অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন :
পাড়া মহল্লার সবচেয়ে নষ্টা যুবকটি রাজনীতির হালখাতায় নাম লিখিয়ে বহু আগেই নেতার আসন দখল করেছেন। সরকার বা বিরোধী দলের বড় নেতা, এমপি বা মন্ত্রীর নিকট এমন নষ্টাদের আবার বেশুমার কদর। এতোদিন নষ্টারা শুধু রাজনীতির নর্দমায় কিলবিল করতো। কিন্তু এখন কিছু বেশ্যা মিডিয়া গজিয়ে উঠায় পাড়ামহল্লার অবশিষ্ট নষ্টারা মিডিয়ার খাতায় হালনাগাদ হয়েছেন। জেলাউপজেলা তথা গ্রামীন সাংবাদিকতায় তারা সদর্পে ভর করছেন। কেউ টেলিতে, কেউ অনলাইনে, কেউবা প্রিন্ট লাইনের মহাকুতুব তারা।
নষ্ট রাজনীতি প্লাজ বেশ্যা সাংবাদিকতার এখন বড়ই বাড়বাড়ন্ত।। এ নষ্টাদ্বয় হাত ধরাধরি করেই চলেন। যতোক্ষণ স্বার্থ বিঘ্নত না হয় ততোক্ষণ একাট্রা। তাই মফস্বল শহর, গ্রামগঞ্জ যেখানেই যাবেন, নষ্টা নেতাদের মুখে উন্নয়নের চটকদার গালগল্প। আর মিডিয়ার ভাড়াটে পতিতাদের হাতে সেই গালগল্প হয়ে উঠে হলুদ নিউজের বানোয়াট প্রেজেনটেশন।
এরিস্টটলের ভাষায় বলা যায়, রাজনীতি হচ্ছে সুনীতির প্রয়োগ, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে রাস্ট্র ও নাগরিক মানসে। তাই প্রকৃত রাজনীতিকরা হন, সুনীতির বাচক, বাহক ও ধারক। আদতে কারো পক্ষে এমনটি হওয়া খুবই কঠিন। এজন্য নাগরিকরা চোখবুজে সুনীতির প্রবক্তা বা নেতাকে সমর্থন করেন।
সেই নেতার উপর তারা অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা রাখেন। নেতার বক্তৃতায় গদগদ হয়ে হাততালি দেন, আবেগস্পর্শী বক্তৃতায় চোখের জল ফেলেন এবং কখনোসখনো নেতার ডাকে রাজপথে নেমে জীবন উৎসর্গ করেন। নিজের কাজ ফেলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সীলও দেন। এসবই হয় নেতার সুনীতির প্রতি নাগরিকের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে।
আমাদের দেশে রাজনীতিকরা নাগরিকের সেই বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে পুঁজি করে রাজনীতির ব্যবসা করেন। তখন রাজনীতি হয়ে যায় পুরোদমে অপরাজনীতি। রাজনীতিকরা হয়ে উঠেন নষ্টা নেতা। দূর থেকে যাকে বটগাছ ভাবেন, নিকটবর্তী হয়ে দেখেন সেটি অশ্বত্থ বৃক্ষ নয়, ব্যাঙের ছাতা। যে ছাতা ছত্রাক ছড়ানোর বাহন। যা থেকে নির্বিবাদে সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজে বিভেদের চুলকানি ছড়িয়ে পড়ে। সেই চুলকানিতে নষ্টা নেতারা মাথা চুলকিয়ে নিজের বদনিয়ত ও খাসিলত হাসিল করেন। আর বোকাচোদা নাগরিকরা নিতম্ব থেকে মলদ্বার পর্যন্ত বিভেদের চুলকানিতে হানাহানি করেন। আর সুনাগরিকরা মুখ চুলকিয়ে দাবি করেন, এটি গণতন্ত্রের লড়াই। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই।
এভাবে নষ্টা রাজনীতিকরা যখন সুকৌশলে চুলকানি ছড়িয়ে নাগরিক শাসন করেন, তখন সমাজের একশ্রেণীর ধান্ধাবাজ মিডিয়া হাউজ খুলে বেশ্যা সাংবাদিকতা চালু করেন। সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গানুযায়ী, যিনি টাকার বিনিময়ে দেহ বিক্রি করেন অথবা দেহ বিক্রি করে জীবিকার্জন করেন তিনি বেশ্যা। কাজেই সেই সঙ্গানুযায়ী যদি বলা যায়, যিনি টাকার বিনিময়ে, বদ নিয়তে, বানোয়াট সংবাদ তৈরি, বাজারজাত বা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি কি বেশ্যা সাংবাদিক নন?
