– জয়নাল আবেদীন
হেমনগর রাজবাড়ির উত্তর পাশে ছিল বেহারা পল্লী। পনেরো-বিশ ঘর বেহারা পালকি বহনে নিয়োজিত থাকতো। জমিদার কালিচন্দ্র রায় ভারতের বিহার থেকে নিঁচু জাতের এসব হিন্দুকে হেমনগরে নিয়ে আসেন। জমিদার ছাড়াও রাজপরিবারের সদস্যরা তখন পালকিতে চড়ে গন্তব্য যেতেন।
রাজবধূ অথবা রাজকণ্যারা আরোহন করলে পালকি পাতলা রেশমিতে ঢাকা থাকতো। আটদশ বেহারা পালকি টানার মিছিলে সামিল হতো। সামনে থাকতো বেহারা সর্দার। তিনি গানের সুর তুলে বলতেন, হাঁই হুঁই হুঁই কে যায়রে? পালকি কাঁধে নেয়া বেহারা উত্তরে বলতো, হাঁই হুঁই হুঁই তাইরে- রাজাবাবু যায়রে।’ বেহারারা সমস্বরে আরো গাইতো, ‘প্রজারা ছব ভাগ্যবান, রাজা বাবু দয়াবান’ ভগবান ভগবান রাজা মোদের পিয়ারবান। অথবা ‘রাছপথে মহারাজ, তুমরা ছব নিকাল যা’ ইত্যাদি।
এভাবে পদবি অনুযায়ী বেহারারা গানের ছিলকি গেয়ে পালকি কাঁধে গন্তব্যে যেত। সর্দারের মুখে থাকতো লম্বা গোঁফ । পালকি বহরের আগে থাকতো গাদা বন্দুক হাতে রাজপ্রহরী। তাদের হুঙ্কারে রাজপথের আশপাশে ভিড়তে পারতোনা প্রজারা। বেহারারা মাসিক বেতন ছাড়াও বখশিস পেত। বিশেষ করে রাজপরিবারের মহিলারা দরিদ্র বেহারাদের নগদ টাকায় খুশি করতো। জমিদারের বেতন আর বখশিসে পুরুষানুক্রমে ভালোই দিন কাটছিলো বেহারাদের। কিন্তু সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় হেমনগর জমিদার পরিবারের সদস্যরা কোলকাতা চলে যায়। পেছনে রেখে যায় রাজবাড়ি, বিপুল ভূসম্পত্তি আর বেহারা পল্লীর মত অবাঙ্গালী শতঘর পাইক, বরকন্দাজ, আলাইকর, ধোপা ও শ্রমজীবি দরিদ্র জনগোষ্ঠি।
জমিদার না থাকলেও এদেশের মায়া ওই শ্রমজীবিরা ছাড়তে পারেনি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর না যেতেই খাসজমির অজুহাতে প্রভাবশালিরা বেহারা পল্লীর সদস্যদের ভিটে ছাড়া করে। রাজবাড়ির আশপাশে সংখ্যালঘু শ্রমজীবিদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। অনেকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বেহারা পল্লীর সর্দার দুখিয়া ভিটে ছাড়া হলেও দেশত্যাগ করেনি। বাস্তুহারা হয়ে রাজবাড়িতে আশ্রয় নেয়। একটানা তিন দশক ওরা রাজবাড়িতেই থাকছিলো। আশির দশকে রাজবাড়িতে কলেজ স্থাপিত হলে ওদেরকে দ্বিতীয় দফা উচ্ছেদ করা হয়। ওদের স্থান হয় রাজবাড়ির পশ্চিম পাশে শিমলাপাড়া মৌজার ২০ শতাংশ খাস জমিতে। সেখানেই গাদাগাদি করে টিনের ছাপড়া ঘরে সাড়ে তিন দশক ধরে বসবাস।
দুখিয়া সর্দার মারা গেলে তার পুত্র নরতন সর্দারের আমল থেকে পালকি টানার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন পালকির যুগ চলে গেছে। নরতন সর্দারের চার ছেলে সুশীল সর্দার, সুনীল সর্দার, অনীল সর্দার ও অতুল সর্দার। পৈত্রিক পেশা হারিয়ে বেকার সুশীলরা দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত। দিনমজুরি, ফুটফরমায়েশ খাটা, গ্রাম পুলিশ অথবা নৈশপ্রহরীর কাজ করে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে ওদের দিন চলে। অর্থাভাবে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো হয়না। সরকারি সাহায্যসহযোগিতাও কখনো মিলেনা।
সুশীল জানায়, দীর্ঘ দিন ধরে খাস জমিতে বাস করছি। এ জমি পত্তনি চেয়ে বহুবার কাঁচারিতে ঘুরেছি। কিন্তু ঘুষের টাকা দিতে না পারায় ভাগ্যে পত্তনি জোটেনি। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। কখন না জানি আবার আমাদেরকে এ খাস জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এখান থেকে উচ্ছেদ হলে আমাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকবেনা। সুনীল জানায়, এ সরকারের আমলে হেমনগর ইউনিয়নে দুই-দুইবার আশ্রয়ন প্রকল্প হলো। কথা ছিল আমাদের পাড়ার খাস জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্প হবে। কিন্তু আমাদের কপাল মন্দ। এখানে না হয়ে অন্যগ্রামে হলো সেটি।
অপরদিকে হেমনগর রাজবাড়ি থেকে দেড়শ গজ দূরের রাজশ্মশান ঘাট বেদখল হয়ে যাচ্ছে। হেমনগর জমিদার পরিবারের সদস্যদের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পনের জন্য দেড় একর জমির উপর স্থাপন করা হয়েছিল এ শ্মশানঘাট। জবরদখলকারিরা এ শ্মশানঘাটের প্রায় পুরো জমি জবরদখলে নিয়েছে। পুকুর পাড়ের মাত্র দেড়দুই শতাংশ জমি এখন শ্মশানঘাট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। শ্মশানঘাটে যাওয়ার সড়ক জুড়ে বাড়িঘর উঠায় দাহের জন্য শব নিয়ে যাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে জানান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অতুল চন্দ্র।