জয়নাল আবেদীন :
পরিচিতি :
ব্রহ্মপুত্র পলল ভূমির চত্বর নিয়ে গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা। মূলত খাল,বিল আর নদীনালায় ভারাক্রান্ত ছিল এ ভূভাগ। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, এ মৃত্তিকার আনুমানিক বয়স প্রায় দুই হাজার বছর। সমতল ডাংগা এবং বিল নিয়ে গঠিত এ উপজেলার ভূভাগ বর্ষাকালে সাময়িকভাবে প্লাবিত হয়। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পলি অবক্ষেপন এবং বৈরান, ঝিনাই ও ক্ষীনকায়া আত্রাই নদীর ভাঙ্গা গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে গোপালপুর। যমুনার ভাঙ্গনে এ উপজেলার মানচিত্র বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে।
নামকরন :
টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ কর্তৃক ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘টাঙ্গাইল জেলার স্থাননাম বিচিত্রা’ গ্রন্থে গোপালপুর নামকরণ নিযে দু ধরনের মতামতের উল্লেখ রয়েছে। প্রথমত-মুঘল শাসনামলে গোপাল শাহ নামক এক আফগান দরবেশ এখানে এসে আস্তানা গড়ে তোলেন। এ গোপাল শাহের নামানুসারে নাম হয় গোপালপুর। দ্বিতীয়ত-চট্রগ্রাম থেকে আগত গোপাল চক্রবর্তী নামক এক ব্যবসায়ী নাটোরের জমিদার রাণীভবানীর নিকট হতে এ মৌজা পত্তনি নেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার নামানুসারে নামকরণ হয় গোপালপুর। এখানে পুর বলতে বাড়ি বা আস্তানা বুঝানো হয়েছে। প্রথম অভিমতটি সঠিক নয় বলে অনুমিত হয়। কারণ গোলাপ শাহ নামক কোনো আফগান দরবেশ এখানে কোনো কালে আস্তানা গড়ে তুললে মাজার অথবা শিষ্যসামন্তদের ঐতিহাসিক নিদর্শন বা অস্তিত্ব থাকতো। আমারা কোথাও এধরনের নিদর্শন দেখতে পাইনা। অপরদিকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত গোপালপুর মৌজা হিন্দু অধ্যুষিত জনপদ ছিল। নদী পথ ছিল তখন যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। হিন্দু মহাজনরা বৈরান নদীর তীরে গোপালপুর মৌজার নন্দনপুর এলাকায় পাটের কারখানা গড়ে তোলেন। হিন্দু ব্যবসায়ীরা এখানকার কারখানায় বেলিং করা পাট বৈরান নদী হয়ে কোলকাতায় চালান দিতেন। সুতরাং হিন্দু ব্যবসায়ী গোপাল চক্রবর্তী অথবা গোপাল সাহার নামকরনেই গোপালপুর নামকরণ সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত।
অবস্থান :
পূর্বে ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলা, দক্ষিনে ভূঞাপুর উপজেলা, পশ্চিমে যমুনা নদী ও সরিষাবাড়ি উপজেলা এবং উত্তরে ধনবাড়ি ও মধুপুর উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত। একটি পৌরসভা এবং ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা গঠিত। যেমন, গোপালপুর পৌরসভা, হাদিরা ইউনিয়ন, নগদাশিমলা ইউনিয়ন, ঝাওয়াইল ইউনিয়ন, হেমনগর ইউনিয়ন, আলমনগর ইউনিয়ন, মির্জাপুর ইউনিয়ন এবং ধোপাকান্দি ইউনিয়ন।
প্রশাসনিক ইতিহাস :
টাঙ্গাইলের গোপালপুর একটি প্রাচীন জনপদ। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত শ্রী কেদারনাথ মজুমদারের অমূল্য গ্রন্থ ‘ময়মনসিংহের বিববরন’ থেকে জানা যায়, ১৭৮৩ সালে ৩৯টি পরগনা নিয়ে ময়মনসিংহ জেলা ঘোষিত হয়। গোপালপুর উপজেলাসহ উত্তর টাঙ্গাইলের পুরো অংশ এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলা তখন পুখুরিয়া পরগনার অন্তর্গত ছিল। গোপালপুর যমুনা বিধৌত হওয়ায় সকল প্রকার যোগাযোগ হতো নদী পথেই। এজন্য হেমনগর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সোনামুই গ্রামের দক্ষিনে সুবর্ণখালি গ্রামে গড়ে উঠে বিখ্যাত নদী বন্দর। এ সুবর্ণখালি বন্দরে ভিড়তো বড় বড় স্টিমার। আসামের হাড়গিলা থেকে ঢাকার মানিকগঞ্জ পর্যন্ত এ স্টিমার চলতো। এ সুবর্ণখালি বন্দরের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য ১৮৯৯ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ-জগন্নাথগঞ্জঘাট-সিরাজগঞ্জ হয়ে কোলকাতা পর্যন্ত রেলওয়ে চালু হয়। পিংনা থেকে সুবর্ণখালি পর্যন্ত সড়ক পাকা করা হয়। এটিই গোপালপুর থানার প্রথম পাকা সড়ক। সুবর্ণখালি থেকে পিংনা হয়ে জগন্নাথগঞ্জঘাটের রেলপথ ধরে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করতো হেমনগরের জমিদাররা। আর এ সুবর্ণকালি বন্দর থেকে ৪ কিলো উত্তরে অবস্থিত যমুনা তীরবর্তী পিংনায় পৃথক থানা এবং জজ আদালত স্থাপন করা হয়। পিংনা বর্তমানে সরিষাবাড়ি উপজেলার একটি প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে এখনো টিকে রয়েছে। তবে গোপালপুর উপজেলার সুবর্ণ খালি বন্দর বা জনপদের কোন অস্তিত্ব¡ নেই। যমুনার ভাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন এ বন্দর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এর উত্তর পাশে সোনামুই নামক একটি জনপদ গড়ে উঠেছে। সমসাময়িক গ্রন্থ ‘পূর্ব বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য’ থেকে বর্ণনা দেয়া হয় যে, উনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পিংনা থানা ও জজ কোর্ট স্থাপিত হয়। ব্রিটিশরা বর্তমান গোপালপুর, ভূঁইয়াপুর, সরিষাবাড়ি ও ধনবাড়ি উপজেলার রাজস্ব আদায়ের জন্য পিংনায় বড়সড় একটি তহশিল কাচারি স্থাপন করেন। নৌপথে কোলকাতার সাথে যোগাযোগের সুবিধাহেতু পিংনায় এসব সরকারি অফিস আদালত স্থাপন করা হয় বলে অনেকের ধারনা। বর্তমান গোপালপুর, ভূঞাপুর, ধনবাড়ি এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার প্রশাসনিক, রাজস্ব এবং বিচার ব্যবস্থা এ পিংনা থেকেই পরিচালিত হতো। তখন গোপালপুর পৌরসভা ও এর আশপাশের মৌজার প্রায় পুরোটাই ছিল নাটোরের জমিদারের তালুক। কখন গোপালপুর একটি থানার মর্যাদা লাভ করে ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব। তবে এম আবদুল্লাহর ‘ময়মনসিংহের নতুন ইতিহাস’ অধ্যাপক খন্দকার আব্দুর রহিমের ‘টাঙ্গাইলের ইতিহাস’ এবং টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘টাঙ্গাইলের ইতিহাস’ গ্রন্থ সূত্র থেকে বলা যায়, ১৮৬৯ সালে টাঙ্গাইল থানা মহকুমা হিসাবে মর্যাদা পাওয়ার সময় গোপালপুর ও কালিহাতি পুলিশ ফাড়ির অস্তিত্ব¡ ছিল। তখন গোপালপুর পুলিশ ফাঁড়ি ছিল পিংনা থানার অধীন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজিটিয়ারের তথ্য মোতাবেক সম্ভবত ১৮৬৯ থেকে ১৮৯০ সালের কোন এক সময়ে গোপালপুর ফাঁড়ি পূর্ণাঙ্গ থানায় পরিণত হয়। ১৯০৪ সালে কেদারনাথ মজুমদারের ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ গ্রন্থে দেখা যায় ঐ সময়ে টাঙ্গাইল সদর থানা, কালিহাতি থানা এবং গোপালপুর থানার অস্তিত্ব ছিল। তখন গোপালপুর থানার প্রাণ কেন্দ্র ছিল সুবর্ণখালি বন্দর। তবে বিচার কার্যের জন্য জজকোর্ট ছিল পিংনায়। সুবর্ণখালি ও পিংনার নামডাকের জন্য মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়ার জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৮৫ সালে সুবর্ণখালি বন্দরের অদূরে তার রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে সুবর্ণখালি যমুনার ভাঙ্গনে বিলীণ হলে শিমলাপাড়া মৌজায় পরীদালান নামে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। যেটি এখনো কোনোভাবে টিকে আছে। পরবর্তীতে হেমচন্দ্রের নামানুসারে গ্রামের নাম হয় হেমনগর।