আগে ভাবতাম শুধু প্রিন্ট মিডিয়া উচ্ছনে গেছে। পেশাকাররা শুধু এখানেই ধান্ধাবাজি করেন। কিন্তু এখন দেখছি প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে অনলাইন পোর্টাল এক কাঠি সরেস। তার চেয়ে দশ কাঠি সরেস টেলিভিশন মিডিয়া। কথিত রয়েছে, যারা একসময় হোটেলে কল গার্ল সাপ্লাই দিতেন, তারাও এখন টেলি হাউজ খুলেছেন।
মফস্বলে টেলিভিশন কর্মীদের রীতিমতো দানবীয় ক্ষুধা। এমনকি সেটি নিয়ে কোনো রাখঢাক ও নেই। বিশেষ করে
সম্প্রতিকালে অনুমোদনপ্রাপ্ত কয়েকটি চ্যানেলের প্রতিনিধিরা কোথাও নিউজের কাজে গেলে টাকার জন্য নীলাম হাঁকেন। চক্ষু লজ্জা পর্যন্ত নেই। থাকবেই বা কি করে? লক্ষ টাকার বিনিময়ে ডান্ডি আনার পর বেতনভাতা তো দূর অস্ত, প্রচার হওয়া নিউজ প্রতি মিডিয়া হাউজকেই উল্টো টাকা দিয়ে হয়। কাজেই বাধ্য হয়েই প্রতিনিধিরা চাঁদাবাজি করেন। আর এ কাজ শুধু নষ্ট ছেলেরাই ভালো পারেন। যেকোন লজ্জাহীন পরিবেশকে তারা স্বাভাবিক মনে করেন। স্ট্যাটাসের শেষ ধাপে টেলিভিশন সাংবাদিকতা নিয়ে একটি অডিও রয়েছে। সেটি শুনলেই বোঝা যাবে বেশ্যাবৃত্তির সাথে আজকালের সাংবাদিকতার সাযুজ্য কতটুকু।
গোপালপুরের এক কলেজ ছাত্রীর সাজানো গণধর্ষণের ঘটনা এবং বানোয়াট মামলার উদ্ধৃতি দিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত খবর ও সাংবাদিকতা নিয়ে দু’কথা বলতে চাই। যদিও আমি ওই মাধ্যমে কখনো কাজ করিনি এবং তেমন অভিপ্রায়ও কখনো ছিলনা। ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর গোপালপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের কাগুজিআটা গ্রামের কলেজ ছাত্রী বীথি বেগমের গণধর্ষণ নিয়ে হৈচৈ ফেলেন তিনটি চ্যানেল।
টাঙ্গাইল জেলাসদরের এক টেলি সাংবাদিক টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনী বিভাগে ভর্তি হওয়া বীথি বেগমের গণধর্ষিত হওয়ার একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেটি সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় দেশের আরো দুতিনটি গণ ধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপি নাগরিক আন্দোলন চলছিল।
এমতাবস্থায় গোপালপুরের গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে টেলি সাংবাদিকরা পু্লিশ প্রশাসনকে কোয়ারী শুরু করলে পুলিশ তাৎক্ষনিক কোন জবাব দিতে পারেননি। কারণ অকূস্থল থেকে চার কিলো দুরে থানা পুলিশ স্টেশন এবং উপজেলা হাসপাতাল অবস্থিত হলেও ভিক্টিমকে সেখানে না নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ৪৮ কিলো দুরে টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
ভর্তির দু’ঘন্টা পর ভিক্টিমের নানা যিনি অবসরপ্রাপ্ত পু্লিশ কনস্টেবল, তিনি এক ভাড়াটে টেলি সাংবাদিককে হাসপাতালে ডেকে নেন এবং গণধর্ষণকে উপজীব্য করে নাতনী বীথি বেগমের এক ভিডিও ধারনের ব্যবস্থা করেন।
