লুৎফর রহমান হিমেল :
মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরপ্রতীক বসবাস করেন মীরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ময়লার ঢিবির ওপর টাঙানো চালার ভেতরে। হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করেন তিনি, কখনো বা কুলির কাজ। আশা ছিল, সন্তানদের সামাণ্য পড়ালেখা শেখাবেন, এতে যদি ভাগ্য ফেরে। কিন্তু স্কুলে বেতন দিতে না পারায় কর্তৃপক্ষ ছেলের নাম কেটে দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়। শেষ জীবনে দুটো কিডনিই বিকল হয় তার। এভাবে হাসপাতালের বারান্দায় ধুকে ধুকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি।
এ কাহিনী আপনার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে না? আমারও প্রথম শুনে অবিশ্বাস্য লেগেছিল। আরও আশ্চর্য লেগেছিল যখন শুনলাম, এই বীর তার বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন ৩০ বছর পর! যখন তার শরীরে দুরারোগ্য ব্যধি বাসা বেঁধেছে। তার এই রোগ পাকবাহিনীর চেয়েও ভয়ানক। তখন আক্ষেপ করে এই বীর বলেছিলেন, ”আমার থিকা অল্প বয়সী লোকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে। আমি ১২ বছর বয়সে যুদ্ধ করছি, তারা তাহলে কত বছর বয়সে করছে? মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুইকা গেছে, তারা ভাতাও তোলে। আর আমার পোলাপাইন না খাইয়া থাকে। কি করুম, আমি মূর্খ মানুষ। ছোটো লোকের পোলা।”
অভিমানী, বঞ্চিত এই বীরের নাম নাম শহীদুল ইসলাম। ক্যাম্পের সবাই আদর করে যাকে ডাকত লালু বলে। এই লালু আমাদের লালু। এই লালু বাংলাদেশের লালু। এই লালু টাংগাইলের গোপালপুরের লালু। এই লালু মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বকনিষ্ঠ বীর যোদ্ধা।
লালুর জীবন সাঙ্গ হয়েছে ২০০৯ সালের মে মাসের ২৫ তারিখেই। আর তাই তিনি আর আমাদের মুক্ত দেশে, স্বাধীন নাগরিকদের চলার পথের বাধা হতে আসবেন না। চিকিৎসার জন্য কারো কাছে হাত পাতবেন না। জানি, লালুকে এই ভুলু জাতি মনে রাখবে না। প্রয়োজন পড়বে না তার।
আজ ১০ ডিসেম্বর। গোপালপুর হানাদার মুক্ত হবার শুভদিন। গোপালপুরের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস বলতে লালুময়। কি করেছিলেন বীরপ্রতীক লালু ওই সময়ে?
ফ্ল্যাশব্যাক :
হ্যাংলা পাতলা ছেলেটি। দুরন্ত কৈশোর সময়। দেশেরও তখন দূরন্ত সময় চলছে। গাঁয়ের মেঠোপথ, ঝোপঝাড়, বাঁশবাগানে, পুকুরে সাঁতার কাটা এবং কিশোর বন্ধুদের নিয়ে নদী-খাল-পুকুর পাড়ে হৈ-হুল্লোড় করে কৈশোরের দিনগুলো তার কাটছিল বেশ। বাবা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন আর মা আমিনা বেগমের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল দুঃসাহসী আর ডানপিটে। সেই ১২ বছর বয়েসেই ঘটিয়ে ফেলল ঘটনাটি। কারো কারো সাহস থাকে, কারো বা থাকে দুঃসাহস। এই ছেলেটির ছিল দ্বিতীয়টি। ছেলেটির নাম শহীদুল ইসলাম লালু।
একদিন সেই কিশোর দেখল পাকবাহিনীর তাণ্ডবে সাধারণ মানুষগুলি ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। সূতীপলাশ গ্রামের অদূরে গোপালপুর থানার আশেপাশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাক সৈন্যরা বাঙালিদের মারছে। লালু পালালেন তবে, পেছনের মানুষের আহাজারি ভুললেন না। তাই ফিরে গেলেন কেরামজানী আর ঝাওয়াইল স্কুল মাঠে। সেখানেই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী দলবল নিয়ে পাকসেনা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লালু এক বুক সাহস নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার বায়না ধরলেন। লালুর সাহস ও বায়না দেখে তারা প্রথমে হেসে ফেললেন। কিন্তু লালু নাছোড়বান্দা। যুদ্ধে তিনি যাবেনই। এক সময় ফুট-ফরমাশ খাটানোর লক্ষ্যে তাকে দলে ভর্তি করিয়ে নেয়া হল।
লালুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি গোপালপুর থানায় হানাদারদের বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অগোচরে এ কাজ সহজে করা যাবে এবং ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবে। নির্ধারিত দিনে লালু হাফপ্যান্ট পরে বিকেলে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশে রওনা হন। থানার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুরপাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। একসময় সুযোগ বুঝে সবার অগোচরে থানার ভেতরের একটি পরিত্যক্ত স্থানে গ্রেনেড তিনটি রেখে তা ব্যবহারের সময় খুঁজতে থাকেন। তারপর চা-পানি খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চারদিকে কে কোথায় আছে দেখে নেন। তিনি তিনটি ব্যাংকার টার্গেট করে নেন, যা সহজেই গ্রেনেডে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাতে কজন পাকসেনা ঘায়েল হবেন তার হিসাবও কষে নেন। একেক ব্যাংকারে ৫ জন, ৪ জন ও ৩ জন করে পাকসেনা রয়েছে। তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে ব্যাংকারগুলোতে পজিশন নিয়ে আছে। লালু ছোট হওয়ার কারণে সবার সন্দেহের বাইরে থেকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন। লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনতে গিয়ে কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হন লালু। গ্রেনেডের ওপর শুয়ে ছিল মস্ত বড় একটা সাপ। সাপ চলে যাওয়ার পর গ্রেনেডগুলোর সেফটিপিন খুলে দ্রুত প্রত্যেক ব্যাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডগুলো। এতে তিনটি ব্যাংকারের সবাই মারা যায়। আর তখনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখল করে নেন। লালু যে ফিরে আসতে পারবেন, সে ধারণা খোদ কমান্ডারদেরও ছিল না।
লালু গোপালপুর ছাড়াও ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের কয়েকটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন।
১৬ই ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে ২৪শে জানুয়ারী টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দেন। লালুও সেদিন অন্যদের সাথে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে জমা দেন অস্ত্র। রাষ্ট্রপতি ক্ষুদে এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে অবাক হয়ে কোলে তুলে নেন এবং বলেন, ‘সাব্বাস বাংলার দামাল ছেলে।’ যখন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর ব্যাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, ‘বীর বিচ্ছু’।
সেই ছবি দিয়ে একটি পোস্টারও পরে ছাপা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করলেও জীবনযুদ্ধে তিনি ছিলেন পরাজিত। অভাব ও দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। একদিন প্রাণের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ছুটে আসেন ঢাকায়। ঢাকার এসে ঠেলাগাড়ী ঠেলা, রাজমিস্ত্রী ও সোয়ারীঘাটের কুলিগিরি সব করেছেন। হোটেলে বাবুর্চির সহকারী হিসেবেও কাজ করেন।
এরইমধ্যে ১৯৯৬ সাল। মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে খেতাবপ্রাপ্ত বীরমুক্তি সেনাদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। লালুর নাম রয়েছে ৪২৬ জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে। তার নম্বর ৪২৫।
তাঁর নাম ছাপা হয়েছে শহীদ ইসলাম, প্রযত্নে/ আব্দুল কাদের সিদ্দিক, টাঙ্গাইল। খবর পড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালুকে দপ্তরে ডেকে পাঠান এবং তাকে সম্মানীত করেন; ওই পর্যন্তই। এরপর আর বাংলা মায়ের বীর এই সন্তানের আর খোঁজ নেয়নি কেউ।
এভাবে একদিন দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়। স্বাধীনতাবিরোধীরা ঠাটে ফেরে। আর লালুদের ঠাঁই হয় আস্তাকুড়ে। সেখানেই একদিন তারা ধুকে ধুকে মরে যায়। যে পতাকার জন্য জীবনবাজি, মরণের পর সেটা কফিনে মোড়ক হয়। এই বাংলাদেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার এটাই রাষ্ট্রীয় সম্মাণ বৈকি। যদিও সেটি কালেভদ্রে জোটে মরণের পরেও।