::: অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন :::
মরচে ধরা, জীর্ন টিনশেড যে ঘরটি দেখছেন, সেটি ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খান আমলে নির্মিত। ষাটের দশকে এটি ছিল গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়ন পরিষদের কমিউনিটি সেন্টার। চাতুটিয়া গ্রামে অবস্থিত এই ভবনটি একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাটি ছিল। স্বাধীনতার পর বিশেষ করে জাসদের গণবাহিনীর উপদ্রব নিরসনে এটি ছিল অস্থায়ী পুলিশ ফাড়ি। সুতরাং ধ্বংসপ্রায় ভবনটি ইতিহাসের অনেক চড়াইউৎরাইয়ের নীরব সাক্ষী।
অন্যভাবে বলা যায়, ভবনটি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশকের ক্ষুদ্র স্মৃতিচিহ্ন। সঙ্গত কারণে দুই লাইনে আইয়ুব শাসনের ইতিহাস চর্চাটা সেরে নিতে চাই। যাদের পড়ার ধৈর্য কম তারা এখানেই থেমে যেতে পারেন। আর যাদের আগ্রহ রয়েছে তাদের নিয়ে ইতিহাসের চাকায় ঘুরে আসতে চাই।
১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর ইসকান্দার মির্জাকে সরিয়ে সেনাপ্রধান আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় জুড়ে বসেন। তিনি দেশে চালু করেন মৌলিক গণতন্ত্র বা বেসিক ডেমোক্রেসি। সেই গণতন্ত্রে জনগণের সরাসরি কোনো ভোটাধিকার ছিলনা। জনগণ ভোট দিয়ে একজন ইউপি মেম্বার নির্বাচন করতেন মাত্র। আর সেই মেম্বার জনগণের পক্ষ হয়ে সকল প্রকার নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করে অপরাপর জনপ্রতিনিধি এমনকি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতেন।
নিজের ক্ষমতা পোক্তের জন্য আইয়ুব খান ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘোষণা দেন। সেই নির্বাচনে তিনিই ছিলেন একমাত্র প্রার্থী। আর ভোটার ছিলেন শুধুমাত্র ইউপি মেম্বাররা। মৌলিক গণতন্ত্রের সেই ভোটের নাম ছিল হাঁ বা না ভোট।
সেই ভোট পর্বের ব্যালট পেপারে কোন প্রতীক ছিলনা। বুথে হাঁ বা না বক্স ছিল। হাঁ বক্সের ভোট আইয়ুবকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে সমর্থন বুঝাতো। আর না বক্সে বিরোধী দলকে নেগেটিভ সিগনাল বোঝাতো।
এভাবে হাঁ বা না যে বক্সেই ভোট পড়ুক না কেন,সব ভোট হয়ে যেতো আইয়ুব খানের। আইয়ুবের এমন ভোটরঙ্গের স্টাইল ভিন্ন আঙ্গিকে ফলো করে বাংলাদেশেও ১৯৭৭ ও ১৯৮৩ সালে দুজন প্রেসিডেন্ট হাঁ বা না ভোটে সেনানিবাস থেকে রাজনীতির সদর দরজায় প্রবেশ করেন। অবশ্য এখন দেশে ভোটাভুটির আরো উন্নতি ঘটেছে। তাই অনেক স্থানে নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট পর্ব সম্পন্নের বিস্তর অভিযোগ উঠে।
যাই হোক, আইয়ুব খান এভাবে সাজানো ভোটে জিতে ১৯৬২ সালে দেশে নতুন সংবিধান চালু করেন। এর ভিত্তিতে ওই সালে ন্যাশনাল এসেমব্লীর ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ইউপি মেম্বারদের সেই ভোটে উত্তর টাঙ্গাইল থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এম.এন.এ নির্বাচিত হন শিল্পপতি এবং ভূঞাপুরের নিকরাইলের বাসিন্দা, আফাজ উদ্দীন ফকির।
বলা অনাবশ্যক, ৭৫ পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হলে আফাজ উদ্দীন ফকির বিএনপি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল- ২ আসন থেকে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসাবে এমপি নির্বাচিত হন।
