– অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন
মধু থেকে নাম হয়েছে মধুপুর। নামকরণ নিয়ে অনেক বিতর্কের মধ্যে এটিকেই সমর্থন করেন অধিকাংশ মানুষ। বলছিলাম শতাব্দী প্রাচীন মধুপুর ক্লাবের কথা। মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের গোল চত্বরের আনারস মূর্যাল বামে রেখে ময়মনসিংহগামি সড়ক ধরে একশগজ এগুলেই মধুপুর ক্লাব ভবন। অনেক ইতিহাস, ঘটনা, দুর্ঘটনার অনুঘটক হয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে এ ক্লাব ভবন। এ ভবনেই পঁচাত্তরে দুর্বৃত্তের গুলিতে প্রাণ হারান আওয়ামীলীগ নেতা, মধুপর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং রাণীভবানী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় মহেন্দ্র লাল বর্মণ। সময়ের বির্বতনে টিনশেড ভবন বহুতল ভবনে রুপান্তর হয়েছে। চাক্যচিক্য বেড়েছে। বেড়েছে আয়রোজগার। কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক সচেতন মানুষ ক্লাব গঠন করেছিলেন তা খেঁই হারিয়েছে। এখন এ ক্লাবে দিনরাত তাসের নামে জুয়া চলে। সময়সুযোগ মতো গরম পানিতে গলা ভেজানোর জলসা বসে। মধুপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চায় ক্লাবটি একবারেই বিমুখ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এ প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটির এ দৈন্যদশা সকলকে হতাশ করছে।
জানা যায়, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ, বাংলা ১৩৪৫ সালের ২২ ফাল্গুন পৌরশহরের চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাবের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা রাখেন রাণীভাবনী হাইস্কুলের গণিতের শিক্ষক ডাবল এম এ কৃতাংত চক্রবর্তী। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন চাড়ালজানির নিয়োগী পরিবারের ডাক্তার অমলেশ গূহ, চাড়ালজানির ফরেস্টার জিতেন বোস, জগবন্ধু সাহা, ভট্রাড়ির ধীরেন চক্রবর্তী, রামনগরের ললিত গোস্বামী, সংগ্রাম শিমূলের জগেশ্বর সিংহ এবং মধুপুরের চৌধুরী পরিবারসহ অনেক ত্যাগি মানুষ। চৌধুরী বাড়ির প্রয়াত পাবর্তীনাথ চৌধুরী (বাঘা বাবু) ক্লাবকে হারমোনিয়াম এবং তবলা উপহার দেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সুশীল চন্দ্র ভট্রাচার্য এবং সম্পাদক যজ্ঞেশ্বর লাল সিংহ। মহারাণী হেমন্ত কুমারীর পুঠিয়া রাজ এস্টেটের দেওয়ান সুরেন্দ্র নাথ মৈত্র চৌধুরীর বাড়ির খগেন্দ্র নাথ চৌধুরীর সাথে আত্মীয়তার সূত্রে বর্তমান স্থানটি মধুপুর ক্লাবকে ব্যবহারের প্রাথমিক অনুমতি দেন। পরে রামচন্দ্রপুর কাচারির অব্যবহৃত টিনের ঘর ভেঙ্গে এনে চালু হয় ক্লাব।
শুরু থেকেই এ ক্লাব মধুপুর ও এর আশপাশের উপজেলায় ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি নিজস্ব বলয় তৈরি করে। জামালপুরের দিগপাইত জমিদার ফুটবল টুর্ণামেন্ট চালুর জন্য মধুপুর ক্লাবকে দুটি রৌপ্য নির্মিত শিল্ড উপহার দেন। এ শিল্ড নিয়ে প্রতিযোগিতায় কোলকাতা ও কোচবিহার থেকে নামিদামি ফুটবলাররা রাণীভবানী মাঠে লড়াই করেছে। ক্লাবের উদ্যোগে প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হতো যাত্রা ও নাট্যোৎসব। ভারতেশ্বরী হোমসের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক বঙ্কিম চন্দ্র চক্রবর্তী মধুপুর রাণীভবানী হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলে নাট্য চর্চা সাথে শিল্প চর্চার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। সে এক সোনালি ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্ম তা জানেনা। জানতেও চায়না।
সাতচল্লিশে দ্বিজাতি তত্বের খগড়ে বলি হয় বাংলা ও বাঙ্গালী। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, রক্তক্ষয় ও দেশভাগের পরেও মধুপুরের বনেদী ও শিক্ষিত হিন্দু পরিবার দেশ মাতৃকার টানে ওপারে চলে যায়নি। এজন্য পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে মধুপুর ক্লাবকে কেন্দ্র করে পালিত হতো জাতীয় উৎসব ও নববর্ষ। ঈদ ও পুজাপার্বনে নানা সাংস্কৃতিক আবহে মধুপুর জেগে উঠতো। ব্রিটিশ রাজত্বে মধুপুর, রামনগর, ভট্রবাড়ি, সংগ্রামশিমুল, চাড়ালজানি গ্রামে পারিবারিক বলয়ে উদার সংস্কৃতি চর্চা হতো। গড়ে উঠেছিল অনেক জলসা ঘর। যা প্রভাবিত করেছিলো মধুপুর ক্লাবকে। এরপর মধুপুর শহর ভেদ করে যাওয়া বংশাই নদীর পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। একাত্তরে পাকিস্তানের সমাধির পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে এর সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ও যাবতীয় সরঞ্জাম ধবংস হয়।
বর্তমানে ক্লাবের উদ্যোগে কোনো সৃজণশীল কাজ হয়না। ১৯৭৬ সালে সর্বশেষ ডি ভৌমিক রচিত‘ রতন বাঈ’ মঞ্চত্ব হওয়ার পর ক্লাবের উদ্যোগে আর কোনো নাটক বা যাত্রা পালা অনুষ্ঠিত হয়নি। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার সাথে ক্লাবের কোনো সম্পর্ক নেই। জুয়ায় তাস পিটিয়ে ক্লাবটিকে বন্ধ্য বানানোর অভিযোগ সচেতন মহলের। আগামী ২২ ফাল্গুন মধূপুর ক্লাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এ দিনে ক্লাবের সাথে টানা ৫২ বছর জড়িত খগেন্দ্র নারায়ন নাথ চোধূরীকে ওরফে বেথুল বাবুকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।