:: অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ::
১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ কর্তৃক উদ্বোধন করা বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থার টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পীরগাছা ও চাঁদপুর রাবার বাগান, অনেকটা বেড়ানোর অছিলায় অাজ ঘুরে দেখলাম।
টাঙ্গাইলের মেজর জেনারেল
(অবঃ) মাহমুদুল হাসান তখন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী। তিনি ছিলেন মধুপুর রাবার বাগান প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা। তাকে সহযোগিতা করেন টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের সাবেক এমপি (পরে জাপার সাংসদ নির্বাচিত) খন্দকার আনোয়ারুল হক।
বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থার সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। আমার তখন ভরা যৌবন। ইয়ং কলেজ টিচার।টগবগে রক্তের তেজ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই মাঠ দাপিয়ে কাজ করি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এর উত্তর টাঙ্গাইল সংবাদদাতা হিসাবে।
সেদিনের অনুষ্ঠানের নিউজ কাভারেজে উপস্থিত হয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছিলাম। আমার সাথে ছিলেন অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার টাঙ্গাইল প্রতিনিধি এবং বর্তমানে স্বদেশ প্রতিদিনের এডিটর রফিকুল ইসলাম রতন।
এখন যেখানে পীরগাছা রাবার বাগান ব্যবস্থাপকের অফিস, সেখানে সুদৃশ্য উদ্বোধনী মঞ্চ করা হয়। ধনবাড়ী উপজেলার দড়িচন্দবাড়ী গ্রামের কাজী আসাদুজ্জামান ওরফে ছানা কাজী (মধুপুর উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন) এবং ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত জাসদের সাবেক এমপি, ইদিলপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার তখন মধুপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির নেতা। এরা লীগ ও জাসদ ছেড়ে জাপায় যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেদিন স্থানীয় জাপার পক্ষ থেকে মঞ্চে বক্তৃতার সুযোগ পান একমাত্র খন্দকার আনোয়ারুল হক। কারণ জাপা নেতা মাহমুদুল হাসান খন্দকার আনোয়ারুল হককে খুবই পছন্দ করতেন। খন্দকার আনোয়ারুল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ঢাবিতে বাম ছাত্র রাজনীতির সুবাদে সাবলীল বক্তৃতায় তিনি পটু ছিলেন।
তারপর এরশাদ জামানায় মধুপুর রাবার বাগান বিস্তৃত হতে হতে প্রায় সাত হাজার একরে দাড়ায়। পীরগাছা ও চাঁদপুরের পর পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুরেও সম্প্রসারিত হয় রাবার বাগান। প্রয়াত মেজর (অবঃ) মুরাদ আলী খান ছিলেন মধুপুর রাবার স্টেটের প্রথম পরিচালক।
ওই সময়ে মধুপুর বনাঞ্চলের গজারীসহ হাজারো প্রজাতির দেশি গাছপালা ও গুল্মলতাদি সাফ করে বিদেশী রাবার গাছের বাগানের তীব্র বিরোধিতা করেন পরিবেশবাদীরা। কিন্তু বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা ঘোষণা দেন- “বিদেশের মতোই এখানে সন্তোষজনক রাবার উৎপাদন হবে। অলাভজনক ক্ষয়িষ্ণু গজারী বন কেটে রাবার চাষে সরকার বহুলাংশে লাভবান হবে। দেশে কাঁচা রাবারের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি পূরণ করবে মধুপুর।”
যুক্তির স্বপক্ষে তখন মালয়েশিয়া থেকে পাঁচজনের একদল রাবার বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশে আনেন। তারা মধুপুরের মাটি ও জলবায়ু সরেজমিন পরীবীক্ষন শেষে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে জানান, মালয়েশিয়ার মতোই মধুপুরে সন্তোষজনক রাবার উৎপাদন হবে। বাণিজ্যিকভাবে সেটি লাভজনকও হবে।
