– জয়নাল আবেদীন
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর জমিদারদের নিয়ে নানা চমকপ্রদ উপাখ্যান রয়েছে। এলাকার প্রবীণরা এখনো সেসব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। বংশ পরম্পরায় জমিদারের নানা অলৌকিক কাহিন অনেকেই স্মরণে রেখেছেন। এমনি একটি প্রচলিত উপাখ্যান হলো পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল রায় বা পদ্মলোচন রায়কে নিয়ে।
হেমনগর শশীমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জোয়াহের আলী বিএসসির (৬৮) মুখে শোনা গল্পটি এরকম। ‘হেমচন্দ্রের পূর্ব পুরুষ গোপাল রায়ের জন্মস্থান মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রামে। সে সময় আমবাড়িয়া ছিল পুকুরিয়া পরগণার মৌজা। পুঠিয়ার রাণী হেমন্ত কুমারীর অনেক রায়ত ছিল আমবাড়িয়াসহ পুকুরিয়া পরগনা জুড়ে। গোপাল রায় নিজের ভাগ্য গড়ার জন্য রাণী হেমন্ত কুমারীর রাজপ্রাসাদে চাকরি নেন। দায়িত্ব ছিল জমিদার বাড়ির বিশাল উদ্যান থেকে ফুল তুলে প্রধান মন্দিরে পৌঁছে দেয়া।
তখন পূজা অর্চনার জন্য প্রচুর ফুল লাগতো। আর গোপাল খুব যতেœর সাথে এ কাজটি করতেন। এজন্য রাজবাড়িতেই তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। তার কাজকর্ম ও বিশ্বস্ততায় রাণী খুশি ছিলেন। দুপুরে আহারের পর গোপাল রাজবাড়ির মূল ভবনের একটি কক্ষে দিবানিদ্রা যেতেন। একদিন রাণী রাজবাড়ির উদ্যান পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এজন্য গোপালকে সাথে নেয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন। পাইকরা ঘুমন্ত গোপালকে ডাকতে সাহস পেলোনা। রাণীকে অবহিত করা হলে তিনি নিজেই গোপালের থাকার ঘরে গমন করেন। দেখলেন গোপাল জানালা খুলে নিদ্রায় মগ্ন। বাইরের রোদ জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। তবে গোপালের মুখে যাতে রোদের তাপ না লাগে এজন্য জানালার ওপাশে দুটি রাজগোখরা জোড়বদ্ধ হয়ে নিরবে দায়িত্ব পালন করছে।
এ দৃশ্য দেখে রাণী হেমন্ত কুমারী বিস্মিত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যাকে রাজগোখরা পাহারা দেয় তিনি একদিন রাজটিকা পড়বেন। সুতরাং রাণী আমবাড়িয়া মৌজার একটি বড় তালুক গোপালকে দান করেন। কপাল স্পর্শ করে তাকে আশীর্বাদ করেন। গ্রামে ফিরে এসে তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তালুকদারি শুরু করেন। দিনদিন অর্থবিত্ত বাড়তে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে তিনি পুকুরিয়া পরগনার জমিদার ভৈরবচন্দের নিকট থেকে দুই আনা তালুক কেনেন। এরপর উপাধি নেন পদ্মলোচন রায়। আমবাড়িয়া গ্রামে নির্মান করেন দ্বিতল রাজবাড়ি। এখনো ওই ভগ্ন রাজবাড়ির অবশিষ্টাংশ কোনোভাবে টিকে থাকলেও রাজবাড়ির জমিজমা বেদখল হয়ে গেছে। সামনের দীঘি দখল করে প্রভাবশালীরা মাছ চাষ করছে। রাজ মন্দিরের জমিজমা জবরদখল হওয়ায় সংখ্যালঘুরা পুজোপার্বনে বাঁধার সন্মুখীন হন।
গোপাল রায় স্বর্গীয় হলে পুত্র কালীচন্দ্র রায় বাংলা ১২৬১ সালে ওই পরগনার ভৈরব চন্দ্র রায়ের নীলামে উঠা চার আনা তালুক কিনে নেন। ততদিনে আমবাডিয়া জমিদারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। নিকটবর্তী ধনবাড়ি মুসলিম জমিদারের প্রতাপও বাড়তে থাকে। কালিচরন পরবর্তীতে গোপালপুর উপজেলায় যমুনা নদীর তীরে বিখ্যাত নদীবন্দর সুবর্ণখালির (বর্তমানে সোনামুই) নিকট রাজবাড়ি নির্মান করেন। তখন সিরাজগঞ্জ জেলা জুড়ে কালিচরনের জমিদারি বিস্তৃত হয়। সুবর্ণখালি বন্দর দিয়ে নৌপথে রাজধানী কোলকাতার সাথে সহজে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। এসময়ে তিনি ইংরেজদের নিকট থেকে সুবর্ণখালির অদূরে একটি সুদৃশ্য নীলকুঠি ক্রয় করেন। নীলচাষ উঠে যাওয়ায় এটি তখন পরিত্যক্ত ছিল। কালিচরন এটিকে রাজস্ব অফিস হিসাবে চালু করেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যমুনার ভাঙ্গনে সুবর্ণখালি নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়। ঘন ঘন ভাঙ্গনে সুবর্ণখালি বন্দর বিলুপ্ত হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয়। আর কালিচরন শিমলাপাড়ায় মৌজায় নির্মান করেন বর্তমান রাজবাড়ি। যার নাম পরীদালান।
কালিচরনের মৃত্যূর পর হেমচন্দ্র জমিদার হন। হেমচন্দ্রের মৃত্যূর পর জমিদারি চার পুত্র হেরম্ভ চৌধুরী, গঙ্গেশ চৌধুরী, প্রফুল্ল চৌধুরী ও যোগেশ চৌধুরীর মধ্যে সমহারে বন্টিত হয়। হেরম্ব চৌধুরী বেশির ভাগ সময় হাতিতে চড়ে যাতায়াত করতেন। চাতুটিয়া গ্রামের শতবর্ষী আহাদুল্লাহ মিয়া জানান, সে সময় বটপাকুড়ের বিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। ঝাওয়াইল-চাতুটিয়া সড়কের সন্নিকটবর্তী উত্তর পাথালিয়া গ্রামে আষাঢ় মাসে বটপাকুড়ের বিয়েতে খুব জাকজমঁক হয়েছিল। জমিদার হেরম্ব চৌধুরী ওই দিন হাতি নিয়ে হাজির হন। পুরোহিতের সাথে তিনি নিজেও গাছ পুজায় অংশ নেন। সেখানে একটি মন্দির ও নির্মিত হয়।
বৈশাখী পূর্ণিমায় গাছ পুজার সময় সেখানে প্রতি বছর মেলা বসতো। হেরম্ব চৌধুরী সেখানে দুই বিঘা জমি দেবোত্তর হিসাবে দান করেন। ওই বটপাকুড় চত্বর থেকে পূর্ব দিকে ডগাবিল পর্যন্ত তিনশ গজ প্রশস্ত রাস্তা নির্মান করেন।গাছপুঁজা শেষে বিলের জলে প্রসাদ ছিটানো হতো।শতাব্দী প্রাচীন ওই বটগাছটি এখনো টিকে রয়েছে। পাকুড় মারা গেছে। খাসজমির পুরোটাই জবরদখলে।দেশভাগের পর অভিজাত হিন্দুরা চলে গেলে মন্দির নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে সংখ্যালঘুরা ওই বটতলায় এখনো পুঁজো দেয়।মানত করে।দেবতার নামে ভোগ দেয়।
প্রবন্ধকার : দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি, গোপালপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং মধুপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।