জয়নাল আবেদীন:
সুবল দাস একজন গ্রাম পুলিশ। বাবা সুখলাল ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার। পিতামহ কেরু দাস ছিলেন দফাদার। আর প্রপিতামহ সজন দাস ছিলেন টাঙ্গাইলের হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর টহলদার।
এভাবেই চৌদ্দ পুরুষ ধরে প্রজা আর শাসকের নিরাপত্তা ও সেবায় আত্মনিয়োজিত ছিলেন সুবল দাসরা। দফাদার থেকে চৌকিদার, চৌকিদার থেকে টহলদার এবং টহলদার থেকে গ্রামপুলিশ পদবীর নামকরনে রদবদল হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সুবলরা যুগ থেকে যুগান্তরে ছিলেন ভূমিহীন, মর্যাদাহীন ও অধিকার বঞ্চিত মানুষ।
প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির এসব অন্ত্যজরা কোনকালেই যেমন সামাজিক মর্যাদার অধিকারি ছিলেননা, তেমনি স্থায়ী ভিটেমাটিতে বসবাসের কোন সুযোগও তাদের জন্য খোলা রাখা হয়নি। বর্ণ ও শ্রেণী বৈষম্যের সামাজিক কাঠামোতে কুলীণরা এদেরকে অচ্ছুদ রেখে সমাজসংসারের নোংরাআবর্জনা পরিচ্ছন্ন করানোয় বাধ্য করতেন। তাই তাদের বস্তুগত ও ভাবগত উন্নয়ন নিয়ে যেমন কেউ কখনো ভাবেননি, তেমনি ঘুরেফিরে খাস জমির কিনারায় আশ্রিত ও উপেক্ষিত রেখে অন্ত্যজের কোঠায় ঠেলে রাখা হয় শত শত বছর। নবাবী আমল যেমন গেছে, বৃটিশ ও জমিদারী আমল তেমনিই ছিল। ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসন গত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরে কতোবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সুবলদের ভূমিহীন তকমার পরিবর্তন হয়নি। পিতৃপুরুষের বসবাসের ভিটে কখনোই নিজের হয়নি। খাসই থেকে গেছে।
মুজিববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বদান্যতায় পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠির এসব অন্ত্যজরা এখন জমির মালিকানা পেয়েছেন। নিজের নামে একখন্ড জমি থাকার যে নাগরিক অধিকার ও স্বাচ্ছন্দবোধ সেটির নিশ্চয়তা পেয়েছেন। আর সেই জমিতে নিরাপদ বসবাসের জন্য পাকা ঘর রাষ্ট্রীয়ভাবে উপহার পেয়েছেন। মিলেছে বহু কাঙ্খিত স্থায়ী ঠিকানা। কেউ কেউ পেয়েছেন দুঃস্থ, বিধবা ও বয়স্ক ভাতা। অস্পৃর্শ মুচি পাড়া, ঋষী পাড়া, মেথর পাড়ায় ঈশ্বর থাকেননা বলে বাংলা সাহিত্যের যে পুরনো প্রবচন সেটি বদলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশ্রয়ণ প্রকল্পের সফল কার্যক্রম এর প্রমাণ।
সরকারের চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্প টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের ঋষীপাড়ার যে দৃশ্যমান পরিবর্তন তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে শুধু ভদ্র পাড়ায় ঈশ্বর থাকার সেই উক্তিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।
ভাঙ্গাচোরা টিনের ছাপড়ার পরিবর্তে সারি সারি সুদৃশ্য পাকা ঘর। গলিঘুপচির দুর্গন্ধময় নর্দমার স্থলে ঝকঝকে, তকতকে উঠোন। সন্ধ্যায় আধাঁরে ডুবে যাওয়া সুনসান পাড়া এখন বিদ্যুতের আলোয় ঝলমলে। দুই বেড রুমের ছিমছাম পাকা ঘর। লাগোয়া স্বাস্থ্যসমত লেট্রিন। এক চিলতে খোলা বারান্দায় রোদ পোহানোর সুযোগ। বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য পাকা মঞ্চে বসানো চাপকল দৃশ্যমান। পাড়ার শিশুরা এখন দলবেধে স্কুলে যায়। বিদ্যুৎ আসায় কারো কারো ঘরে টেলিভিশন। সন্ধ্যার পর দলবেধে চলে চিত্তবিনোদন।
পাড়ার গৌরচন্দ্র দাস জানান, এখানে ১৮ ঘর ঋষী পরিবারের বসবাস। এদের কেউ কেউ গ্রামগঞ্জ ঘুরে জুতো পালিশ বা সেলাইয়ের কাজ করেন। কেউ নরসুন্দর। কেউ দিনমজুর বা পরিচ্ছন্নকর্মী। কেউবা গ্রাম পুলিশ, নয়তো হাটবাজারের নৈশ প্রহরী। আঠারো পরিবারের সাতজন পাকা ঘর পেয়েছেন। বাকিরাও পর্যায়ক্রমে পাবেন বলে প্রশাসন আশ্বস্ত করেছেন।
