রাজশাহী প্রতিনিধিঃ রাজশাহী ও নাটোরে রাষ্ট্র পরিচালিত তিন চিনিকলে গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের আখ মাড়াই মৌসুম। এবারো তিনটি চিনিকল আখ মাড়াই শুরু করছে বিপুল পরিমাণ লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে। এদিকে বেশি লাভ হওয়ায় কৃষকরা নিজেই পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করে গুড় করে বিক্রি করছে। চলতি মৌসুমে চিনিকলগুলো তাদের চাহিদা মোতাবেক আখ কৃষকের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে না পারলে এবারও লোকসানে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আখের অভাবে এসব মিল নির্ধারিত সময়ের আগেই মাড়াই বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা।
সূত্রমতে, বিগত ২০ বছরে ১৪২ কোটি টাকা লোকসান দেয়া রাজশাহী চিনিকল এবার মৌসুমের শুরুতেই বিপুল পরিমাণ অর্থ সংকটে পড়েছে। আখ ক্রয়ের জন্য মিলের পক্ষ থেকে গত ৪ নভেম্বর ১০কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয় সরকারের কাছে। কিন্তু বর্তমানে এ টাকার যোগান না থাকায় চাষীদের কাছ থেকে আখ কেনার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সুগার মিল সূত্রে জানা যায়, আর্থিক সংকট ও জ্বালানি খরচ বাবদ সরকারি অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় এরই মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে মৌসুমী আখ মাড়াই শুরুর কাজ তারিখ দু’বার পেছানো হয়। সর্বশেষ পরিবর্তিত তারিখ অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার থেকে আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়।
রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রফিক অর্থ বরাদ্দ প্রসঙ্গে বলেন, আশা করি শিগগিরই প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে। আখ মাড়াইয়ের তারিখ পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলেন, নভেম্বরের শুরুতে টানা বৃষ্টি ও আবহাওয়ার কারণে আখ মাড়াই উদ্বোধনের তারিখ ৯ নভেম্বরের পরিবর্তে ১৬ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়।
রাজশাহী চিনিকলের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিয়ারুজ্জামান বাংলাদেশ টাইমসকে জানান, চলতি আখ মাড়াই মৌসুমে রাজশাহী চিনিকলে ১লাখ ৩০হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ৯হাজার ৪২৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের শতকরা হার ধরা হয় ৭.২৫ ভাগ। এবছর চিনিকলের নিজস্ব ও চাষীদের মিলে ১৯ হাজার ৮৩ একর জমিতে আখচাষ করা হয়েছে। এছাড়া চিনি অবিক্রিত রয়েছে ১ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন।’
রাজশাহী চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল কাদের মোল্লা বাংলাদেশ টাইমসকে জানান, গত বছর চাষীদের আখের মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা প্রয়োাজনীয় আখ সরবরাহ পাননি। ফলে ৩১ ডিসেম্বর চিনিকল বন্ধ করে দিতে হয়। চলতি মৌসুমেও সরকার টাকা বরাদ্দ না দিলে মিল চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। রাজশাহী চিনিকল অর্থ সংকটে ভুগছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অবস্থায় মিলের নিজস্ব টাকায় আখ কেনা সম্ভব নয়।
এর আগে বিগত তিন বছরে চিনিকল দু’টিতে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। চিনিকল এলাকায় ক্রাশার মেশিনে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি, আখের স্বল্পতা এবং উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে চিনির দাম নির্ধারণ করায় নাটোরের চিনিকল দ‘ুটি বিগত সময়ে এই লোকসানের ঘানি টানছে বলে জানা যায়।
এদিকে, নাটোর চিনিকল সূত্র জানায়, চলতি ২০১২-১৩ আখ মাড়াই মৌসুমে নাটোর চিনিকলে ২ লাখ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১২ হাজার মেট্রিকটন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের গড় হার ধরা হয়েছে ৭.৫০ ভাগ। এজন্য মিল জোন এলাকায় ২১ হাজার ৫১০ একর জমিতে আখচাষ করা হয়েছে। আখের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার টন। এর আগে ২০০৯-১০, ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি প্রায় ৪৮কোটি ৮৮লাখ টাকা লোকসান করে।
নাটোর চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক কৃষি মোহাম্মাদ আলী বাংলাদেশ টাইমসকে বলেন, প্রতিদিন মিল জোন এলাকায় ৫ শতাধিক অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার মেশিনে আখ মাড়াই চলছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ সরকার নির্ধারিত মিলগেটে প্রতিমণ আখ ১’শ টাকা এবং মিল গেটের বাইরে ৯৭.৫০ টাকা মণ দরে আখ কিনছে। কিন্তু অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার মালিকরা আখ কিনছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা মণ দরে। যে কারণে মাঠে আখ থাকলেও চাষীরা বেশি দামের আশায় চিনিকলে আখ সরবরাহে আগ্রহ হারাচ্ছে।
নাটোরের অপর চিনিকল নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল সূত্র জানায়, তারা চলতি বছর ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১৮ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চিনি আহরণের গড় হার ধরা হয়েছে ৭.৫০ ভাগ। চলতি মৌসুমে মিলের নিজস্ব কৃষি খামারসহ মিল এলাকায় ২৭ হাজার ৫০০ একর জমিতে আখচাষ করা হয়েছে। আখ উৎপাদিত হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। গত তিন মৌসুমে চিনিকলটির লোকসান হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহাবুবুর রহমান বাংলাদেশ টাইমসকে বলেন, বর্তমানে মিল জোন এলাকায় ৭ শতাধিক বিদ্যুৎ চালিত অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার মেশিনে অবাধে অকুতভয়ে আখ মাড়াই চলছে। ক্রশারের মাধ্যমে প্রতিদিন এখানে গড়ে আড়াই হাজার মেট্রিক টন আখমাড়াই করে গুড় তৈরি হচ্ছে। যা চিনিকলের (১৮’শ মেট্রিক টন) প্রতিদিনের মাড়াই ক্ষমতার চেয়েও বেশি। এভাবে চলতে থাকলে মিলে আখ সংকটের কারণে লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে।