নিজস্ব সংবাদদাতা :
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে সংখ্যালঘু নির্যাতন থামছে না। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার সংখ্যালঘুদের মন্দির, বাড়িঘর, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের পর আবারো উপজেলার ফলদা গ্রামে গত ১২ জানুয়ারি মঙ্গলবার গভীর রাতে ফলদা কেন্দ্রীয় কালীমন্দির কমিটির সভাপতি সরণ দত্ত’র বাড়িতে দূর্বৃত্তরা অগ্নি সংযোগ করে। এ ঘটনায় প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি সাধিত হয়।
জানা যায়, গত ১২ জানুয়ারি হতে ফলদা কেন্দ্রিয় কালীবাড়িতে ৯ দিন ব্যাপি কালীপূজা ও মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করায় সরণ দত্তসহ প্রতিবেশী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজার্চনায় ব্যস্ত থাকেন। সুযোগ বুঝে দূর্বৃত্তরা মন্দির কমিটির সভাপতি সরণ দত্তের বাড়িতে গান পাউডার/পেট্রোল বা কোন প্রকার দাহ্য পদার্থ ঢেলে বা যে কোন উপায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। পূজাঙ্গন থেকে বাড়িতে ফেরার পথে সরণ দত্তের এক প্রতিবেশীর ডাক চিৎকারে মন্দির অঙ্গন থেকে প্রায় ২ শতাধিক ভক্ত দুর্ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক চেষ্টা চালায়। পরবর্তীতে ভূঞাপুর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন সম্পূর্ণ রূপে নিয়ন্ত্রণে আনে। এর মধ্যেই অগ্নিসংযোগে একটি টিনসেড বিল্ডিংসহ যাবতীয় আসবাবপত্র, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, দলিল দস্তাবেজ ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে ভস্মিভূত হয়। ঘটনার খবর পেয়ে পরদিন ১৩ জানুয়ারি সকালে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (টাঙ্গাইল উত্তর) মো. আসলাম খান, ভূঞাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান এড্ভোকেট আব্দুল হালিম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল আওয়াল, ভূঞাপুর পৌর মেয়র মাসুদুল হক, গোপালপুর পৌরসভার নব-নির্বাচিত মেয়র রকিবুল হক ছানা ও ভূঞাপুর থানার ওসি ফজলুল কবীর, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র সাহা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ (এক) লক্ষ টাকা নগদ অনুদান প্রদান করেন। এছাড়াও ভূঞাপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র এডভোকেট আব্দুল খালেক ম-ল, ফলদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম তালুকদার দুদু, উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি এডভোকেট গোলাম মোস্তফা, সম্পাদক সেলিমুজ্জামার তালুকদার সেলু, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক মিনহাজ উদ্দিন, ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজে সাবেক ভিপি মফিদুল ইসলাম লিটনসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আইন ও শালিস কেন্দ্রের কেন্দ্রিয় প্রতিনিধি দল, সুজন নেতৃবৃন্দ, উদীচীর প্রতিনিধি দল, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে নির্বাচন পরবতীতে সংখ্যালঘুদের বাড়ীঘরে হামলা, ২০১১ সালে স্থানীয় যুবলীগ নেতা’র নেতৃত্বে সুজন সুশাসনের জন্য নাগরিক ভূঞাপুর উপজেলা শাখার সম্পাদক সাংবাদিক সন্তোষ কুমার দত্তসহ আরো দুই শিক্ষক পরিবারে হামলা, ২০১৩ সালে ফলদা কেন্দ্রিয় কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগ, হামলা, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরপর এসব ঘটনায় স্থানীয় সংখ্যালঘুরা প্রতিবাদ জানালে ফলদার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শ্যাম শংকর দত্ত’র বাড়ির কেজি স্কুল ও স্বপন দত্ত’র বাড়ির মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, যতীন ঘোষের বাড়িতে প্রতিমা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ, পদন শীলের বাড়িতে খড়ের গাদায় আগুন লাগানোসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা করে।
সাংবাদিক সন্তোষ কুমার দত্ত এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানালে, একটি মহল তার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ৪টি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে দুটি হতে তিনি ইতিমধ্যে খালাস পেয়েছেন এবং দুটি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন আছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা ফলদায় চলমান সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট জোর দাবী জানান। ফলদা কেন্দ্রিয় কালী মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে জেলা প্রশাসক সংখ্যালঘুদের এ দাবী গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাকল্পে সরকারি অর্থে নৈশ প্রহরী নিয়োগ, এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও পূর্বাপর সকল ঘটনার একটি প্রতিবেদন জরুরীভিত্তিতে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের মাধ্যমের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়াও তিনি অদ্যাবধি সংখ্যালঘুদের উপরে যে সমস্ত নির্যাতন সংগঠিত হয়েছে, সেই সমস্ত ঘটনাবলীর জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে আইনী প্রতিকার চাওয়া হয়েছে সেগুলো পুনরায় খতিয়ে দেখতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
ঘটনার ব্যাপারে ভূঞাপুর থানায় সরণ দত্ত বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। যার নং- ০৬, তারিখ : ১৩-০১-২০১৬, ধারা : ৪৩৬/৫০৬ দ-বিধি। মামলার এজাহারে সরণ দত্ত উল্লেখ করেন, ২০১৩ সনে ফলদা কেন্দ্রিয় কালী মন্দিরে হামলা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় তিনি বাদী হওয়ার প্রেক্ষিতে উক্ত মামলার আসামীরা এহেন ঘটনা ঘটাতে পারে। তিনি আরো উল্লেখ্য করেন উক্ত মামলার বিবাদীরা তাকেসহ সাক্ষীদের বিভিন্ন পর্যায়ে হুমকি প্রদান করা হচ্ছে। এহেন ঘটনায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। ঘটনার পরই মন্দির আঙ্গিনায় পুলিশী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের পক্ষেও সংখ্যালঘু পল্লীতে পাহারা চৌকি বসানোর প্রস্তুতি চলছে।