নিজস্ব প্রতিবেদক :
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই সম্মান করেন। রাষ্ট্র তথা বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সূর্য সন্তানদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন। বেশ ভালোই দিন কাটছে তাদের। কিন্তু এসব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যখন অপরাপর মুক্তিযোদ্ধারা বাস্তবভিত্তিক নানা অভিযোগ তোলেন তখন সবাই হোঁচট খান।
গোপালপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মিনহাজ উদ্দীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ তদবীর এবং প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন। গত শুক্রবার গোপালপুর প্রেসক্লাবে মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে লিখিত অভিযোগ করেন তারা। এতে নেতৃত্ব দেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ডেপুটি কমান্ডার সমরেন্দ্রনাথ সরকার বিমল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্বাছ আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাজিম উদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ জলিল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জহির উদ্দিন প্রমুখ।
এ ছাড়াও জেলা প্রশাসকের নিকট মুক্তিযোদ্ধারা এক লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের ছয়ানীপাড়া গ্রামের মৃত বাহার আলীর ছেলে মিনহাজ উদ্দীন একাত্তরে ১০ বছর বয়স থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যান বলে জানানো হয়। অথচ ১২ বছরের নীচে কেউ মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পাবেননা বলে বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে। তিনি বিএনপির প্রভাব খাটিয়ে একবার ডেপুটি কমান্ডার হন। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে হয়রানি শুরু করেন। তিনি অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেকের নিকট থেকে হাজার হাজার টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা, তাদের বিধবা স্ত্রী বা অসহায় সন্তানদের বাড়ি, খাসজমি অথবা সরকারি সুযোগ সুবিধা দেয়ার নামে নিজ নামের সীল ও দস্তখত দিয়ে রিসিভের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট গোপালপুর উপজেলা শাখার নামে গত ৬ জুলাই বেড়াডাকুরী গ্রামের মৃত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের স্ত্রী সাজেদা বেগম, একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জামাল হোসেন, পাকুটিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার হোসেন, বেড়াডাকুরি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম মঞ্জু, একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জহির হোসেনসহ দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের উত্তরসূরীদের নিকট থেকে তিনি লাখো টাকা হাতিয়ে নেন। তিনি বড়খালি গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. সোবহান মিয়ার মুক্তিযোদ্ধার সাময়িক সনদপত্র মন্ত্রণালয় থেকে এনে দেয়ার নামে ১৪ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। তিনি উত্তর পাথালিয়া তথা পদ্মপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হককে টিন, চাল ও পাহাড়ে জমি বন্দোবস্ত দেয়ার নামে কয়েক হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। ভূয়ারপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল খালেককে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার নামে বিপুল টাকা আদায় করেন। পরে বিভাগীয় তদন্তে আব্দুল খালেকের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়। পোড়াবাড়ী গ্রামের মৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদের মেয়ে সালমা বেগমের নিকট থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি সুবিধা এনে দেয়ার নামে ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। সোনালী ব্যাংক থেকে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ পাইয়ে দেয়ার নামে মিনহাজ উদ্দীন দালালী ব্যবসাকে গ্রহণ করেছেন। তিনি মোটরসাইলে নিয়ে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি ঘোরেন। আর ব্যাংক ঋণ বা নানা সুযোগ সুবিধা দেয়ার নামে চাঁদাবাজি করে বেড়ান। সোনালী ব্যাংক গোপালপুর শাখার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করলে ব্যাংকে তার দালালী করার সূত্র মিলবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস আলী জানান, মিনহাজের প্রধান পেশা দালালী। ব্যবসা বাণিজ্য হালগেরস্তালী কিছুই নেই। মুক্তিযোদ্ধা তথা তাদের অসহায় পরিবারকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারনা করে অর্থ সম্পদ হাতিয়ে নেয়াই তার মূল কাজ। প্রতারক মিনহাজকে এসব অপকর্মে সহযোগিতা করেন বেড়াডাকুরি গ্রামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন। এ আলতাফ হোসেন গোপালপুর ও মধুপুর ইউএনও অফিসে চাকরি করার সময় দুর্নীতির বাপজান ছিলেন। তাকে নিয়ে প্রচুর অভিযোগ ছিল গোপালপুরবাসির। দুর্নীতিবাজ আলতাফ এখন সুনীতির বরপুত্র সেঁজে মিনহাজ উদ্দিনকে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাজিম উদ্দিন জানান, মিনহাজ গং মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে। আমরা তার কুকর্মের জন্য মুখ দেখাতে পারছিনা। মিনহাজ ডেপুটি কমান্ডার থাকাকালে অফিস পিয়ন আছান আলীকে বেতন দিতেননা। কিন্তু তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে চাকরের মতো কাজ করাতেন। ইউএনও পারভেজ মল্লিক গোপালপুরে যোগদানের পর আছানকে মাসে পাঁচ হাজার টাকার বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরেন্দ্র নাথ সরকার জানান, গোপালপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট বলে কোন সংগঠনরে অস্তিত্ব নেই। এটি মিনহাজ উদ্দিনের পকেট সংগঠন। টাঙ্গাইল মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট নামে একটি ভূঁইফোড সংগঠন রয়েছে। সেটির দেখাদেখি ধান্ধাবাজি করার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট নামে একটি ভূঁয়া সংগঠন দাড় করিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। এসবের তদন্ত হওয়া জরুরী। প্রতারণার অভিযোগে তাকে আইনের আওতায় আনা হোক।
সোনালী ব্যাংক গোপালপুর শাখার ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান খান জানান, মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজ ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দেয়ার নামে দালালী করেন বলে লোকমুখে শুনেছি। সেটি হয়তো অফিসের বাইরে হতে পারে। তবে তিনি এ অভিযোগের প্রত্যক্ষদর্শী নন।
সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এডভোকেট শামসুল আলম জানান, মিনহাজ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিনা সেটি তার আচরণ ও কাজকর্ম দেখে বুঝা দায়। তার বিরুদ্ধে অনেক অনৈতিক কাজের অভিযোগ রয়েছে। তার নিন্দনীয কাজ মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজ উদ্দীন গত সোমবার বিকালে গোপালপুর প্রেসক্লাবে আসেন। তিনি স্থানীয় সংবাদকর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জন্য তিনি কারো নিকট থেকে কোন টাকাপয়সা নেননি। ঋণ তুলে দেয়ার নামে সোনালী ব্যাংকে কখনো দালালী করেননি। তবে অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে সহযোগিতা করার জন্য তিনি মাঝে মধ্যে ব্যাংকে গিয়ে থাকেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থাকতে টাঙ্গাইল মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট অথবা গোপালপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট নামের সংগঠন কেন দাড় করালেন, উত্তরে জানান, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্যই এসব নতুন সংগঠন। এসব দুঃস্থদের জন্য তার মন কাঁদে। তাই মানবদরদী হিসাবে তিনি এসব সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাঁদা আদায় করছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টের নামে একবার আবার টাঙ্গাইল মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টের নামে আরেকবার কেন চাঁদা তুলছেন, এর উত্তরে তিনি জানান, এসব ট্রাস্ট তিনি ঢাকার সহযোগিদের নিয়ে গঠন করেছেন, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সহযোগিতা করতে। তিনি এ সংগঠনের গোপালপুর শাখার সভাপতি এবং আলতাফ হোসেন সম্পাদক। তিনি দেড় বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন করার অভিপ্রায় প্রকাশ করায় কিছু মুক্তিযোদ্ধা তার বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছে।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন জানান, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. পারভেজ মল্লিক জানান, এটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ ব্যাপারে মিডিয়াকে এখনই বলা যাচ্ছেনা।