ে আলীবর্দী খানকে একবার ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্র করেন। আলীবর্দী টের পেয়ে মীরজাফরকে বরখাস্ত করেন। হীনচরিত্রের মীরজাফর প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করলে বেগম শরীফুনেচ্ছার অনুরোধে আলীবর্দী ক্ষমা করেন। ঐতিহাসিক ফিলিপ পি কে হিট্রির সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করতে নেই। বিশ্বাসঘাতকরা একবার ক্ষমা পেলে বার বার এ কাজটি করে। কারণ বিশ্বাসঘাতকতা একটি মানসিক রোগ। যারা বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেছে তারা কখনো না কখনো কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ মীরজাফরের ক্ষেত্রে এ কথাটি একশ ভাগ খাটি ছিল।
যাই হোক, সিরাজকে উত্তরাধিকার ঘোষণা অনুষ্ঠানে নবাব আলীবর্দী প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে পবিত্র কোরআন স্পর্শ করে শপথ করান। আশা ছিল সুখেদুখে সিরাজকে সমর্থন করবেন। কিন্তু তার স্বভাব বদলায়নি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধের দিন ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে নবাব সিরাজ উদ্দৌলাহ প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে যুদ্ধ শিবিওে ডেকে আনেন। নিজের মুকুট মীরজাফরের পদতলে রেখে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় আকুল আহবান জানান। মীরজাফর সেদিনও পবিত্র কোরআন স্পর্শ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার শপথ নেন। এরপর পলাশীতে কী ঘটেছিল পাঠকরা সবই জানেন।
পলাশী যুদ্ধের পর বন্দী সিরাজকে নৃশংসভাবে হত্যার পরামর্শ দেন মীরজাফর। তবে ষড়যন্ত্র আর নোংরামি করে বাংলার মসনদে আরোহন করলেও মীরজাফরের জীবন সুখের ছিলনা। শেষ বয়সে দুই বাঈজীকে বিয়ে করে কেলেঙ্কারি ঘটান। দুরারোগ্য কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দুই হাত ও পা পঁচে গলে ক্ষয়ে যেতে থাকে। টানা ছয় মাস অসম্ভব রকম যন্ত্রনায় বিছানায় কাতরাতে থাকেন। শরীর থেকে অসহনীয় দুগর্ন্ধ বের হতে থাকে। নিকটজনরা এ অবস্থায় ধারেকাছে আসতেন না। দাসীবাদীরা উপায়ন্তর না দেখে সোবা দিতে বাধ্য হন। জীবন সংকটপন্ন দেখে দুই বাঈজী স্ত্রী কোষাগার থেকে বিপুল ধনসম্পদ বাগিয়ে নিয়ে চেহেল গাজী প্রাসাদ ত্যাগ করেন। শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলে প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। অন্তিম সময়ে নামাজরোজা কিছুই করতেন না। নিঃসঙ্গী জীবন ছিল তার। কুষ্ঠ থেকে নিস্তার পেতে দেশবিদেশের বৈদ্য-কবিরাজের পরামর্শে নানা দাওয়াই সেবন করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলোনা।
শেষ পর্যন্ত রাজদরবারের ব্রাম্মনদের পরামর্শে কীরিটশ্বেরী মন্দিরের জল পান শুরু করেন। ওই জলে প্রত্যেহ অঙ্গ ধৌত করা হতো। কিন্তু মন্দিরের জলেও বিশ্বাসঘাতকের ব্যারাম উপশম হলোনা। ১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসের এক গভীর রাতে রোগযন্ত্রনায় অস্থির হয়ে চিৎকার করতে করতে ইহকাল ত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক করম আলী খানের ভাষায়, “ইমাম হোসেনের বংশধর বলে দাবিদার মীরজাফর আলী খান শেষ পর্যন্ত মন্দিরের মূর্তি ধোঁয়া জল সেবন করে পরলোকগমণ করেন। উনার শুধু যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুই হয়নি, ইতিহাসের অনেক যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুর কারণ ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে সেরা ছিলেন।” বিখ্যাত লেখক অক্ষয় কুমার মৈত্র বলেছেন ‘মীরজাফরের হীন কার্যকলাপের সবচেয়ে বড় বিচার করেছে ইতিহাস। এ ঘৃণিত ব্যক্তি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমনের সময় যতটা না যন্ত্রনা পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি যন্ত্রনা দিয়েছেন ইতিহাস পাঠকদের। বাঙ্গালী জাতি যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক নামেই পরিচিত থাকবেন।’
