গোপালপুর বার্তা ডেক্স :
দেশের অন্যতম বৃহৎ এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর রাজবাড়ীর রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালের দায়িত্ব নিচ্ছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়ার নেতৃত্বে অধিদপ্তরের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত শুক্রবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে সরজমিনে রাজবাড়ীটি পরিদর্শন করেন। পরে এক মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানানো হয়।
মহাপরিচালক ছাড়াও প্রতিনিধি দলে ছিলেন উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মাহবুবুর রহমান, উপপরিচালক (প্রত্ন সম্পদ) মো. আমিরুজ্জামান এবং আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা ও ময়মনসিহ) রাখী রায়। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিকাশ বিশ্বাস, হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রওশন খান আইয়ুব, প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, হেমনগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সম্পাদক আনিসুর রহমান হীরাসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
জানা যায়, হেমনগর রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা হলেন হেমচন্দ্র চৌধুরী। তিনি ছিলেন মধুপুর উপজেলার আমবাড়ীয়ার জমিদারের উত্তরসূরি। তার দাদা পদ্মলোচন রায় ব্রিটিশদের সূর্যাস্ত আইনের সুযোগে পুকুরিয়া পরগনার আমবাড়ীয়ায় জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। পিতা কালীচরণ রায়ের সময়ে জমিদারী আরো বিস্তৃত হয়। কিন্তু পাশ্ববর্তী ধনবাড়ীর মুসলিম জমিদারের সাথে নানা মতবিরোধ দেখা দেয়। শেষাবধি পিতা কালিচরণের মৃত্যুর পর হেমচন্দ্র মধুপুরের আমবাড়ীয়া থেকে জমিদারী সরিয়ে নেন গোপালপুর উপজেলার প্রাচীন নদী বন্দর সুবর্ণখালিতে (বর্তমানে সোনামুই)। ১৮৮০ সালে সুবর্ণখালিতে নির্মাণ করেন এক রাজবাড়ী। কিন্তু দশ বছরের মাথায় এ রাজবাড়ী যমুনা গর্ভে নিমজ্জিত হয়।
এমতাবস্থায় সুবর্ণখালি থেকে তিন কিলো পূর্ব-দক্ষিণে শিমলাপাড়া মৌজায় ১৮৯০ সালে একটি নতুন দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। অপূর্ব স্থাপত্য রীতির এ রাজবাড়ীর নাম রাখেন পরীদালান। ভবনের মূল অংশে উড়ন্ত দুই পরীর ভাস্কর্য ছিল। সামনের অংশে ছিল লতাপাতা আর কাব্যিক ডেকোরেশন। নামিদামি কড়ি আর শ্বেতপাথরে মোড়ানো ছিল রাজবাড়ির মূল অংশ। উঁচু আর পুরু পাচিলে ঘেরা রাজবাড়ির উঠোন চত্বর শেষে ছিল প্রশস্ত দীঘি। এর বিশাল শানবান্দা ঘাট সাদা ও লাল পাথরে মোড়ানো ছিল। রাজবাড়ির সিংহ দরজার সামনেও ছিল পাঁকা সিড়ির বিশাল দীঘি। ১৮০০ বিঘা জমিতে ছিল রাজবাড়ী ও এর পুরো চত্বর। শুধু মাত্র রাজপ্রাসাদে মূল ভবনটাই পাঁচবিঘা জমি জুড়ে বিস্তৃত। রাজবাড়ির আশপাশে আত্মীয় স্বজনের জন্য একাধিক দীঘি ও পাঁকাবাড়িঘর নির্মাণ করে দেন তিনি। রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ প্রান্তে গড়ে উঠে বিশাল বাজার। কালক্রমে হেমচন্দ্রের নামানুসারে শহরের নামকরণ হয় হেমনগর।
ময়মনসিংহ জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, হেমনগর বাজারে ছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ বাইজী পল্লী। রসিকরা সেখানে শুধু কামপ্রবৃত্তিই নয়- গুণী বাঈজির গান ও নাচের আসর উপভোগের জন্য যেতেন। পূজাপার্বণে রাজবাড়িসহ হেমনগর আনন্দ উৎসবে জেগে উঠতো। জমিদারবাড়ির দক্ষিণ আঙ্গিনায় (এখন যেখানে কলেজ মাঠ) ছিল দ্বিতল নাট্যশালা। হেমচন্দ্র চৌধুরী এবং তার বংশধররা সবাই ছিলেন উদার সংস্কৃতির সমঝদার। ওই নাট্যশালায় কোলকাতার নামীদামি শিল্পীরা এসে অভিনয় করতেন। যাত্রাপালা হতো দুর্গাপূজার সময়। রাজবাড়ির সামনের লনে বসতো কীর্তনের আসর।
১৯৭১ সালে হেমনগর পরী দালাল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি। এখান থেকেই কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার ও বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। হেমনগর জমিদাররা প্রজাবৎসল হলেও তাদের বিরুদ্ধে রায়তদের কিছু সুনিদিষ্ট অভিযোগ ছিল। তবে সেসবের নিরপেক্ষ যাচাইবাছাই হয়নি কখনো। শুধু হিন্দু বা শুধু মুসলিম এ ভেদবুদ্ধিতে অভিযোগ বা মূল্যায়ন করা হয়েছিল।
শিমলাপাড়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুস সালাম মেম্বার জানান, হেমচন্দ্রের চার পুত্র ছিল। এরা হলেন হেরম্ভ চৌধুরী, গঙ্গেশ চৌধুরী, প্রফুল্ল চৌধুরী ও যোগেশ চৌধুরী। সবাই ছিলেন কোলকাতার গ্রাজুয়েট। চার কন্যারা সবাই ছিলেন বিদুষী। এরা হলেন সুরেন্দ্র বালা দেবী, কিরণ বালা দেবী, সুমতি বালা দেবী ও সুনীতি বালা দেবী। সুমতি বালার স্বামী মুরলী ধর গাঙ্গুলি হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভোটাভুটির জয়পরাজয় নিয়ে কৃষক নেতা হাতেম আলী খাঁনের সাথে জমিদার পরিবারের বিরোধ তৈরি হয়। পরবর্তীতে এ বাম নেতার সহিংস আন্দোলনে জমিদার পরিবার দেশত্যাগে বাধ্য হন।
হেমচন্দ্রের সুযোগ্য ভগ্নীরা হলেন স্বর্নময়ী দেবী, ক্ষিরোদা সুন্দরী দেবী, বারোদা সুন্দরী দেবী। এদের মধ্যে স্বর্ণময়ী দেবীর পুত্র ছিলেন শ্যামাকান্ত গাঙ্গুলী। শ্যামাকান্ত গাঙ্গুলীর পৌত্র হলেন কমল গাঙ্গুলী। আর কমল গাঙ্গুলীর সুযোগ্য কন্যা হলেন ভারত-বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ড. পৌলমী গাঙ্গুলী। হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯২৫ সালে কাশীতে মারা যান। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হেমনগর জমিদারের উত্তরসূরিরা পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান।
আজ হেমনগর জমিদারের উত্তরসূরিরা নেই। তবে তাদের যশ, খ্যাতি, সুনাম-বদনাম মিলেমিশে জাগরুক রয়েছে। হেমচন্দ্র চৌধুরি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। ১৯০০ সালে হেমনগরে বিমাতার নামে ২০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠা করেন ইংলিশ মিডিয়াম শশীমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। গোপালপুর সূতী ভি এম পাইলট হাই স্কুল, পিংনা হাইস্কুল এবং আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান রয়েছে। তিনি চট্রগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির ও টাঙ্গাইল ফৌজদারী উকিলবার প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতা করেন।
হেমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক জোয়াহেরুল ইসলাম বিএসসি জানান, হেমচন্দ্র চৌধূরী যদি কোন প্রজাকল্যাণকর কাজ নাও করতেন তবু শশীমুখি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি প্রজাদের হৃদয়ে জাগরুক থাকতেন। সে যুগে শুধু হিন্দুরা নয় দরিদ্র মুসলিম পরিবারের সন্তানরাও এখান থেকে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পাকিস্তানী শাসনের তেইশ বছর এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বহাল থাকায় হেমচন্দ্র চৌধুরী ও তার বংশধরদেও কৃতিত্ব ছাইচাপা দেয়া হয়। নতুন প্রজন্ম এদের প্রজা কল্যাণমূলক কাজের ফিরিস্তি জানেন না।
হেমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রওশন খান আইয়ুব জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ রাজবাড়ীর দায়িত্ব নিচ্ছেন জেনে এলাকাবাসীরা খুবই আনন্দিত। অবহেলা অযত্নে পড়ে থাকা সুদর্শন ভবনটি ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাবে বলে তারা আশাবাদী।
এলাকার শিক্ষাবিদ আনিসুর রহমান হীরা জানান, এ রাজবাড়ীর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি সামন্ত যুগের ইতিহাসের অন্যতম উৎস। অবহেলা অযত্নে বাড়ীটা জীর্নদশায় উপনীত। ছাঁদে ফাটল ধরেছে। পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনটির জরুরী সংস্কার প্রয়োজন। প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ভবনটির দেখভালের দায়িত্ব নেয়ায় এটি এখন পর্যটনের অন্যতম উৎস হতে পারে।
হেমনগর রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা হেমচন্দ্র চৌধুরীর উত্তরসূরি, ভারতের বোম্বে বসবাসরত বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী পৌলমী গাঙ্গুলী এক ম্যাসেঞ্জার বার্তায়, এ সুখবরে বাংলাদেশ সরকার এবং হেমনগরবাসীকে অভিনন্দন জানান। তিনি আশা করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ দিনের অবহেলিত পুরাকীর্তিটি কালের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া জানান, প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো হলেও ভবনটি এখনো বেশ মজবুত রয়েছে। এটিকে সংস্কার ও অলঙ্করণ করা হবে। দর্শনার্থীদের জন্য বেশকিছু সুযোগ সুবিধা তৈরি করা হবে। যাতে এখানে এসে পর্যটকরা কিছু নির্মল বিনোদন লাভ করতে পারেন। এজন্য প্রাথমিক অবস্থায় রাজবাড়ী ও তৎসংলগ্ন কিছু ভূমি নিয়মমাফিক অধিগ্রহণ করে গেজেট প্রকাশ করা হবে। ধাপে ধাপে এসব উন্নয়নমূলক কাজ হবে বলে জানান তিনি।