বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। কিন্তু এর পেছনের গল্প এত সহজ ছিল না। দেশের সবচেয়ে বড় সেতু নির্মাণে ছিল নানা চ্যালেঞ্জ। এই সেতু নির্মাণে অনেক রেকর্ড হয়েছে, যা আগে হয়নি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। খরস্রোতা পদ্মায় সেতু নির্মাণে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, পানি-প্রবাহ বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই এর অবস্থান। এই স্রোতের কারণে এর তলদেশ থেকে মাটি সরে যায়। পদ্মা নিজে নিজেই ভরা মৌসুমে বড় খাদ তৈরি করতে পারে। এই মাটি সরে যাওয়ার সর্বোচ্চ মাত্রাকে বিবেচনায় নিয়ে এই সেতু নির্মাণে মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে, যা একটি রেকর্ড। পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো সেতুতে পাইল এত গভীরে প্রবেশ করাতে হয়নি।
আরেকটি রেকর্ড হলো এতে ব্যবহৃত বেয়ারিং। পদ্মা সেতু নির্মাণে পিলার ও স্প্যানের মাঝে প্রতিটি ১০০ টন ওজনের ৯৬টি বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ্বে এর আগে এত বড় বিয়ারিং আর কোনো সেতুতে ব্যবহার করা হয়নি। এই বিয়ারিং ব্যবহারের ফলে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারবে সেতুটি।
এ ছাড়া নদীশাসনের কাজেও হয়েছে রেকর্ড। এই সেতু নির্মাণে ১৪ কিলোমিটার এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার এলাকায় নদীশাসন করা হয়েছে। মোট ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এই নদীশাসনের কাজটি করেছে চায়না সিনোহাইড্রো করপোরেশন। কোনো সেতু নির্মাণে নদীশাসনের জন্য এখন পর্যন্ত এত বড় চুক্তি আর কোথাও হয়নি।
এমনকি এ সেতু নির্মাণে ব্যবহৃত ক্রেনটিও রেকর্ড করেছে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা করে। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে এই প্রথম কোনো সেতু নির্মাণে এত দীর্ঘ সময় ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। ক্রেনটির বাজারদর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
আর সবচেয়ে বড় রেকর্ডটি তো করেছে পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো। এই সেতুই বিশ্বের প্রথম সেতু, যা কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত।
সেতুর বেশকিছু তথ্য :
* বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতুর পুরো নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’।
* সেতুটি নির্মাণের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে।
* এই সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড
* সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম AECOM।
* সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার (২০,২০০০ ফুট)
* প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার (৫৯.৪ ফুট)।
* নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর
* সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
* সেতুর নিকটতম সেনানিবাস হলো পদ্মা সেনানিবাস।
* প্রতিদিন গড়ে ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে।
* ভূমিকম্প সহনশীল মাত্রা ৯
* সেতুটির ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার এবং পিলার ৮১টি। মোট স্প্যান সংখ্যা ৪১।
* প্রতিটি স্পেনের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং প্রতিটি স্পেনের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন।
* সেতুর স্থানাঙ্ক ২৩.৪৪৬০ ডিগ্রি (উত্তর) এবং ৯০.২৬২৩ ডিগ্রি (পূর্ব)।
* পানির স্তর থেকে এই অত্যাধুনিক সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট এবং এর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট।
* সেতুর উপরের তলায় চার লেনের সড়ক এবং নিচতলায় থাকবে রেললাইন।
* সংযোগ সড়ক হচ্ছে জাজিরা ও মাওয়া
* সংযোগ সড়কের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার।
* দুই পাড়ে নদী শাসন ১২ কিলোমিটার
* মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে
* দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে সংযোগ ত্বরান্বিত হবে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক আজকের পত্রিকা