নবাব সিরাজ হত্যার মূল নায়ক ছিলেন মীরন। মীরন ছিলেন মীরজাফরের আগ পক্ষের পুত্র। সিরাজ হত্যার সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। যেদিন সিরাজকে হত্যার পর মরদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা মুর্শিদাবাদ শহরে ন্যাক্কারজনকভাবে ঘুরানো হয় সেদিন সন্ধ্যার পর মিরণ প্রাসাদে নাচগান ও আমোদ স্ফূর্তির আসর বসান। সিরাজ হত্যার দুদিন পর মীরণের নির্দেশে সিরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মির্জা মেহেদীকে বাঁশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। সিরাজের অনুরাগী ও রাজনর্তকী আলেয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। সিরাজ হত্যার ক‘দিন পর ষড়যন্ত্রকারি ঘসেটি বেগমকে ও বন্দী করেন মীরণ। সিরাজ মাতা আমেনা বেগম, সিরাজ পতœী লুৎফা এবং কণ্যা জোহরাকে বন্দী করে নৌকায় ঢাকার জিঞ্জিরা কারাগারে পাঠনো হয়। পরে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করেন ঘসেটি ও আমেনাকে।
ঘসেটি ও আমেনার পর তিন বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর কাজিম, খোয়াজা আব্দুল হাদি এবং সৈয়দ খাদিম হাসেনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন মীরণ। মীরকাজিম ছিলেন মীরণের আপন কাকা, খোয়াজা আব্দুল হাদি খালাতো বোন জামাই আর সৈয়দ খাদিম ফুফাতো ভাই। এরা প্রত্যেকেই পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মীরজাফরকে সহযোগিতা করেন। এমনকি সিরাজ হত্যার পর লাশ হাতীর পিঠে মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরানোর সময় আমেনা বেগম পুত্রের লাশ দেখার জন্য ছুটে এলে সেনাপতি সৈয়দ খাদিম হোসেন তার সাথে বর্বর আচরণ করেন। মীরণের নির্দেশে নিহত সিরাজের জেনানা মহলের সব অভিজাত মহিলাদের সাথে অশ্লীল আচরণ করেন সৈয়দ খাদেম। কিন্তু বিপদ পার হয়ে গেলে এসব বিশ্বস্ত সেনা নায়কদের সাথে বেঈমানী করার সিদ্ধান্ত নেন মীর জাফর ও মীরণ। কারণ বাপবেটার ভয় ছিল, এসব নিকটাত্মীয়ারা যেহেতু সামরিক বাহিনীর প্রভাবশালী অফিসার এবং ষড়যন্ত্র করে নবাব হওয়ার শর্টকাট রাস্তা তাদের জানা, তাই ভবিষতে এরা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে তাদেরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৭৫৮ সালের জুন মাসের কোনো এক রাতে চেহেলগাজী প্রাসাদে রাজকীয় নাচগানের আসর বসানো হয়। সেখানে রাজকীয় অতিথি ছিলেন সেনাপতি মীরকাজিম ও সৈয়দ আব্দুল হাদি। সেখানেই কৌশলে হত্যা করা হয় দুজনকে। আর হত্যার ষড়যন্ত্রের খবর গোপনে জানতে পেরে সৈয়দ খাদিম মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে বিহারের পূর্ণিয়ায় আশ্রয় নেন। সেখানে কৌশলে সিরাজ ভক্তদের ঐক্যবদ্ধ করে মীরজাফরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ বিদ্রোহ দমনের জন্য মীরণ কয়েক হাজার নবাবী ও ইংরেজ সৈন্য নিয়ে পূর্ণিয়া গমণ করেন। সেখানে যুদ্ধরত অবস্থায় ঝড়বৃষ্টিার রাতে নিজ তাবুতে বজ্রপাতে মারা যান কুখ্যাত মীরণ। বজ্রপাতে তার মুখসহ সারা শরীর এতটাই ঝলসে যায় যে লাশ মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া অনুচিৎ মনে করা হয়। শেষ পর্যন্ত রাজমহলে তাকে দাফন করা হয়। সেখানো পাথরে বাধানো মীরণের সমাধি এখনো রয়েছে।
আর পলাশীর বিশ্বাসঘাতক সৈয়দ খাদিম হোসেনের কী হলো? তিনি নিস্তার পাননি। কারণ ইংরেজদের নিকট যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পর পলায়ন কালে নিজ দেহরক্ষীরা তার শিরচ্ছেদ করে। মীরণের মৃত্যূর ঘটনায় অবশ্য কোনো কেনো ঐতিহাসিক ভিন্নরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কারো কারো মতে যুদ্ধের ময়দানে অনর্গল মদ পানে বিভোর উদ্ধত স্বভাবের মিরণকে ইংরেজ সৈন্যরা সহ্য করতে পারছিলোনা। তাই ঝড়ের রাতে মীরণকে কৌশলে কয়লার আগুনে ঝলসিয়ে হত্যা করে বজ্রপাতের কাহিনী প্রচার করা হয়। এভাবে সিরাজ হত্যার অন্যতম নায়ক মীরণের প্রাণ সংহার ঘটে। জঘন্যভাবে মৃত্যূর পেয়ালা পান করেন সেনাপতি মির কাজিম, খোয়াজা আব্দুল হাদী এবং সৈয়দ খাদিম হোসেন। মীরজাফরের পরিণতি সম্পর্কে “মুর্শিদাবাদের আধুনিক ইতিহাস” গ্রন্থে বলা হয়, ‘কারবালার ইমাম হোসেনের বংশধর বলে দাবিদার নিচু প্রকৃতির এবং বদ স্বভাবের মানুষটি চির বিদায়কালে মন্দিরের মূর্তির পা ধোঁয়া জলে অপবিত্র হয়ে নরকে প্রবেশের পথ নিজেই প্রশ্বস্ত করে গেছেন। দুনিয়াতেই এ বিশ্বাসঘাতকের সাজা শুরু হয়ে হয়েছিল।’ আগামী পর্বে পলাশী ষড়যন্ত্রের অবশিষ্ট বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
প্রতিবেদক :
দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এর এডিটর এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
ফটো ক্যাপশন :
মুর্শিদাবাদ শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন হাজার দুয়ারী প্রাসাদ এবং নবাব সিরাজ হত্যায় ব্যবহৃত খঞ্জর ও তলোয়ার।