বাংলার প্রাচীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের একাল-সেকাল (৮)
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : পলাশী প্রান্তর থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরে অসহায় নবাব সিরাজ নিজকে অনিরাপদ বোধ করেন। তবুও ষড়যন্ত্রকারিদের রুখে দেয়ার শেষ চেষ্টা চালান। পলায়নপর ও বিচ্ছিন্ন সৈনিকদের ডেকে বকেয়া বেতন ও বিপুল ইনাম দিয়ে সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক দুর্লভরাম বিপুল অঙ্কের স্বর্ণ মুদ্রা ছড়ানোর পর সহযোগিতার নামে উল্টো নবাবের বিরুদ্ধে সর্বত্র বিষোদগার করেন। দুর্লভ রামের বিশ্বসঘাতকায় হতবিহব্বল নবাব শেষাবধি বিহারের পাটনার বিশ্বস্ত সুবাদার রাজা রাম নারায়নের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অপরাহ্ণে রাজপ্রাসাদের জেনানা মহলের পাঁচ শতাধিক বাদীকে নগদ মুদ্রা উপহার দিয়ে মুক্ত ঘোষণা করেন। রাতের তৃতীয় প্রহরে তিনি মুর্র্শিদাবাদের হিরাঝিল প্রাসাদ ছেড়ে ভাগীরথী নদী ধরে পাটনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সিরাজের বজরঙ নৌকায় সহযাত্রী ছিলেন প্রিয় রাজমহিষী লুৎফুন্নেছা, কণ্যা উমেদাতুন নেছা, বাদী আলেয়া ও গোলাম হোসেনসহ পাঁচ অনুচর। কিন্তু দুর্ভাগ্য নবাবের পিছু ছাড়েনি। পাটনার পথে প্রায় ৫০ কিলো উজান ঠেলে মালদহ পৌঁছলে নদীর বাঁকে অবিশ্বাস্য রকমভাবে জেগে উঠা চরে নৌকা আটকে যায়। অগত্যা পুনরায় উল্টো দিকে এসে রাজমহল হয়ে পাটনায় যাবার উদ্যোগ নেন। এ সময় বজরঙ পরিবর্তন করে সাধারন নৌকায় উঠেন সিরাজ। এসবে তিন দিন কেটে যায়। মীরজাফরের অনুচররা তাকে হণ্যে হয়ে খুঁজছিলো। এ ক‘দিনে তেমন আহারপর্ব হয়নি। ক্ষুধার্ত নবাব রাজমহল শহরের উল্টো দিকে বিষ্ণুপুর এলাকায় নির্জন ঘাটে বিরতি দেন। নৌকা থেকে নেমে পরিজনের জন্য খাবার সংগ্রহে বের হন।
সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থে বিবরণ এ রকম, “বড়রা শোকেদুখে আহার পর্বের কথা ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু নবাবের চার বছরের শিশু কণ্যা উমেদাতুন নেছা ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদতে থাকেন। অনাহারি শিশুর কান্না সহ্য করতে না পেরে নবাব খাদ্যের খোঁজে বর্হিগত হন। পাশেই জঙ্গল ঘেরা উচুঁ ভিটায় ফকিরের আস্তানা দেখতে পান। এ ভন্ড ফকিরের নাম ছিল দানা শাহ ওরফে শাহদান ফকির। সিরাজের পরনে ছিল সাধারন মানের পিরহান ও পাঞ্জাবী, মাথায় সাদা টুপি এবং কাঁধে হালকা কম্বল। ফকির এক নজর তাকিয়ে রাজকীয় চেহারার সিরাজকে চিনতে পারেন। কোনো এক অপকর্মের জন্য সিরাজ সাজা দিয়ে তাকে রাজধানী ছাড়া করেন। ভন্ড ফকির এর প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। খাবার তৈরির অছিলায় বসিয়ে রেখে কাছেই মীরজাফরের অনুচর মীর দাউদ খানের নিকট খবর পৌঁছান।