বলছিলাম, আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের কথা। সেই গণতন্ত্রে জনগন ভোট দিয়ে প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে ইউপি মেম্বার নির্বাচন করতেন। এরপর জনগনের আর কোনো ভোটাধিকার বা জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ ছিলনা।
প্রতিটি ইউনিয়নে নির্বাচিত ৯জন মেম্বার নিজেরা ভোটাভুটি করে একজনকে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। এই ইউপি মেম্বাররা ভোট দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য মানে এম.এন.এ এমনকি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজারসহ মোট ৮০ হাজার ইউপি মেম্বার ছিলেন দেশের মালিক বা ভোটার।
এভাবে একজন ইউপি মেম্বার ভোট দিয়ে রথি মহারথী নির্বাচন করায় তাদের ক্ষমতা ও দাম্ভিকতা বেড়ে যায়। মানুষ এসব মেম্বারকে “বিডি মেম্বার” বা “বেসিক ডেমোক্রেসি মেম্বার” বলে ডাকতেন। গ্রামগঞ্জে এরা ছিলেন দুর্নীতি ও অত্যাচারের দুরন্ত প্রতীক। এখন যেমন সরকারি দলের তৃণমূলের উপনেতা ও পাতিদের মানুষ যুগপৎ ভয় ও ঘৃণা করেন, তেমনি বিডি মেম্বাররা ছিলেন জনগণের ঘৃণার পাত্র।
১৯৬৪ সালের শেষ দিকে সারা পাকিস্তান জুড়ে পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ইউপি নির্বাচনের পর ৬৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের পালা। সেই নির্বাচনে আইয়ুব খানের গোলাফ ফুল প্রতীকের বিপরীতে হ্যারিকেন প্রতীক নিয়ে লড়াইয়ে নামেন মোহাম্মদ আলী জিন্নার ভগ্নী ফাতেমা জিন্নাহ।
সেই নির্বাচনে বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা হাতেম আলী খান, আওয়ামীলীগ নেতা হাতেম আলী তালুকদার, ময়মনসিংহের আবুল মনসুর আহমেদ, রফিকউদ্দীন ভূঞা এবং টাঙ্গাইলের মটু মিয়া হ্যারিকেন প্রতীকের পক্ষে বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী জনসমাবেশ করেন। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৬৫ সালের জানুয়ারীতে প্রচন্ড শীত ছিল। গোপালপুরের কোনাবাড়ী গরু হাটে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে এক সমাবেশ ছিল।
যারা আমার সিনিয়র তারা ভালো বলতে পারবেন; সেই সমাবেশে গোপালপুর, মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী এবং বর্তমান ভূঞাপুর (তখন গোপালপুর থানাধীন ছিল) থানার ইউপি মেম্বার ছাড়াও লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বাবার মাতুলালয় কোনাবাড়ীতে অবস্থানকালে উনার সাথে কোনাবাড়ী বাজারে জিলাপী খেতে গিয়ে মিটিংটা দেখেছিলাম। কিন্তু মিটিংয়ের কোনো স্মৃতিই এখন আমার স্মরণে নেই।
সেই নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নার হ্যারিকেন হেরে যায়। তবে বাংলায় সেই প্রবাদটা থেকে যায়; অর্থাৎ হাতে হ্যারিকেন আর…..বাঁশ। ১৯৬৫ সালের মৌলিক গণতন্ত্রের ভোটে হাদিরা ইউনিয়নে কছিম উদ্দীন, ঝাওয়াইল ইউনিয়নে মজিবর রহমান চৌধুরী, হেমনগর ইউনিয়নে লাল মাহমুদ ওরফে লাল খান, মির্জাপুর ইউনিয়নে রইস উদ্দীন সরকার, নগদাশিমলা ইউনিয়নে সেকান্দর আলী, মুশুদ্দী ইউনিয়নে এমদাদ হোসেন তালুকদার (১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মুশুদ্দী গোপালপুর থানাধীন ছিল) সূতি ইউনিয়নে চাঁন মিয়া, গোপালপুর সদর ইউনিয়নে রিয়াজ পন্ডিত এবং ধোপাকান্দি ইউনিয়নে হাতেম আলী ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
