আওয়ামী লীগ সরকারের গত চার বছরে বিএনপির নেতাকর্মীসহ দুই শতাধিক গুম-গুপ্তহত্যার ঘটনায় এমনিতেই আতঙ্কে ছিলো বিএনপি। ঢাকা মহানগর বিএনপির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজুমদারের হাতকড়া পরা অবস্থায় লাশ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে উদ্ধার পাওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে।
বিএনপির অনেক নেতা বলেছেন, হাতকড়াসহ রফিকুল ইসলামের লাশ উদ্ধার পাওয়ার পর দলের নেতাকর্মীদের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। দলের শীর্ষ মহলও এ ঘটনায় চিন্তিত। নেতারা জানান, দলের উচ্চ পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদেরকে চলা ফেরার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
মতিঝিল থানা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ বলেন, “রফিকুল ইসলামকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই আমরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি। আসলে দলের সব নেতাকর্মীই এখন আতঙ্কের মধ্যে আছেন।”
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এর আগে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। একইভাবে গুম হন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী।
এখন পর্যন্ত র্যা ব বা পুলিশ কেউই তাদের কোন সন্ধান দিতে পারেনি। এদের পরিবারের পক্ষ থেকে বার বার অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের গুমের সাথে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত।
তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, “চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলীর মত একইভাবে নিখোঁজ হয়েছে ছাত্রদল, যুবদল, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও বিরোধী মতের মানুষ। নিখোঁজ হওয়ার পর কারও কারও লাশ পাওয়া যায় নদীতে, ডোবায়, জঙ্গলে ও ঝোঁপের মধ্যে। আর অনেকের খোঁজ আজও মেলেনি।
বিএনপি নেতারা বলেন, তাদের সবাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে সাদা পোশাকে। এসব নিখোঁজের ঘটনায় মামলা অথবা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও রহস্য উন্মোচিত হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো দপ্তরও তদন্ত করে একটি ঘটনারও তথ্য দিতে পারেনি। আদালত প্রকৃত ঘটনা জানতে নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্টরা এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারেনি। এতে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। গুম হওয়ার আশঙ্কায় নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন এখন অনেকেই।
সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ছাপিয়ে তুমুল সমালোচনার খোরাক জুগিয়েছে গুম, খুন, অপহরণের ঘটনা। একাধিক মানবধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে ১৩ হাজার ৮৪৯ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গুম হয়েছে ১১৩ ও ক্রসফায়ারে মারা পড়েছে ৪৯৫ জন। এ সময়কালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৭৭৫ জন।
চার বছরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, “জনসংখ্যার বিচারে পুলিশের রেকর্ড করা অপরাধের পরিসংখ্যানে কোন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। বেশিরভাগ অপরাধের রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।” মূলত: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে দাবি করেন তিনি।
গত চার বছরে দেশে প্রায় ১ হাজার ৩শ’ ৪৩ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে গুম হয়েছে ১৫৬ জন। গুম হওয়ার পর ২৮ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে নদীতে, ডোবায়, জঙ্গলে ও ঝোপের মধ্যে। বেসরকারি সংগঠন অধিকারের হিসাবে, গত বছর (নভেম্বর পর্যন্ত) গুমের ঘটনা ঘটে ২৪টি। ২০১১ সালে ঘটেছিল ৩০টি।