বেলা তখন দ্বিপ্রহর। খাবার সামনে রেখে নবাব পরিজন নিয়ে গোল হয়ে বসেছেন। তখনই মীর জাফরের জামাতা মীরকাশিম সৈন্য নিয়ে হাজির হন। নবাবকে বন্দী করা হয়েছিল। লুৎফুন্নেছাকে লাঞ্জিত করে মীরকাশিম শরীর থেকে গহনাপত্র খুলে নিলেন। কাছে থাকা হীরার বাক্সটিও হস্তগত করলেন। অতঃপর ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই পলাশী যুদ্ধের দশ দিন পর গরুর গাড়িতে চড়িয়ে বন্দী নবাবকে অত্যন্ত অমর্যাদার সঙ্গে মুর্শিদাবাদ শহরে আনা হলো। ক্রমাগত পেরেশানি আর অপমানে নবাবের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। তাকে মীরজাফর পুত্র মীরনের হেফাজতে দেয়া হলো। তাকে মিরনের প্রাসাদে বন্দী রাখা হয়।”
বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মোতাখখিরিন’ এ বর্ণনা দেয়া হয়, “সেদিন ছিল ১১৭০ হিজরি সনের ১৫ শাওয়াল বা ৩ জুলাই। মুর্শিদাবাদের প্রধান সড়ক দিয়ে নবাবকে খুব অপমানজনকভাবে টেনেহিচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। বহু রাজকর্মচারি ও সেপাই গৃহের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের প্রিয় নবাবের এ সীমহীন দুর্দশা ও শোচনীয় অবস্থা দেখে ব্যথিত হন। কেউ উদ্ধার করার বাসনা প্রকাশ করলো। কিন্তু সেনাপতি বা প্রভাবশালীদের নিকট থেকে কোনো সাড়া মিললো না। সেনাপতি বা প্রভাবশালীরা নিজ স্বার্থে অন্ধ হয়ে নবাব থেকে দুরে সরে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় উপরওয়ালাদের নিশ্চেষ্টতায় ভীত হয়ে নি¤œ পদস্থ ব্যক্তিরা উৎসাহ দমন করেন। মূলতঃ সেই বিশ্বাসঘাতকতা আর ষড়যন্ত্রের যুগে সবাই দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখতো। একমাত্র সিরাজ ছিলেন ব্যতিক্রম। এজন্যই তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হলো।”
বলা অনাবশ্যক, ইতিমধ্যে মুর্শিদাবাদে নবাবীর পরিবর্তন ঘটে। পলাশী যুদ্ধের দু’দিন পর ২৫ জুন মীরজাফর নিজকে নবাব বলে ঘোষণা দেন। লর্ড ক্লাইভ তাকে হাত ধরে মসনদে বসেন। প্রতিশ্রুতি দেন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির পরামর্শ ছাড়া নবাবী চালাবেন না। এজন্য মীরজাফরকে বলা হয় লর্ড ক্লাইভের গর্দভ।
যাই হোক, সিরাজকে বন্দী করে কারাগারে রাখার পর দুপুরে রাজদরবার বসে। জগৎশেঠ, রাজা দুর্লভরাম, রাজা রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, ইয়ারলতিফ খান, লর্ড ক্লাইভ, ওয়াটসন, উইলিয়াম ওয়াটস এর পরামর্শে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে নবাবকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এভাবে সব বিশ্বাসঘাতকরা মিলে সাজানো বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে একজন দেশপ্রেমিককে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়। আর কিছু নেমকহারাম তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
নবাব সিরাজকে নৃশংস হত্যার বিবরণ সমসাময়িক অনেক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। বিবরণ এরকম, “মোহাম্মদী বেগম সিরাজকে হত্যার জন্য কয়েক বন্ধুকে নির্দেশ দেন। কিন্তু কেউ তাতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত পাষন্ড মোহাম্মদী বেগ অর্থ লোভে রাজি হয়। বলা দরকার যে, মোহাম্মদী বেগ যখন বেকার ছিলেন তখন আলীবর্দী তাকে রাজপ্রাসাদে ঠাঁই এবং চাকরি দেন। সিরাজের নানী শরীফুন্নেছা বেগকে প্রচুর অর্থ দিয়ে বিত্তশালী করেন। নিজে অর্থ ব্যয় করে বেগের বিবাহ করান। সিরাজ ক্ষমতায় বসে