তখনো আলমনগর ইউনিয়ন গঠিত হয়নি। তিনজন বাদে এসব চেয়ারম্যানের সবাই ছিলেন মুসলিমলীগার ও আইয়ুব ভক্ত। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধীতা করেন এরা। এদের মধ্যে গোপালপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজ পন্ডিত ছিলেন একাত্তরে পাকিদের সহযোগী এবং থানা শান্তিকমিটির সভাপতি।
সেটা ছিল একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস। কাদেরীয়া বাহিনী ভারত থেকে নতুন অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে পুনরায় এলাকায় ফিরেছেন। গোপালপুর থানা সদর থেকে ১৩ কিলো দূরে চাতুটিয়া কমিউনিটি সেন্টারে তারা নতুন আস্তানা গেড়েছেন।
সেদিন ছিল জুম্বাবার। দুপুর তিনটায় হাদিরা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দুই প্রধান চাতুটিয়ার আনোয়ার হোসেন বিএসসি এবং হাউলভাঙ্গার মৌলভী এসএম ইব্রাহীম এলাকার সকল যুবক ও স্বেচ্ছাসেবকদের চাতুটিয়া স্কুল প্রাঙ্গণে ডেকে পাঠালেন।
সেখানে উপস্থিতির পর তিনি প্লাটুন কমান্ডার তোরাপ আলী শিকদারের চিঠি পড়িয়ে শোনালেন। সেই চিঠিতে ওই কমান্ডার দুই ঘন্টার মধ্যে ৮০ জন ফৌজের খাবার রেডি করে ক্যাম্পে হাজির থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চার পাঁচজন করে গ্রুপ করে করে আশপাশের গ্রাম ও পাড়া থেকে ভাত বা চিড়ামুড়ি সংগ্রহ করা হলো।
তখন গেঁয়োগ্রামের মানুষ দুপুরে পান্তা খেতেন। তাই ডিস ভর্তি পান্তা পেঁয়াজ পাওয়া গেলো। আসর নামাজের পর ৮০/৯০ জন মুক্তিফৌজ নিয়ে হুমায়ুন বেঙ্গল, তোরাপ আলী শিকদার ও আব্দুস সোবহান তুলারা চাতুটিয়া ক্যাম্পে হাজির হন। সেদিন নবগ্রাম ও বেলুয়ায় পাকিদের সাথে গোলাগুলির পর ঝাওয়াইল হয়ে চাতুটিয়া ক্যাম্পে আসেন তারা। ক্ষুধা ক্লান্তিতে সবার মধ্যেই বিরক্তির রেশ স্পষ্ট ছিল।
বিশেষ করে পান্তামুড়ি দেখে ক্ষেপে যান তোরাপ আলী শিকদার। স্বেচ্ছাসেবক প্রধান আনোয়ার হোসেন বিএসসিকে ডেকে ভৎসর্না করেন তিনি। রাতে মাছ বা মাংস ভাত করার নির্দেশ দেন। সবাই যখন মাংস ভাত সংগ্রহের চিন্তায় ব্যস্ত তখন হাউলভাঙ্গা গ্রামের ফজলুল হকের পরামর্শে নতুন আইডিয়া পাওয়া গেলো। পাশেই নগদাশিমলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মুসলিম লীগ সমর্থক এবং চককাশির সেকান্দর আলী সাবের বাড়ির গরুএনে জবাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেকান্দর চেয়ারম্যানের বাড়ি গোশালায় গরু পাওয়া গেলনা।
অগত্যা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেশ কিছু হাঁসমুরগী কালেকশন করা হলো। তাদিয়ে রাতে মাংস ভাতের ব্যবস্থা হলো। আশ্চর্য ব্যাপার ছিল, মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাবার সওয়াল করাতে গৃহস্তরা কখনোই বিরক্ত হতেননা। সামর্থনুযায়ী সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা খাবার সরবরাহে সহযোগিতা করতেন। কি সুন্দর সময় ছিল সেটি। গ্রামের সাধারন মানুষরা ভাবতেন, দেশ স্বাধীন হলে সত্যি সত্যি দেশটা সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
চূয়াত্তর সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ না খেয়ে মারা যেতে থাকে। এলাকায় বেদম চুরিডাকাতিও বেড়ে যায়। মঙ্গা নিরসনে সরকার এই কমিউনিটি সেন্টার বেইস একটি লঙ্গরখানা চালু করেন। প্রতিদিন শত শত অনাহারী মানুষকে এখান রান্নাকরা খিচুড়ি বা জাউ দেয়া হতো। এক মুঠো খাবারের জন্য অনাহারী মানুষের কতো আকুতি ছিল সেদিন! পঁচাত্তর সালে জাসদের গণবাহিনীর উপদ্রব দমনে চাতুটিয়া কমিউনিটি সেন্টারে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সেই ফাঁড়ি চালু ছিল।