সন্তোষ কুমার দত্ত : শারদীয় দুর্গোৎসব ১৪২৫। আজ ১৫ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে শুরু হওয়া এ উৎসব ১৯ অক্টোবর বিজয়ী দশমীতে শেষ হবে। দুর্গাকে দুর্গতিনাশিনী দেবী হিসেবে আরাধনা করা হয়। আরাধনার মূল বিষয়টিই দুর্গতিনাশ। দেবতা বা দেবী- যাঁকেই ভক্তি, আরাধনা করুন না কেন, তাঁর একটি প্রার্থনা থাকে। সে প্রার্থনা হচ্ছে, যেন তাঁর দুর্গতি দূর হয়। এ দুর্গতি দূর হওয়ার ব্যাপারটি জগতের হতে পারে, জগতোত্তরও হতে পারে। জগতের হতে পারে এ অর্থে যে, ভক্ত চাইছেন, তিনি জীবনযাপন করতে গিয়ে যেসব দুর্গতির মধ্যে পড়েছেন, সেগুলো যেন দূর হয় বা চাইছেন মৃত্যুর পর তিনি যেন কোনো দুর্গতির মধ্যে গিয়ে না পড়েন। ফলে প্রার্থনা জগতের জন্যেও, জগতোত্তরের জন্যও। কিন্তু অন্য কোনো দেবী বা দেবতা বিশেষভাবে দুর্গতিনাশের জন্য অভিহিত হচ্ছেন না। শুধু দুর্গাকেই দুর্গতিনাশিনী বলা হচ্ছে। এর সঠিক কারণ কী, সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। তবে পন্ডিতরা ভেবে থাকেন, দুর্গাকে দুর্গতিনাশিনী বলা হয় বিশেষভাবে এ জন্য যে তিনি দুর্গতি মোচনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণটি রচনা করেন এবং যে দুর্গতিটি তিনি মোচন করেন, সেটিও সব দুর্গতির সেরা।
পৌরাণিক সাহিত্য একটি বিশাল বিষয়। ভারতবর্ষে প্রাচীনকালে যে বিস্ময়করভাবে বিশাল পৌরাণিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, এর কোনো তুলনা পৃথিবীতে নেই। গ্রিক পুরাণ আছে, ভারতবর্ষের পৌরাণিক সাহিত্যের পরই এর স্থান। তবে গ্রিক পুরাণ এখন শুধুই অতীতের বিষয়, সাহিত্যে কখনো কখনো এর কোনো না কোনো বিষয় বা চরিত্রের উল্লখ করা হয়। কোনো প্রকার পুজা বা আচারের সঙ্গে এর কোনো সজীব সম্পর্ক এখন আর নেই। তবে ভারতবর্ষের পৌরাণিক সাহিত্য এখনো সমাজের সজীব আচরণের মধ্যে প্রচÐ স্থান করে আছে। শুধু অষ্টাদশ পুরাণ বলে কথা নয়, মূল পুরান নিয়ে কত যে উপপুরাণ রচিত হয়েছে, এর কোনো কূল করে ওঠা প্রায় অসম্ভব। কেননা এ উপপুরাণগুলো ক্লাসিক্যাল স্তরে যেমন রয়েছে স্বল্পসংখ্যায়, লৌকিক স্তরে এসে এর সংখ্যা প্রায় অগণিত হয়ে উঠেছে। ক্লাসিক্যাল পুরাণে যেমন ক্লাসিক্যাল দেব-দেবী নিয়ে কথা হয়েছে, লৌকিক পুরাণে লৌকিক দেব-দেবী নিয়ে কথা হয়েছে। পুরাণের এ উভয় সংস্করণে, কাহিনী যে সব সময় এক রকম রয়েছে, তা নয়, পার্থক্য হয়েছে, হওয়াই স্বাভাবিক। যেহেতু সাহিত্যের বুদ্ধি ধর্মবুদ্ধির সঙ্গে এসে মিলিত হয়েছে। দুর্গা সম্পর্কে আমরা ক্লাসিক্যাল পৌরাণিক সাহিত্যেও জানতে পারি, লৌকিক-পৌরাণিক সাহিত্যেও তাঁর গুণব্যাখ্যানের শেষ নেই। তবে শারদীয় দুর্গোৎসব যেভাবে বাঙালি হিন্দুসমাজ পালন করে থাকে, তার ভিত্তি হচ্ছে ক্লাসিক্যাল পুরাণ। তিনি ক্লাসিক্যাল ধর্মসাহিত্যে বর্ণিত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এক দেবী, যিনি মহিষাসুরকে হত্যা করে স্বর্গরাজ্যকে দেবতাদের জন্য মুক্ত করে দেন। এখানেই আসে তাঁর দুর্গতিনাশিনী রূপের প্রশ্নটি। যে কথা আমি এর আগে উল্লেখ করেছিলাম, দুর্গতিনাশ করে সব দেব-দেবীই, শুধু শ্রীদুর্গাকেই দুর্গতিনাশিনী বলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে