নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘বিয়ের তিন মাস পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। ততদিনে পেটে নতুন অতিথির আগমনী বার্তা। অভাবী সংসারে ভাইয়েরা দু’বেলা পেট পুরে খেতে দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে ঝিয়ের কাজ নেয়। নয় মাস নয় দিন পর এলো ফুটফুটে বাচ্চা। নাম রাখা হলো মাহদী। কিন্তু বিধি বাম। সারা শরীর জুড়ে দেখা দিলো ঘা। ডাক্তার কবিরাজে কাজ হলো না। টানা চার বছর কলার পাতায় শুইয়ে অতিকষ্টে বড় করা হলো তাকে। সংসারের অনটনে ছেলের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে ভিক্ষা বৃত্তি করতেও হলো এক পর্যায়ে। স্বপ্ন ছিল যতো কষ্টই হোক লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলেকে মস্ত বড় আলেম বানানো হবে। ছেলে মুফতী হবে। দেশ জুড়ে নাম হবে। সংসারের অভাব দুর হবে। কিন্তু সব স্বপ্ন চুরমার হলো।’ গোপালপুরে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে নিরুদ্দেশ এক মাদ্রাসা ছাত্রকে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়ে এ ভাবেই বলছিলেন এক মা। পরিবারের ধারনা মেধাবী মাহদী হাসান বাবুকে (১৫) কৌশলে জঙ্গীদের দলে ভিড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
আজ শনিবার গোপালপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ধরনের আকুতি জানান ময়না বেগম নামক এক গৃহবধূ। গোপালপুর উপজেলার ধোপাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ময়না বেগম জানান, গ্রামে ফেরি করে চুড়িমালা বিক্রির টাকায় সংসার চালাতেন তিনি। অতি কষ্টে ছেলে মাহদী হাসান বাবু এবং কণ্যা বণ্যা আখতারের পড়াশুনা করাতেন। পুত্র মাহদী বরুরীয়া মাদ্রাসা থেকে কোরআনে হাফেজ হওয়ার পর সেখানে হোস্টেলে থেকে কিতাব বিষয়ে পড়াশোনা করছিল। বেশ কিছু দিন ধরে তার মধ্যে ভাবান্তর দেখা যায়। মা ও বোনকে কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলার নসিহত শুরু করে। গত ১৭ ডিসেম্বর হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে ট্রাঙ্ক থেকে নতুন পাঞ্জাবী ও পাগড়ী পরিধান করে মায়ের মোবাইল নিয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। ফোন রিসিভ না করায় আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। দুদিন পর সন্ধান চেয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন পাশ্ববর্তী শাহপুর গোরস্থানপাড়া নুরানী মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি আব্দুল খালেকের সাথে ওই মাদ্রাসার হোস্টেলে দু’দিন গোপনে অবস্থান করার পর নিরুদ্দেশ হয় মাহদী। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে মাহদীকে উদ্ধার করার নামে ময়না বেগমের নিকট থেকে বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নেন মুফতী খালেক। নিরুদ্দেশ হওয়ার ২৩ দিন পর ময়না বেগম গত ৮ জানুয়ারি গোপালপুর থানায় জিডি করেন। স্থানীয় ইউপি মেম্বার আলম হোসেন বাধা দেয়ায় তিনি জিডিতে মুফতী খালেকের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে পারেন নি।
থানায় জিডির খবর পেয়ে মুফতী খালেক গত ১০ জানুয়ারি গুটু শেখ নামক এক কবিরাজকে নিয়ে ময়নার বাড়িতে হাজির হন। আয়না পড়ার মাধ্যমে নিরুদ্দেশ মাহদীর খোঁজ দেয়ার কথা জানান। ময়না বেগমের ভাষায়,“মুফতীর উপস্থিতিতে কবিরাজ গুটু দুহাতে কথিত অলৌকিক আয়না (গ্লাস) মেলে ধরে বলতে থাকেন, “মারহাবা, মাহদীর সন্ধান পাওয়া গেছে। পাকা দাড়িওয়ালা কামেল ব্যক্তিরা তাকে বেহেস্তী খাবার খাওয়াচ্ছেন। শতশত পবিত্র হুজুর দ্বারা সে এখন পরিবেষ্টিত। মাহদী শীঘ্রই ধর্মীয় অবতার ইমাম মাহদী হয়ে বাড়ি ফিরে আসবেন। তার চোখ মুখের উচ্ছাস দিয়ে তা প্রকাশ করছেন।’’ এভাবে কবিরাজ ও মুফতীচক্র মাহদীর ফিরে আসার ভূয়া আশ্বাস দেন। কিন্তু পয়ত্রিশ দিন পার হলেও বুকের ধন ফিরে না আসায় তিনি ভেঙ্গে পড়েন। তার সাথে বা তার পরিবারের সদস্যেদের সাথে কারো কোনো বিরোধ নেই। যে কারণে পুত্র মাহদী গুম, খুন বা নিখোঁজ হতে পারে।
ময়না বেগম অভিযোগ করেন, পুলিশ গতানুগতিক ভাবে তদন্ত করায় রহস্য উদঘাটিত হচ্ছেনা। মুফতী খালেককে জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক করার দাবি জানান। তিনি মিডিয়াকর্মীদের সামনে বুকফাটা আর্তনাত করতে করতে জানান, “লোকে কানাকানি করছে আমার সোনার বাবা নাকি জঙ্গীতে নাম লিখাইছে। জঙ্গীতে যাক, গুম হোক, নিখোঁজ হোক আমার বুকের মানিককে ফিরিয়ে চাই। আমার বাবাকে এনে দেন।” এ সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন স্বামী ফজলুল হক।
এ ব্যাপারে গোপালপুর থানার ওসি হাসান আল মামুন জানান, নিরুদ্দেশ হওয়ার বিষয়টি এখন নতুন আঙ্গিকে তদন্ত করা হবে। প্রকৃত ঘটনা কী তা তদন্ত শেষ না করে বলা যাচ্ছেনা।
উল্লেখ্য, মুফতী আব্দুল খালেক এক সময়ে একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলেন। তার গতিবিধি সন্দেহজনক বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসি। দুই বছর আগে গোপালপুর উপজেলার ডুবাইল গ্রামের নিখিল দর্জি জঙ্গীদের হাতে খুন হন। ওই ঘটনায় তিন জঙ্গী এখন জেলহাজতে। র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত জঙ্গী তামিমের বাড়ি গোপালপুরে। একুশে গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত এবং ফেরারী কথিত জঙ্গী মাওলানা তাজুল ইসলামের বাড়িও গোপালপুর। তাই রহস্যজনক নিরুদ্দেশ নিয়ে এতো শংকা আর গুঞ্জণ।