কে এম মিঠু, গোপালপুর :
আজ ১০ ডিসেম্বর গোপালপুরের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জল দিন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় ৮ মাস পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক গোপালপুরবাসী হত্যা, ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতনের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে টাঙ্গাইলের গোপালপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে গোপালপুর থানা দখল করে মুক্তির স্বাদ লাভ করে।
পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৪ বছরের দুঃশাসন, বৈষম্য, অত্যাচার ও নির্যাতনের ফলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিশ্বের বুকে অভ্যূদয় ঘটে বাংলাদেশ নামক দেশটির। ২৫ মার্চ ৭১’র কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তার ধারাবাহিকতা সারাদেশে চালাতে থাকলে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে গোপালপুরের বীর জনতা দেশের অবস্থা অনুধাবণ করতে পেরে সংগঠিত হয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে।
টাঙ্গাইল জেলার উত্তরে অবস্থিত গোপালপুর থানা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর নিকরাইল রাণী দিনমনি হাইস্কুলে ৭০ জন কমান্ডারের মিটিংয়ে কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী গোপালপুর থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকজন কোম্পানী কমান্ডারকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়া কোম্পানী কমান্ডারগণ হলেন- নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানী, আব্দুর রাজ্জাক ভোলা কোম্পানী, আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানী, বকুল কোম্পানী, আব্দুল হাকিম কোম্পানী, নূরুল ইসলাম কোম্পানী, আনিসুর রহমান আনিস কোম্পানী ও খন্দকার হাবিবুর রহমান কোম্পানী। এদের মধ্যে চারটি কোম্পানীর প্রতিনিধিদের নিয়ে বর্তমান ভূঞাপুর উপজেলার পাঁচটিকড়ি নামক স্থানে পরামর্শ সভা করে গোপালপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানি গোপালপুরের গরুহাটি এলাকা দিয়ে, আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানী গোপালপুরের দক্ষিণাংশ কীর্তনখোলা দিয়ে, আর আব্দুল হাকিম কোম্পানী বৈরান নদীর ওপাড় অর্থাৎ পশ্চিম দিক থেকে মর্টার বাহিনী হিসেবে গোপালপুর থানা আক্রমণ করেন।
৯ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় ভারতীয় তিনটি মিগ-২১ বিমান গোপালপুর ও ঘাটাইল থানার উপর একযোগে ট্রাম্পিং শুরু করলে দুই থানার ক্যাম্পে অবস্থিত পাকসেনা ও রাজাকাররা বাঁচার তাগিদে রাতের আধারে গোপালপুর থানা ক্যাম্প থেকে পালাতে থাকে। এদিকে বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকায় গোপালপুর থানার সূতী, নন্দনপুর, ভূয়ারপাড়া, চরপাড়া ও গোপালপুরের গরুহাটিতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের ঘেরাও করে রেখেছিলেন। একসময় পাকসেনাদের পালিয়ে যেতে দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিঞা কমান্ডার ও চাঁদ মিঞার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধরার জন্য ধাওয়া দেয়াসহ প্রায় এক ঘন্টা গোলাগুলিও করেন।
১০ ডিসেম্বর সকাল দশটার মধ্যে শত্রুসেনা গোপালপুর থানা থেকে পালিয়ে যায় এবং আনুমানিক সকাল এগারোটার দিকে আরজু কোম্পানীর চাঁদ মিঞার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে গোপালপুর থানায় প্রবেশ করেন। আর সেই সাথে গোপালপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। প্রথমে চাঁদ মিঞা, সাহেব আলী, শামছুল আলম, আব্দুল লতিফ, আজাহার আলী, কাদের তালুকদার, তোরাপ শিকদার, ইসমাইল হোসেন মৃধা, আব্দুস ছোবহান তুলা প্রমুখ থানায় অবস্থান গ্রহন করেন। পরে কোম্পানী কমান্ডার আসাদুজ্জামান আরজু বিমল, হায়দার, জয়নাল ও শুকুর নামক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে থানায় প্রবেশ করেন এবং বিভিন্নস্তরের মানুষ থানায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দনসহ তাদের সাথে কোলাকোলি করেন। আর এভাবেই ১০ ডিসেম্বর, শনিবার টাঙ্গাইলের গোপালপুর থানা পাক হানাদার মুক্ত হয় এবং বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়তে থাকে।
গোপালপুর থানা আক্রমণ ও দখলের যুদ্ধে দুইজন পাক সেনা নিহত ও ১৫ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করে এবং তিনশত জন রাজাকার ধরা পরে। তাদের মধ্যে পচাত্তর জন রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করে একটি ইন্দিরায় (কূপে) ফেলে দেয়া হয়। পাক সেনাদের প্রায় আশিটি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। কোম্পানী কমান্ডার নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর শত্রু সেনাদের কাছ থেকে পাওয়া সকল অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানী কমান্ডারের নিকট থেকে বুঝে নেন। পরে নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুরের নেতৃত্বে গোপালপুর থানায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়।