কে এম মিঠু, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) : চারণ কবি আবদুল জুব্বার টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার নুহুরিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পরবর্তীতে তিনি মা-বাবার সাথে রংপুরে গিয়ে বসত ভিটা গড়ে সেখানেই লেখাপড়া করেন। কিছুদূর তিঁনি পড়াশোনা করার পর নিজেদের জমিতে একটি স্কুল স্থাপন করে আশেপাশের দু’তিন গ্রামের শিশুদের লেখাপড়া করান। লোকমুখে শোনা যায়, তার স্থাপিত স্কুলটি এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নতিকরণ হয়েছে।
জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আবদুল জুব্বার গোপালপুর উপজেলার সূতী গ্রামে বাস করেন। তিনি সারাদিন পরনের লুঙ্গী কাছাঁ দিয়ে গোপালপুর শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াতেন আর ছড়ার মতো ছন্দাকারে সদাসত্য আর আধ্যাত্বিক ধরনের বিভিন্ন লাইন বা শ্লোক বলতেন। এলাকার লোকজন প্রথমে তাঁকে পাগল ভাবলেও একসময় তাঁর ছন্দময় জ্ঞানগর্ব কথা শুনার জন্য ব্যাপক আগ্রহ দেখা দেয় মানুষের মাঝে। ধীরেধীরে আবদুল জুব্বারের ভক্তবৃন্দগণ তাঁকে চারণ কবি উপাধি প্রদান করেন। গোপালপুর থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র ‘আচঁড়’ ২০০২ সালে তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করে।
বাউন্ডুল বা অগোছালোভাবে জীবনযাপন করলেও সত্যিকার অর্থে চারণ কবি আবদুল জুব্বারের গায়কী এবং ছন্দাকার কথাবার্তায় থাকতো মানুষের দু:খ-দুর্দশা, অধিকার আদায়, শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার দাবী, কখনো প্রশাসণ কখনো রাজনৈতিক দলের উপর রাগের বর্হিপ্রকাশ। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য, জীবিত অবস্থায় আমরা এই চারণ কবির সৃষ্টি বা আবিস্কারকে কখনোই মূল্য দেইনি এবং সংরক্ষণ করেও রাখতে পারিনি।
সম্প্রতি ফেসবুকে তাঁর দু:সাহসিক একটি শ্লোক ‘‘উপজেলায় আইসা দেখি, টাওটারির খেলা, ইউএনও সাব হর্তাকর্তা, এ্যাসিল্যান্ড তার চেলা’’ প্রকাশ করার পর, প্রচুর পাঠকপ্রিয়তায় লাইনটি ভাইরাল হয়। স্থানীয় এক বড় ভাই (প্রফেসর) আমাকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ’চারণ কবি আবদুল জুব্বার’ কে নিয়ে যেন আরও কিছু তথ্যাদিসহ লেখালেখি করি।
চারণ কবি আজ দুনিয়াতে বেঁচে না থাকলেও সেই প্রফেসর ভাইয়ে অনুপ্রেরণায়, তাঁর এক শিষ্যকে খুঁজে বের করে চারণ কবি আবদুল জুব্বারের কিছু আধ্যাত্বিক বা ছন্দময় অর্থবহ শ্লোক সংগ্রহ করে পাঠকের সামনে তুলে ধরলাম-
** ১ **
কাল কাল বর্ষা কাল,
ছাগল চাটে বাঘের গাল।
শোনরে কোকিল আমি কই,
আমার ডাকে আকাশ কাঁপে
তলে চাইয়া দেখি-
হোলোগোটা বিলাইয়ে চাটে !
(হোলোগোটা : অন্ডকোষ)
** ২ **
আগে পায়ে দিছে খরম,
চোখে-মুখে কানে-নাকে ছিলো শরম।
এহন পায়ে দেয় চটি,
মানুষ দেখতাছি নটি !
