আজ || রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
শিরোনাম :
  অবশেষে গোপালপুরে বিরল রোগে আক্রান্ত পরিবার সুচিকিৎসা পাচ্ছেন       গোপালপুর-ভূঞাপুর যমুনা চরাঞ্চল এখন মাদক আর দুস্কৃতকারিদের অভয়ারণ্য       গোপালপুরে কৃষক জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করতে কৃষক সমাবেশ       খোরশেদুজ্জামান মন্টুকে এলাকাবাসি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসাবে দেখতে চান       গোপালপুর উপজেলা পরিষদ স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা       গোপালপুরে কুরতুবী মাদ্রাসার উদ্ধোধন       সালাম পিন্টুর মুক্তির আনন্দে গোপালপুরে মোটরসাইকেল র‍্যালি       গোপালপুরে জাসাস এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত       গোপালপুরে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সম্মেলন       গোপালপুরে বিনামূল্যে সহস্রাধিক শীতবস্ত্র বিতরণ    
 


এ হয়রানির শেষ কোথায়! তদন্তে নির্দোষ, তবুও বন্ধ বেতনভাতা

জয়নাল আবেদীন :

মরিয়ম খাতুন গোপালপুর উপজেলার চাতুটিয়া এ এম মজিবর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিষয়ের সহকারি শিক্ষক। ২০০২ সালে তিনি এমপিওভূক্ত হন। তার ইনডেক্স নাম্বার ৪৮৮১০২। মেধাবী শিক্ষক হিসাবে তার যথেষ্ট পরিচিতিও রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি বিতর্কিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনের দরুন জাল সনদের বানোয়াট অভিযোগে টানা সাত বছর ধরে তিনি চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি তার বেতনভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি।

জানা যায়, ২০০১ সাল তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বগুড়ার নট্রামস থেকে কম্পিউটার সাইন্স ও টেকনোলজি বিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেন। সনদ যাচাইবাছাইয়ের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির সুপারিশে নিয়োগপত্র প্রদান ও এমপিওভূক্ত হন। ২০০২ সালের ২৬ আগষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারাদেশে কম্পিউটার বিষয়ে সহকারি শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়া ২৮৬ জনের জাল সনদপত্র অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য বগুড়ার নট্রামসকে নির্দেশ দেন। নট্রামস তদন্ত শেষে ২০০৩ সালের জুন মাসে মন্ত্রণালয় যে তালিকা পাঠান তাতে ৭৭ জনের সনদ জাল ধরা পড়ে। কিন্তু মরিয়ম খাতুনসহ অবশিষ্টদের সনদ বৈধ বলে জানানো হয়।

এ এম মজিবর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু মো. শফিউল আলম জানান, ২০১৫ সালের ১৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তিনি মরিয়ম খাতুনের শিক্ষা সনদ জাল ঘোষণা দিয়ে সরকারি বেতনভাতার ১২ লক্ষ টাকা ফেরত দেয়ার চাপ দেন।

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা জানান, সকল শিক্ষকের সামনে ওই পরিদর্শক ৫ লক্ষ টাকা নজরানায় বিষয়টি ফয়সালার প্রস্তাব দেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ নট্রামস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যাছাইবাছাই তালিকার রেফারন্স দেখিয়ে জাল সনদের অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করেন। পরবর্তীতে ওই পরিদর্শক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অডিট আপত্তিতে জানান যে, মরিয়ম খাতুনের সনদ জাল এবং তার যাবতীয় বেতনভাতা ফেরতযোগ্য। এমতাবস্থায় মাউসি টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে জাল সনদের বিষয় তদন্তের নির্দেশ দেন। সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার মো. শফিউল্লাহ নট্রামসের মাধ্যমে যাছাই শেষে ১৯/৪/২০১৬ তারিখ এক তদন্ত প্রতিবেদনে মাউসির মহাপরিচালক জানান, মরিয়ম খাতুনের সনদটি জাল নয়। কিন্তু এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সন্দেহ দূর হয়নি। তিনি মাউসিকে পুনরায় টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে পুনঃ তদন্ত করে জাল সনদের বিষয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (সাবেক) লায়লা খানম সনদটি জাল নয় বলে জানান। কিন্তু এতেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সন্তুষ্ট হয়নি। অবশেষে মন্ত্রণালয় ২০১৬ সাল পুনরায় নট্রামসকে মরিয়ম খাতুনের সনদ যাছাইয়ের নির্দেশ দেন। নট্রামস পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদনে মরিয়ম খাতুনের সনদ সঠিক বলে জানায়। কিন্তু এবারো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সন্দেহ শেষ হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা পুনরায় নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকেন। এমতাবস্থায় ২০১৭ সালে কম্পিউটার বিষয়ে জাল সনদ সন্দেহে সারাদেশের যে ৩১ জন সহকারি শিক্ষকের তালিকা যাছাইয়ের জন্য দুর্নীতি দমণ কমিশনে পাঠানো হয়, সেখানেও মরিয়ম খাতুনের নাম পুনরায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। দুর্নীতি দমণ কমিশন ২০১৭ সালের ৭ জুলাই নট্রামসের রেফারন্স দিয়ে অনুসন্ধান রিপোর্টে ১৫ জনের সনদ জাল এবং মরিয়ম খাতুনসহ ১৬ জনের সনদ বৈধ বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেন। একই সাথে মরিয়ম খাতুনসহ বৈধ সনদধারি ১৬ জনকে মিথ্যা অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু দুর্নীতি দমণ কমিশনের ওই সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কানে তোলেনি। গত অক্টোবর মাসে জাল সনদের অভিযোগে মরিয়ম খাতুনের এমপিও বন্ধ এবং উত্তোলিত সরকারি বেতনভাতার সব টাকা পরিশোধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অডিট পার্টি অনেক পাওয়ারফুল। সামান্য ত্রুটি পেলেই তারা প্রকাশ্যে বিপুল নজরানা দাবি করে থাকেন। অডিট পার্টির নিকট বেসরকারি শিক্ষকরা যে কতোটা অসহায় মরিয়ম খাতুন তার নমুণা।