এরপর সাত হাজার একর ক্ষীয়মান গজারী বন সাফ করে লাগানো হয় মালয়েশিয়ান রাবার চারা।
তখন বশিউস সোচ্চার ঘোষণা দেন- “বাগান উৎপাদনে গেলে সরকার বিদেশে রাবার রফতানী এবং আভ্যন্তরীন বাজারজাত থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাবেন।”
আরো আশ্বাস ছিল,কাঁচা রাবার সহজলভ্য হওয়ায় মধুপুরে অনেক রাবারজাত শিল্প স্থাপিত হবে। বাহারি রাবারজাত পণ্য উৎপন্ন হবে। হাজারো লোকের কর্মসংস্থান হবে।
১৯৯৩ সাল থেকে বশিউস রাবার কষ আহরণ শুরু করে। এখনো আহরণ চলছে। একমাত্র স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কনডম উৎপাদন কারখানার কাঁচামাল জোগান দেয়া ছাড়া স্থানীয়ভাবে রাবারজাত শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়নি। অথচ সেই সম্ভাবনাটিই ছিল উজ্জ্বল এবং সেটিই ছিল মূল লক্ষ।
তারপর বংশাই নদীর কতো স্বচ্ছজল মধুপুর হয়ে নিরবধি বয়ে গেছে। ঘড়ির ঘূর্ণায়মান কাটা বছর, যুগ পেরিয়ে টানা ৩৮ বছর সামলে নিয়েছে। আমার মতোই বাগানের এক কালের যৌবনদীপ্ত রাবার গাছ বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে গেছে। ক্রমাগত কষ আহরণের ফলে হাজারো জীর্ন রাবার গাছ রোগব্যাধিতে হাঁসফাস করছে।
আর দুতিন বছর পরই বাগানের বিশাল অংশের রাবার গাছ নিস্ফলা, নিরস বা শুকনো কাষ্ঠে পরিণত হবে। তখন কোটি কোটি টাকা খরচে সরকারকে আবার নতুন চারায়, নতুন বাগান করতে হবে।
লাভক্ষতির হিসাব এখন অন্ধকারে। তখন হয়তো আলোতে আসবে। তখনই জানা যাবে, লাভের গুড় পিঁপড়ায় কতোটা, কিভাবে খেয়েছে। চারদশকে সরকার কতোটা পাবার কথা ছিল, আর কতোটা পাওয়া গেছে।
ক্রমাগত একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাগান থেকে কোটি কোটি টাকার রাবার কষ চুরি যাচ্ছে। চুরির টাকায় মধুপুর শহরে অনেকই গাড়িবাড়ি করেছেন। বাগান স্টাফদের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতায় বাগানের রাবার গাছ অবাধে কেটে পাচার করছে দুবৃর্ত্তরা।
এছাড়াও বাগান স্টাফদের বল্গাহীন দুর্নীতি এবং সরকারি দলের চেলাচামুন্ডাদের রাবার বাগানের জমি জবরদখলে নিয়ে আনারস ও কলার আবাদ দিন দিন বাড়ছে।
এসবের সাথে মধুপুরের রাজনৈতিক লুটেরা সিন্ডিকেট গোঁফে তা দিয়ে বসে আছেন। কখন বাগানের জীর্ন ও রোগাক্রান্ত রাবার গাছ ক্লেয়ার ফেলিং হবে। নতুন রাবার চারা লাগানো আরম্ভ হবে। তখন গাছ কর্তন আর চারা রোপনের পাশা খেলার মজবায় ভূমি জবরদখলের কাজটি নিরাপদে সারবেন।
সাবেক সাংসদ খন্দকার আনোয়ারুল হক জানান, এখনো মধুপুরে ভারী রাবারজাত শিল্প স্থাপন করা গেলে এবং কাঁচা রাবার স্থানীয়ভাবে সদ্ভব্যহার হলে বাগান স্থাপনের লক্ষ ও উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব।
তবে বন লুটেরাদের কাজকর্ম ও হাবভাব স্পষ্টই বলে দেয়, এখানে ভারী রাবারজাত শিল্পস্থাপনের চিন্তা নেই। যেভাবে মধুপুর গজারী বনের পঁয়ত্রিশ হাজার একর বনভূমি নানাভাবে সামন্তপ্রভূরা দখলে নিয়েছেন, তেমনিভাবে রাবার বাগানের ৭ হাজার একর ভূমি এখন হাঙ্গরের উদরস্থ হবার অপেক্ষায়। সময়ই বলে দেবে কোন নেতা, কতটুকু জমিতে তাদের জমিদারির ছড়ি ঘুরাবেন।
আসুন, আমরা সবাই সেই ছড়ি ঘুরানো দিনের অপেক্ষায় থাকি। লুটেরাদের মঙ্গল হোক। আমীন। আল্লাহুমা ছুম্মা আমীন।
পরিচিত :
অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, সিনিয়র করোসপন্ডেন্ট দৈনিক ইত্তেফাক এবং সম্পাদক : www.gopalpurbarta24.com