::: আনজু আনোয়ারা ময়না :::
পৃথিবীর আদি থেকে মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়েছে সভ্যতার দিকে। নিজেদের প্রয়োজনে যুক্ত করেছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে। গুরু গৃহের টোল থেকে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষার আজকের আধুনিক রূপ হল প্রাথমিক শিক্ষা। নানা চড়াই পেরিয়ে এগিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থার ধরন। নতুন নতুন রূপরেখায় আধুনিক হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। শিক্ষক নিয়োগ, আর পাঠদান ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। শিক্ষকগণ আন্তরিকতা দিয়ে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কোভিড ১৯ অতিমারীতে স্থবির হয়ে গেছে সব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। ছুটি বলতে ঠিক আগের মত স্বাভাবিক ছুটিও নয় পড়ালেখাও বন্ধ নয় আবার শিক্ষকগণের পাঠদান বিষয়ক কার্যক্রম ও বন্ধ নয়। এবার প্রশ্ন রয়ে যায় তাহলে কী চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে? প্রাথমিক স্তরের কথায় যদি আসি তাহলে নিজ পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কোনটাই বন্ধ নেই গত ১৬ মার্চ ২০২০ থেকে। ভার্চুয়াল প্লাটফরমে অনুষ্ঠিত সকল সভার সিদ্ধান্ত আর সরকারি পরিপত্রসমূহের আলোকে মাঠ পর্যায়ে নিবিড়ভাবে শিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। স্কুল আঙ্গিনা, শ্রেণিকক্ষ পরিচ্ছন্ন রাখতে, উপবৃত্তি তথ্যাদি সংগ্রহ, চাহিদা প্রদান, শিক্ষার্থী তথ্য ছক পূরণ, স্লীপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, রুটিন মেইনটেন্স বাস্তবায়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম ইত্যাদি কাজে প্রায় দিনই স্কুলের তালা খোালা হয়। শিক্ষকগণ হয় স্কুলে আসেন নয় হোম ভিজিটে যান পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে। মোবাইল ভিজিট তো আছেই। তবে এসব ভিজিটেও রয়েছে নানা বিড়ম্বনা। হয় মোবাইল নম্বর বন্ধ নয়তো বাবা মোবাইল নিয়ে বাইরে আছেন। সন্ধ্যার পরে বাবা ফিরতেই শিক্ষার্থীর দু’চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। বাড়িতে একটা মাত্র বাটন সেট মোবাইল। বাবা কাজের মানুষ ওটা তার নিয়ন্ত্রণেই থাকে। তিনি বেড়িয়ে পড়েন ভোর ছয়টায়। বেশির ভাগের কাজ দিনমজুরি। চরের জমিতে কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, জুতা সারাই করা, চুল ছাটানো, বাঁক কাঁধে তেল শুটকিমাছ ফেরি করা, ক্ষুদ্র ব্যাবসা ভ্যান চালক এইসব। অনেকের ঘরে টেলিভিশন নেই, বিদ্যুৎ নেই। নেই এন্ড্রয়েট ফোন সেটের স্বপ্ন। অথচ আমরা অনলাইন ক্লাশে মাতিয়েছি নেটওয়ার্ক পাড়া। আমি নিজেও অনলাইনে ক্লাশ করেছি। দুঃখজনক সত্য আমার শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই তা দেখতে পায় নি। হতে পারে যমুনা নদী ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় আমার অবস্থান বলেই এমন হয়েছে এক্ষেত্রে বিকল্প থাকলো হোম ভিজিট। করোনাকালীন দুঃসময়ে শিক্ষার্থীরা ছোটে বাড়ির কাজে সহায়তা করতে। মেতে ওঠে দূরন্তপনায়। ওদিকে প্রতিদিন ব্লক শিক্ষক হিসেবে ৪০/৫০ জন শিক্ষার্থীর খোঁজ নিতে, পাঠ আলোচনা করতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিতে দিতে কোভিড ১৯ এর মরণ থাবায় হারিয়েছি এই শিক্ষক পরিবারের অনেক কে। তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। বিশ্ব থেমে গেলেও শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ রাখতে আমরা থেমে নেই। তবে হোঁচট খেতে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। স্থানীয় বাস্তবতায় অনেক শিক্ষার্থীরা থাকে দাদী অথবা নানীর কাছে। তাদের বাবা মা বিভিন্ন জায়গায় গার্মেন্টস, কলকারখানায় কাজ করে। কর্মহীনতার ছোবলে তারা এখন দূর্দশাগ্রস্ত। কখনওবা শিক্ষার্থীরাও নেই ঘরে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই মেতে থাকছে বন্ধুদের সাথে খেলায়। তারা দল বেঁধে মাছ ধরে, ছাগল চরায়, ঘাস আনে, বাজারে যায়, কেউ নিরাপদ নয়। তাদের অভিভাবকরাও অনায়াসে বাজারে ও অন্যান্য জননসমাগমে যায় স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই।
অভিভাবকদের অভিযোগ শিক্ষার্থীরা ভুগছে একঘেঁয়েমীতে।
ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অভাব অনটনে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি। দূরন্ত শৈশবের প্রাণবন্ত দিনের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা। বাবা মা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন। এই দুঃসময় কাটিয়ে বিদ্যালয় চালু হলেও ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠবে কী না! ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু থাকায় অনেকেই সেখানে তাদের ছেলে মেয়েদের পাঠাচ্ছেন স্বস্তির জন্য। সব মিলিয়ে আমরা পার করছি এক চরম বিপর্যয়ের দিনরাত।
এবারের নতুন ঘোষনাটি আমাকে আরও ভাবিয়ে তুলছে। আবারও হোম ভিজিট। আঁকাআঁকির হাতে কলমে কাজ, ওয়ার্কশীট প্রদান, মূল্যায়ন ইত্যাদি। কয়েকদিনের বাড়ির কাজ। আমাদের শিক্ষার্থীর বাড়িতে এই ওয়ার্কশীট বুঝিয়ে দেবার মত তো কেউ নেই! কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিজেরা একা করার মত পরিপক্কতাও নেই। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কোভিড ১৯ এর পরিস্থিতি বর্তমানে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। রাষ্ট্রে চলছে দফায় দফায় লকডাউন। আক্রান্ত হার মৃত্যু হার বেড়েছে। শিক্ষকগণ টিকা নিয়েছেন। এদিকে শিক্ষকের বাড়িতে আছে ছোট ছোট সন্তান, বৃদ্ধ বাবা মা। ওদিকে শিক্ষার্থীর ঘরেও একই চিত্র। কেউ একজন বাহক হলে সংক্রমণ বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমন পরিবেশে সকলে মিলে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তা অকার্যকর হবে। তাই ব্যাক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই সংকট মোকাবেলায়।
এই সংকট মুহুর্তে শিক্ষকগণ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠে ধরে রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজ নিজ এলাকায়। শিক্ষার্থী, অভিভাবক সাধ্যানুযায়ী সাড়া দিচ্ছেন। দেশমাতৃকার টানে, আগামীর সুনাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের এই সমন্বিত যাত্রা মাইল ফলক হয়ে থাকবে কোভিড ১৯ এর এই দুর্যোগকালে। রচিত হবে এক অনুকরণীয় ইতিহাস।
লেখক পরিচিতি :
প্রধান শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালপুর, টাঙ্গাইল।