বেগের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করেন। কিন্তু দুর্দিনে নেমকহারাম বেগ উপকারের প্রতিদান দেন সিরাজকে হত্যা করে। মোহাম্মদী বেগ কয়েকজন ঘাতক নিয়ে বন্দী সিরাজের কক্ষে প্রবেশ করলে তিনি ওজু করার জন্য পানি চান। বেগ নবাবের কথায় কান না দিয়ে তাকে ছুরিকাঘাত করেন। উপর্যপুরি বিশটি আঘাতেও নবাবের প্রাণবায়ু নির্গত না হওয়ায় বেগ একজন মুঘল সৈনিককে আঘাত করার নির্দেশ দেন। বুকে ছোরার কঠিন আঘাতে সিরাজের দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
এ নির্মম হত্যাকান্ডেরর পর সিরাজের দেহ হাতির পিঠে চড়ানো হয়। সীমাহীন অমর্যাদার মধ্য দিয়ে সারা মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। একজন ঘোষক অনবরত চিৎকার করে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিল, “আজ থেকে অত্যাচারি নবাবের অবসান হলো। সুযোগ্য নবাবের আর্বিভাব ঘটলো। এখন থেকে নগরবাসির সুখশান্তি হবে।’’
নবাব সিরাজের প্রতি এ নৃশংসতা আজো বাঙ্গালীকে কাঁদায়। ‘নবাব ও নবাবী’ গ্রন্থের বিবরণ- “নবাবের লাশ তদীয় জননী আমেনা বেগমের বাস ভবনের সামনে এলে খালি মাথায় ও পায়ে তিনি পাগলের মতো রাজপথে ছুটে আসেন। ক্রন্দনরত ও বেসামাল আমেনা পুত্রের লাশ স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। তাতে ব্যর্থ শোকাগ্রস্থ আমেনা হস্তীর পায়ের নিচে সমর্পন করার উদ্যোগ নেন। মিরণের শিষ্য খাদিম রাজা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এভাবে মুর্শিদাবাদে অভিজাত নারীরা প্রকাশ্যে নাজেহাল হতে থাকেন। সিরাজের নানী বেগম শরীফুন্নেছা এ দৃশ্য দেখে রাজপথেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। নবাব পরিবারের যে সব অভিজাত মহিলাদের সূর্যের আলো নাগাল পায়নি- তাদের সেদিন বিধস্ত অবস্থায় রাজপথে বিলাপ করে গড়াগড়ি দিতে দেখা যায়। যা ছিল খুবই মর্মান্তি।”
লালবাগ মোড়ের শেষ প্রান্তে এখনো যেখানে ত্রিমোহনা মোড়- সেখানকার এক বাজারের প্রবেশ পথে সিরাজের লাশ হাতি থেকে সেদিন অবজ্ঞাভরে রাজপথে অনেকক্ষন ফেলে রাখা হয়। সারা মুর্শিদাবাদ শহর তখন মীরজাফর ও মীরনের দখলে। তাই নবাবের লাশের প্রতি অমানবিক আচরণ দেখেও কেউ প্রকাশ্যে প্রতিকার বা চোখের জল ফেলার সাহস পাননি। নিজের জীবনকে বাজি রেখে সিরাজের এক আত্মীয় মির্জা জয়নুল আবেদীন মৃতদেহকে কোনোভাবে গোছল করিয়ে রাতের অন্ধকারে সাধারন মানের খাটিয়ায় খোগবাগে নিয়ে যান। ক্ষতবিক্ষত লাশ কফিনে ভরে হাতেগোনা ক’জন অনুচর তড়িগড়ি করে নানা আলীবর্দীর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করেন।
এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন বাঙ্গালীর চির স্বাধীনতার প্রতীক সিরাজউদ্দৌলাহ। পর্যটকরা এখনো মুর্শিদাবাদ এসে নবাবের সমাধি দর্শনে নীরবে চোখের জল ফেলেন। অনেকেই দু’হাত তুলে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় পরম করুনাময়ের নিকট প্রার্থনা করেন। এভাবেই নবাব সিরাজ দেশপ্রেমের জন্য বাঙ্গালী মানসে বেঁচে রয়েছেন-বেঁচে থাকবেন হাজারো বছর।
প্রতিবেদক : দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এর এডিটর এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।