সেই ভিডিওকে কেন্দ্র করে টেলি সাংবাদিকরা পুলিশ প্রশাসনকে কোয়ারী শুরু করলে পুলিশ বেকায়দায় পড়ে যায়। কারণ পুলিশ তখনো ছিল অন্ধকারে।
এর মধ্যে পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়া হবে, হচ্ছে, তাদের লোকজন ঘটনাস্থলে গেছেন, আছেন ইত্যাদি ধরনের যে লানায়েক প্রাথমিক বক্তব্য পেশাগত কৌশলে দিয়ে থাকেন, তেমন বক্তব্যকে কতৃপক্ষের বক্তব্য হিসাবে ধরে নিয়ে তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের নিজস্ব অনলাইন পোর্টালে প্রথম খবর হিসাবে প্রকাশ করেন। ভূইফোড় কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল কপি পেস্ট করে অনবরত নিউজ পাবলিশ শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বয়ে যেতে থাকে। দুটি টেলিভিশন চ্যানেল দুদিন ধরে এমনভাবে খবর প্রচার শুরু করেন যেন তাদের প্রতিনিধিদের চোখের সামনে এ গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
তারপর বারুদের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সে খবর। প্রিন্ট মিডিয়াও কানখাড়া করেন। দৈনিক ইত্তেফাকের পরামর্শে সরেজমিন খোঁজ নিতে গিয়ে ঘটনাটি বানোয়াট মনে হয়। তাই খবরটি আপাদত করিনি। তারপর থানায় গণধর্ষণ মামলা হলো। আসামী হলেন স্বামী, শ্বশুর, দেবর, ভাসুর ও চাচাশ্বশুর। মেডিক্যাল রিপোর্ট এলো। ধর্ষণের আলামত মিলেনি। তারপর ডিএনএ টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় আলামত ঢাকার মালিবাগের সিআইডির ডিএনএ ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হলো। সাত মাস পর সেই ডিএনএ রিপোর্ট নেগেটিভ এলো।
তারপর পুলিশ নিজস্ব তদন্ত, মেডিক্যাল রিপোর্ট এবং ডিএনএ রিপোর্ট মোতাবেক আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট পাঠান। এমনকি মিথ্যা ও সাজানো গণধর্ষণ মামলা দিয়ে বিবাদীদের হয়রানির অভিযোগে বাদী ও ভিক্টিমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশ আদালতের নিকট আবেদন জানান।
গণধর্ষণ মামলা নিয়ে পরবর্তীতে এতো কিছু ঘটে গেলো। কিন্তু সেই চ্যানেলগুলোর আর দেখা নেই। নিউজের যে ফলোআপ দিতে হয়, সাংবাদিকতার সেই দায়িত্ববোধটুকুও তারা ভুলে গেছেন। বিবাদীরা অভিযোগ করেন, তাদের টাকাপয়সা দেয়ার সামর্থ ছিলনা। তাই চ্যানেলওয়ালারা মামলা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার পরও বস্তুনিষ্ঠ খবর করতে আসছেন না। বাদীপক্ষ সেদিন মোটা খরচ জুগিয়েছিলেন। তাই সাজানো গণধর্ষণের বানোয়াট নিউজ কাভারেজে টেলিদের বুকে তেজ ছিল। প্রধান আসামী শফিকুলের বক্তব্য, বিচারের আগেই টেলিরা যেভাবে দেশবাসির কাছে আমাদেরকে ধর্ষক বানিয়ে দিয়েছেন সেই বিচার আমরা কোথায় পাবো? টেলিদের বিচার কে করবেন?