পন্ডিতদের মতটি উপস্থাপন করাই আমার বর্তমান উদ্দেশ্য। অসুর একসময় স্বর্গ দখল করে নিল। দেবতারা প্রাণভয়ে স্বর্গ ত্যাগ করে যে যেভাবে পারলেন পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন। দুর্গা সেই স্বর্ণজয়ী অসুরকে সংহার করে দেবতাদের জন্য স্বর্গভূতিকে নিরাপদ করে দিলেন। স্বর্গ বলতে বোঝাচ্ছে- আদর্শলোক, সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান, দেবতার বাসভূমি। অসুর বলতে বোঝায়- ভয়ংকর, জ্ঞানদ্বেষী পেশিশক্তি। সে কারো পরোয়া করছে না, সে এতটাই উদ্ভটভাবে অহংকারী ও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে দেবতাদের স্বর্গ থেকে উচ্ছেদ করতেও সে পিছপা হচ্ছে না। অর্থাৎ সে যা কিছু মঙ্গলকর, যা কিছু জ্ঞানকর, যা কিছু কল্যাণময়, যা কিছু স্বপ্নের, যা কিছু সাধনার, যা কিছু শ্রেয়- সব কিছুকেই সে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অসুর যা করছে, তা কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয় নয়, সে সামগ্রিকভাবে মঙ্গলকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে এবং তাতে সে সাফল্য অর্জন করতে দেওয়া যায় না। যেভাবেই হোক, তাকে তো পরাস্ত করতেই হবে। মঙ্গলকে তো নিরাপদ করতেই হবে। মঙ্গলের বা শুভের নিরাপত্তা বিধান করলেন দেবী দুর্গা। তিনি অজ্ঞান, অহমিকায় অন্ধ পেশিশক্তিকে নাশ করলেন। তাঁর এ অসুরনাশন কোনো নির্দিষ্ট একটি ঘটনার সীমায় আবদ্ধ নয়। অসীম এর ব্যঞ্জনা, কালজয়ী এর অনুষঙ্গ, পৌরাণিক হয়েও রূপক আকারে এ ঘটনা অতি আধুনিক। দুর্গার সঙ্গে রইলেন ল²ী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। লক্ষী ধনশক্তি, সরস্বতী জ্ঞানশক্তি, কার্তিক শারীরিক শক্তি ও গণেশ সিদ্ধির প্রতীক দেবতা। দুর্গার সঙ্গে এরাও পূজিত হয়ে আসছেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, পন্ডিতরা যেমন জানাচ্ছেন, অশুভের বিরুদ্ধে যদি সংগ্রামে জয়লাভ করতে হয়, তাহলে আমাদের ধনশক্তি দরকার, জ্ঞানশক্তি দরকার, শারীরিক শক্তি দরকার এবং সর্বোপরি দরকার সিদ্ধি, যে সিদ্ধির দেবতা গণেশ। গণেশ কথাটির অর্থ হচ্ছে, সর্বসাধারণের হিতকারী। তিনি মুষ্টিমেয়ের হিত করেন না, সবার হিত করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, দুর্গা যে বিপদনাশের জন্য যুদ্ধ করলেন, জয়লাভ করলেন, তার ফল দিয়ে তিনি সর্বসাধারণের মঙ্গলের বিষয়টি নিশ্চিত করলেন। সেই জয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ জয়, যার দ্বারা সর্ব সাধারণ জয়ী হয়। পৌরাণিক সাহিত্যে বহু প্রশংসিত, বহুভাবে বন্দিত মহাদেবী এ মহাবিজয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দুর্গতিনাশিনীর মহাবিশেষণে বিভূষিত হলেন। তিনি শুধু পুরাণে রইলেন না, আমাদের জীবনে চলে এলেন। আমাদের সমকালীন পৃথিবীর বহু ঘটনাকে এ মহারূপকের ব্যঞ্জনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। শ্রীদুর্গা এ অর্থে চিরপ্রবীণ ও চিরনবীন। তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন, চিরকাল তিনি আমাদের দ্বারা পূজিত হবেন।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী।