আজ || রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


মুক্তিযুদ্ধে গোপালপুর থানা আক্রমণ ও দখল

মামুন তরফদার :

Map, Gopalpur-Tangail, By- K M Mithu (1)

টাঙ্গাইল জেলার উত্তরে অবস্থিত গোপালপুর থানা। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর নিকরাইল রানী দিনমনি হাইস্কুলে ৭০ জন কমান্ডারের মিটিংয়ের পর কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী গোপালপুর থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকজন কোম্পানী কমান্ডারকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়া কোম্পানী কমান্ডারগণ হলেন- নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানী, আব্দুর রাজ্জাক ভোলা, আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানী, বকুল কোম্পানী, আব্দুল হাকিম কোম্পানী, নূরুল ইসলাম কোম্পানী ও আনিসুর রহমান আনিস কোম্পানী, খন্দকার হাবিবুর রহমান কোম্পানী। এদের মধ্যে চারটি কোম্পানীর প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচটিকড়ি বসে পরামর্শ সভা করে গোপালপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানি গোপালপুর গরুহাটি দিয়ে আক্রমণ করবে। আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানী গোপালপুর দক্ষিণাংশ অর্থাৎ কীর্তনখোলা দিয়ে আক্রমণ করবে। আর আব্দুল হাকিম কোম্পানী পশ্চিম দিক থেকে মর্টার বাহিনী হিসেবে আক্রমণ করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর গোপালপুর থানা আক্রমণ হয়।

৯ ডিসেম্বর আনিস কোম্পানির একটি দল আর খন্দকার হাবিবুর রহমানের হাবিবের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানার পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। কিন্তু হানাদার বাহিনীর কোন প্রকার ক্ষয় ক্ষতি করতে পারেনি।  পরে খন্দকার হাবিবুর রহমানের কোম্পানী মধুপুর চলে যায়। সেখানে আনিসের কোম্পানীর একটি দলের সাথে মিলিত হয়ে মধুপুর থানার পাকিস্তানী হানাদারের সাথে যুদ্ধ করে মধুপুর থানা হানাদার মুক্ত করেন ৯ ডিসেম্বর।

নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুরের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা বৈরান নদীর পশ্চিম পারে নবগ্রাম, জামতৈল গ্রামের নদীর ধার দিয়ে ডিফেন্স নিয়ে যুদ্ধ করে। আর আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা নদীর পূর্বপার গোপালপুর তহসিল অফিস হয়ে পাটের গুদামের শেষ পশ্চিম কোন পর্যন্ত পজিশন নিয়ে যুদ্ধ করে। এছাড়া তারা মিঞা কমান্ডারের একটি প্ল¬¬াটুন তহসিল অফিস থেকে গোপালপুর কলেজ পর্যন্ত পজিশন নিয়ে হানাদার শত্র“র সাথে যুদ্ধ করেন। আরজু কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা ৮ ডিসেম্বর দুইজন রাজাকারকে আক্রমণ করেন। ৯ ডিসেম্বরের যুদ্ধে ১৫ জন রাজাকার এই কোম্পানীর মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। ৯ তারিখে বৈরান নদীর পশ্চিম পার ভূয়ারপাড়া গ্রামে আগুনের কুন্ডলি জ্বালানোর জন্য আঙ্গুর তালুকদারের নিকট কাদের সিদ্দিকী নির্দেশ পাঠান। ঐ কুন্ডলির আগুন ও ধূয়া দেখে গোপালপুর থানার হেড কোয়ার্টারের দূরত্ব নির্ধারণ পূর্বক বাংলাদেশের নব গঠিত বিমান বাহিনী আকাশ পথে আক্রমণের সহায়তা করবে। আঙ্গুর তালুকদার আগুনের কুন্ডলি না জ্বালানোর কারণে বিমান হামলা করতে এসে বিমান ফেরত যায়। ফলে আঙ্গুর তালুকদারের উপর কাদের সিদ্দিকী রেগে যান। ৯ ও ১০ ডিসেম্বর এই দুই দিন শত্র“সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। মুক্তি বাহিনী থানার কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসেন। এমতাবস্থায় কী করা যায় তা নিয়ে প¬াটুন কমান্ডার চাঁদ মিঞা কয়েকজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। এই পরামর্শে যেসব মুক্তিযোদ্ধা অংশ গ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন- জনাব আব্দুল লতিফ খান, শামছুল আলম, আব্দুল লতিফ মিঞা, আব্দুর রহমান, সাহেব আলী, আমজাদ হোসেন প্রমুখ।

১০ ডিসেম্বর বেলা ৩ টায় ভারতীয় ৩টি মিগ-২১ বিমান গোপালপুর ও ঘাটাইল থানার উপর একযোগে ট্রাম্পিং করে। দুই থানার ক্যাম্পে অবস্থিত পাক সেনা ও রাজাকারা বাচার তাগিদে রাতের আধারে গোপালপুর থেকে পালিয়ে যায়। এদিকে বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকায় গোপালপুর থানার সূতি, নন্দনপুর, ভূয়ার পাড়া, চরপাড়া, গোপালপুর গরুহাটিসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ দূরত্ব থেকে পাক সেনাদের ঘেরাও করে রেখেছিলেন। পাক সেনাদের পালিয়ে যেতে দেখে তারা মিঞা কমান্ডার ও চাঁদ মিঞার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধরার জন্য ধাওয়া করেন। প্রায় ১ ঘন্টা গোলাগুলি হয়।

১০ ডিসেম্বর সকাল ১০ টার মধ্যে শত্র“ সেনা গোপালপুর থানা থেকে পালিয়ে যায়। সকাল ১১ টা ৩০ মিনিটে আরজু কোম্পানীর চাঁদ মিঞার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে গোপালপুর থানায় প্রবেশ করেন। সেই সাথে গোপালপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। সর্ব প্রথম চাঁদ মিঞা, সাহেব আলী, শামছুল আলম, আব্দুল লতিফ, আজাহার, কাদের তালুকদার, তোরাপ সিকদার, ইসমাইল হোসেন মৃধা, আব্দুস ছোবহান তুলা প্রমুখ গিয়ে থানায় উঠেন। পরে আসাদুজ্জামান আরজু কমান্ডার, বিমল, হায়দার, জয়নাল, শুকুর নামক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে থানায় প্রবেশ করেন।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্তরের মানুষ থানায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানান এবং তাদের সাথে কোলাকোলি করেন। পরে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি খাবারের ব্যবস্থা করেন। ১০ ডিসেম্বর শনিবার গোপালপুর থানার পাক হানাদার মুক্ত হয়। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ে।

গোপালপুর থানা আক্রমণ ও দখলের যুদ্ধে দুই জন পাক সেনা নিহত হয়, ১৫ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করে এবং তিনশ জন রাজাকার ধরা পরে। তাদের মধ্যে ৭৫ জন রাজাকারকে একটি ইন্দিরায় গুলি করে হত্যা করে ফেলে দেয়। পাক সেনাদের ৭৫/৮০ টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। শত্র“ সেনাদের কাছ থেকে পাওয়া সকল জিনিসপত্র নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানী কমান্ডার আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানী কমান্ডারের নিকট থেকে বুঝে নেন। নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুরের নেতৃত্বে গোপালপুর থানায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়। আসাদুজ্জামান আরজু তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য পাকুটিয়া চলে যায়। সেখানে রামচন্দ্রপুর গ্রামে অবস্থানরত ২৫ জন পাকিস্তানী সৈনিক আরজু কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে।

৮ ডিসেম্বর বুধবার থেকে ১০ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত গোপালপুর থানা আক্রমণ ও দখলের যুদ্ধে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন- সর্বাধিনায়ক নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর, কোম্পানী কমান্ডার আসাদুজ্জামন আরজু, আব্দুল হাকিম, বকুল,,মোজ্জাম্মেল হক টুকু, আনিসুর রহমান আনিস, নূরুল ইসলাম, খন্দকার হাবিবুর রহমান, তারা মিঞা কমান্ডার, চাঁদ মিঞা, আব্দুল লতিফ মিঞা, তোরাব আলী সিকদার, সাহেব আলী, আব্দুর রহমান, আমজাদ হোসেন, আব্দুল লতিফ খান, আব্দুর রশিদ খান, ওমর আলী তালুকদার, জহুরুল ইসলাম ফকির, বাদশাহ আলমগীর, হায়দার, শমছুল আলম, শহীদুল ইসলাম লালু বীর প্রতীক, সমরেন্দ্র নাথ সরকার বিমল, মোঃ আব্দুল বারী, মহির উদ্দিন, শাহ আলম তালুকদার, শাহজাহান মিঞা, ফজলুল হক, মোঃ আয়নাল হক, মোঃ আবুল হোসেন, ইদ্রিস আলী, ইদ্রিস হোসেন খান মজনু, শহর আলী, আবুল কাশেম, সোহরাব আলী, আলতাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, মজিবর রহমান, সাহেব আলী খান, আফতাব উদ্দিন, শামছুল আলম প্রধান, সালাম পারভেজ ফকির, সেকান্দর আলী, আব্দুল গফুর, আব্দুল কাদের তালুকদার, শাহজাহান আলী তালুকদার, সিরাজ আলী তালুকদার, কছিম উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, আব্দুল আজিজ, হযরত আলী খান, মোঃ আব্দুর রশিদ, মজিবর রহমান-২, আব্দুল বাছেদ শিকদার, আব্দুস সাত্তার, আজহারুল ইসলাম, মোঃ শামসুল আলম-২, মোঃ আব্বাস আলী, আবুল কাশেম, মীর জয়নাল আবেদীন ফকির, ইসমাইল হোসেন মৃধা, সোহরাওয়ার্দী তালুকদার, মোঃ আব্দুল হামিদ, আফছার আলী, মোঃ শামছুল হক-২ নাজিম উদ্দিন, আমিনুল ইসলাম, মোঃ হায়দার আলী, মোঃ মনসুর রহমান, আব্দুল আজিজ-২, আব্দুল কুদ্দুছ মিয়া, আব্দুস সামাদ মন্ডল, মোঃ শামসুল আলম-৩, আব্দুস সামাদ তালুকদার, এখলাছ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, শহীদ আবু তালেব, চাঁদ মাহমুদ, মির্জা এছহাক আলী, শদর আলী, শামছুল হক-৪, আব্দুস সামাদ-২, আব্দুর রহিম তালুকদার, মোঃ শওকত আলী খান, আবুল হোসেন, আব্দুল হাকিম-২, ছাইদুর রহমান, জামাল উদ্দিন আকন্দ, আশরাফ আলী, আব্দুল আজিজ আকন্দ, আব্দুর রশিদ, ইবরাহীম হোসেন, জয়নাল আবেদীন, তোতা জামাদ্দার, শাহজাহান আলী খান, হারুন-অর-রশীদ, আজিজুল হক মিঞা, আমীর আলী, আব্দুর রহমান খান, আব্দুর গফুর আকন্দ, আব্দুল গফুর প্রধান, আব্দুল জলিল মিঞা, আব্দুস ছাত্তার তালুকদার, ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা, মিনহাজ উদ্দিন, আজহার ডাক্তার, ওয়াদুদ, মজিবর, আজগর, মালেক, আব্বাস প্রমুখ।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!