বাবুল রবিদাস জানান, পূর্বপুরুষরা নাকি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের বাসিন্দা ছিলেন। অভিজাতদের ফুটফরমায়েশ ও আরামআয়েশের জন্য নবাবী আমলে তাদেরকে পূর্ববাংলায় আনা হয়। ব্রিটিশ রাজত্বে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী রাজবাড়ীর উত্তরপূর্বে গইল্লা বিলের দক্ষিণ তীরের খাস জমিতে বসবাসের অনুমতি দেন। সাতচল্লিশের দাঙ্গা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদেরকে সাময়িকভাবে বাড়িঘর ছাড়তে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার পাড়ায় অস্তানা গাড়েন। খাসজমির বন্দোবস্তের চেষ্টা পঞ্চাশ বছরেও সফল হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষে গৃহহীনকে গৃহ এবং ভূমিহীনকে ভূমির মালিকানা দেয়ার যে কর্মসূচি নিয়েছেন, তার সুবাদে আজ ভিটে ও বাড়ী দুটোরই মালিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এ বাড়ি-ভিটেয় নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন। শুধু কাগজকলমে নয়, সত্যিকার অর্থেই নিজেদের এদেশের নাগরিক ভাবতে পারছেন।
অমল চন্দ্রদাস নামের পাড়ার বাসিন্দা জানান, বর্ষায় অনেকের ঘরের চালচূয়ে পানি পড়তো। বৈশাখী ঝড়ে নড়বড়ে ঘরের চালা উড়েও যেতো। পেটে ভাত জোটানোই যেখানে দুঃসাধ্য সেখানে ভাঙ্গা ঘর মেরামত ছিল দুস্কর। এখন প্রধানমন্ত্রীর মুজিববর্ষের উপহার পাকা ঘর পেয়ে ঋষীরা খুশিতে ডগমগ।
সুনীল চন্দ্রদাস বলেন, পাড়ার অনেকেই সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে জুতোসেলাই ও পালিশের কাজ করেন। যা কামাই তা দিয়ে কোনভাবে সংসার চলে। এখন বড় সাত্বনা যে, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে পাকা ঘরের শক্ত চালার নিচে পরম শান্তিতে ঘুমানো যায়। তাদের মতো অচ্ছুত মানুষ আগে কখনো এমন বাড়ির কথা কল্পনাই করতে পারতেননা। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেটি করে দেখিয়েছেন।
গোপালপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মাসুম জানান, ঋষী পাড়ার ঘর নির্মাণ কাজে বেশ নজর রাখা হয়েছিল। স্বল্প বাজেটের এসব ঘর যাতে টেকসই হয় সেজন্য সাধ্যমতো চেষ্টা হয়েছে।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. পারভেজ মল্লিক জানান, ‘মুজিব বর্ষ উপলক্ষে দেশে কোন গৃহহীন মানুষ থাকবেনা’ এটি হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। আশ্রয়ণ মূলত দারিদ্র বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পেরই অংশ। বলা যায়, সরকারের এসডিজি অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। মূল ধারার দরিদ্র জনগোষ্ঠির পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষকে সামন্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে এসডিজির লক্ষমাত্রা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গোপালপুর উপজেলায় নির্মিত ১৬৮টি পাকা ঘরের মধ্যে ১০টি পেয়েছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ। আগামীতে খাস জমিতে আরো গৃহনির্মাণ হবে। সেখানে ভূমিহীন ও বিত্তহীনদের পুনর্বাসন করা হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি জানান, টাঙ্গাইল জেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দুই সহস্রাধিক ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এদের একটি অংশ হলো পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নে সমতা আনার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্প সেদিকটায় আলো ফেলেছে।
টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের এমপি ছোট মনির জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে উন্নীত হতে যাচ্ছে। কাউকে পিছে ফেলে নয়, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে উন্নয়নের কাফেলায় সবাইকে শরীক করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি। আগামীর উন্নত বাংলাদেশ তার নেতৃত্বেই সফল হবে ইনশাল্লাহ।