** ৩ **
ধনী দেখবাইন যারে,
মেহির করবাইন তারে।
গরিব দেখবাইন যারে,
পুঁটকি মারবাইন তারে !
(মেহির : মেহেরবানি)
** ৪ **
নদীর বড় নালা
যারা আছাল পাইক চকিদার
তারাই হইছে ভালা।
নাপিত যতোই বড় হউক
মাথার বাল চাচনই লাগবো !
(বাল: চুল)
** ৫ **
গুড় বড়ই মিষ্টি
পিপড়াঁয় করে ঝামেলা সৃষ্টি,
আছিলাম ধান, হইলাম খই
আরোমান দিনে দিনে-
না জানি কি হই !
(আরোমান : আবার)
** ৬ **
পানির নিচে ইচার বাসা
চান্দায় বলে আমারে বাঁচা।
আগু-বোয়াল ডাইকা বলে-
এইডাই যোমের ঘোর !
(ইচা : চিংড়ী, আগু : রাঘা মাছ)
** ৭ **
পান্তা ভাতে পানি অল্প
পিপড়াঁয় করে গল্প।
কোম দিয়া ফাঁও
জরমের খাওয়া খাও।
আরমান কোনোদিন চাও?
সরিষার তেলের মতো
বিদায় হইয়া যাও !
(কোম: কম, জরমের: জন্মের, আরোমান: আরেকবার)
** ৮ **
নাং নাং করো নাং
কি বাপের ঠাকুর,
ইত্তিদে আমাগরে
পূন্নি হবো তোগোরে !
(নাং: ভাতার বা পরকীয়া প্রেমিক, ইত্তি: সম্মান বা ইজ্জত, তোগোরে: তোদের)
** ৯ **
সেও নড়ে, সেহু নড়ে
সিংহ ভাল্লুকে যুদ্ধ করে,
তাদের ঘাড়েই যোম
স্বাক্ষাতই হয় না কোম।
পাহাড় পুইড়া হইলো
বন জঙ্গলের ছোঁন !
(সেও : ছোট জীবজন্তু, সেহু: সেও এর স্ত্রী লিঙ্গ, যোম: মৃত্যু, কোম : গোষ্ঠি বা বংশের মানুষ)
** ১০ **
কুড়কি মুড়কি পরের স্বরি
এসো মা নমস্কার করি,
আইজাকা আমার গায়ে জ¦র
নমস্কার ফাঁক থেইকাই কর !
(কুড়–কি মুড়কি: জড়োসড়ো হয়ে স্মরণ করা)
** ১১ **
দিলে ভালা
না দিলে শালা!
** ১২ **
ধনীবাড়ি কামলা দেয়
কোন শালা, কোন শালা,
ইবেলার ভাত ওবেলা
ডাইলের মধ্যে পানি দেয় একগলা !
ধনীরা খায় মাংস ভাত
গরিবরে দেয় মইচ পোড়া !
(মইচ: মরিচ)
** ১৩ **
যাদের মাথায় সাদা টুপি
তাগরে দেয় গপগপি,
আমি জুব্বার পাগলা চাইলে-
পাইল্লার নিচে চামচ বাইড়ায়
এই বাড়িগর মাতবন্নি !
(গপগপি: তাড়াতাড়ি, পাইল্লা: পাতিল, মাতবন্নি: গৃহকর্তী)
** ১৪ **
উপজেলায় আইসা দেখি-
টাওটারির খেলা,
ইউএনও সাব হর্তাকর্তা
এ্যাসিল্যান্ড তার চেলা !
(টাওটারি: চালাকি, চেলা: সহকারি)
সংগ্রাহক : কে এম মিঠু, গোপালপুর, টাঙ্গাইল।
তথ্যদাতা : গোলাম মোস্তফা হাবেল (শিষ্য), পিচুটিয়া, গোপালপুর।
ফটো ক্যাপশন : ২০১০ সালের ৩ নভেম্বর চারণ কবি আবদুল জুব্বারের সাথে তথ্য সংগ্রাহক।