শিক্ষক মরিয়ম খাতুন অভিযোগ করেন, স্বল্প বেতনের চাকুরিতে এমনিতেই সংসার চলেনা। তাই পরিদর্শকের দাবিকৃত অঙ্কের নজরানা দেয়া সম্ভব ছিলনা। এ অপরাধে তিনি এখন বছরের পর বছর ধরে টাঙ্গাইল থেকে বগুড়া আবার বগুড়া থেকে ঢাকা বা টাঙ্গাইলের নানা অফিস ঘুরতে ঘুরতে পেরেশান হয়ে গেছেন। এর মধ্যে তিন মাস আগে এমপিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থসংকটে পরিবারপরিজন নিয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। কলেজ ভার্সিটিতে পড়া দুই সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। চরম হয়রানি থেকে রেহাই পেতে কারো কোন সহযোগিতা পাচ্ছেননা। তিনি মানবিক কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

গোপালপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং সম্পাদক যথাক্রমে জিএম ফারুক এবং শফিকুল ইসলাম তালুকদার অভিযোগ করেন ৭/৮ বছর পর পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অডিট পার্টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অডিট করে থাকেন। অডিটে ছোটখাটো ত্রুটি পেলেই নজরানা আদায়ের কসরৎ শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক কর্মচারির সকলের এক মাসের বেতনভাতা নজরানা বাবদ তাদের নিকট সমর্পন করতে হয়। কেউ তাদের কথা না শুনলে অডিট আপত্তি তুলে মরিয়ম খাতুনের মতো হয়রানি করা হয়। ভয়ে সব প্রতিষ্ঠান তাদেরকে নজরানা দিতে বাধ্য হয়। বহুস্থানে অভিযোগ দিয়েও কোটি কোটি টাকার নজরানা বন্ধের প্রতিকার পাওয়া যায়না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসবের সাথে জড়িত বলে তাদের ধারনা।

গোপালপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জুলফিকার হায়দার জানান, তিনি এখানে নতুন এসেছেন। এটি অনেক পুরনো বিষয়। ঘটনাটি শুনে তিনি অবাক হয়েছেন। মরিয়ম খাতুন যাতে হয়রানি মুক্ত হন এজন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত আবেদন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে যথা নিয়মে সুপারিশ করা হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানা জানান, ওই শিক্ষকের হয়রানি বন্ধের একটি আবেদন গত সপ্তাহে শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নট্রামসের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, জাল সনদ নিয়ে কম্পিউটার বিষয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকেই চাকুরি করছেন এমন অভিযোগ বহু পুরনো। বিগত দুই দশকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমণ কমিশনের নির্দেশক্রমে কয়েক হাজার সনদপত্র যাচাই করা হয়েছে। বহু সনদ জাল বলে সনাক্ত হয়েছে। কিন্তু মরিয়ম খাতুনের সনদ জাল নয়। বিগত দুই দশকে এটি পাঁচবার যাচাই করা হয়েছে। কিন্তু এ সনদটি কেন বার বার যাছাই করতে দেয়া হয় তা নট্রামসের নিকট বোধগম্য নয়। এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক অডিটর মো. ছালেহ উদ্দীন শেখের সেলফোনে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়া মাত্র তিনি লাইন কেটে দেন।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!