শিক্ষাদীক্ষার বিবরণ :
হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯০০ সালে হেমনগরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি বর্তমানে শশীমুখি উচ্চবিদ্যালয় নামে পরিচিত। এটি গোপালপুর থানার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ গ্রন্থে দেখা যায়, ১৯০৪ সালে হেমনগর হাইস্কুলের ছাত্র সংখ্যা ছিল ২০১ জন। এ স্কুলের জন্য জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী কোন সরকারি সাহায্য গ্রহন করেননি। ঐ গ্রন্থের বিবরণীতে আরো দেখা যায়, তখন গোপালপুর থানার আয়তন ছিল ৩৮৬ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৭১ হাজার ৭০২ জন। গ্রামের সংখ্যা ৬৯৫। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৫৩ হাজার ১৮৬ জন। মুসলমান ২ লক্ষ ১৮ হাজার ২৩৬ জন। খৃস্টান ৫ জন। প্রেত ঊপাসক ২৬৪ জন। ১৯০৪ সালে গোপালপুর উপজেলায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৪০ জন। এর মধ্যে ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা ছিল ৬৯৯ জন। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয় ঝাওয়াইল হেমন্তকুমারী হাইস্কুল, নন্দনপুর গার্লস হাইস্কুল, সূতি ভিএম হাইস্কুল এবং ভুটিয়া প্রাইমারি বিদ্যালয়। ১৯০৫ সালে গোপালপুর, কামাখ্যা মোহনপুর এবং নগদাশিমলা পোস্ট অফিস এবং গোপালপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিস স্থাপিত হয়। ১৯০৭ সালে গোপালুর-পিংনা টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপিত হয়। গোপালপুর থেকে সারা দেশের সাথে টেলিগ্রাম ব্যবস্থা চালু ছিল। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে ঝাওয়াইল, নন্দনপুর, প্রফুল্লনগর ( নগদাশিমলা ইউনিয়নের সৈয়দপুর) ও হেমনগর তহশীল কাচারি প্রতিষ্ঠিত হয়।
জমিদারী আমলে গোপালপুর থানা হেমনগর, ধনবাড়ি এবং নাটোরের রাণী হেমন্ত কুমারীর তালুক ছিল। এজন্য এ উপজেলার বাসিন্দারা তিন জমিদারের প্রজা হওয়ায় গ্রামে গ্রামে অশান্তিও ছিল। প্রজা দখল নিয়ে জমিদারের মধ্যে হুরহাঙ্গামা লেগেই থাকতো।
গোপালপুর বিভক্তিকরন :
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সরিষাবাড়ি থানা গঠিত হলে পিংনা গোপালপুর থেকে ব্যবচ্ছেদ করে সরিষাবাড়ির সাথে জুড়ে দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে গোপালপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন বিভক্ত করে ভূঞাপুর উপজেলা গঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে গোপালপুর উপজেলার মুশুদ্দী ইউনিয়নকে মধুপুর উপজেলার অর্ন্তভূক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ধনবাড়ি পৃথক উপজেলার মর্যাদা পেলে মুশুদ্দী ইউনিয়ন এর সাথে সংযুক্ত করা হয়। এভাবে টাঙ্গাইলের অন্যতম বৃহৎ থানা গোপালপুর ক্রমান্বয়ে অঙ্গচ্ছেদ হতে হতে বর্তমান অবয়বে টিকে রয়েছে।
প্রবন্ধকার :
গোপালপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি এবং দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সংবাদদাতা