মো. রুবেল আহমেদ, নিজস্ব প্রতিনিধি :
এ দেশের জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন টাঙ্গাইলের মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ অনেক রাজনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছিলেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। মানবসেবায় অবদান রেখেছেন রণদা প্রসাদ সাহা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন গোলাম রব্বানী ছোটন। জাদুবিদ্যায় বিশ্বকে তাক লাগানো পিসি সরকার, বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা আসলাম তালুকদার মান্না, অমিত হাসান, নাঈম, প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদ, জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশো, অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, কণ্ঠশিল্পী বেলাল খান, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেন চালক সালমা খাতুনের জন্ম এই টাঙ্গাইল জেলায়।
তেমনি গোপালপুরে জন্মগ্রহণ করেছেন বর্তমান সময়ের তারকা বা সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি—যাদের পরিচিতি রয়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। যেমন, দেশের নারী ফুটবলে আলোড়ন তুলেছেন কৃষ্ণা রানী সরকার। সংগীতে পরিচিত মুখ শাহীন খান, পলাশ শীল, শেখ সোলায়মান, রাকিব, রবি কিশোর এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট তৈরি করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া জীবন আহমেদ নিলয়ের উঠে আসার গল্প আজ জানব।
কৃষ্ণা রানী সরকার
নগদা শিমলা ইউনিয়নের উত্তর পাথালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক কৃষ্ণা রানী সরকার। তার শুরুটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। নারী সতীর্থ না মেলায় ছোটবেলায় ছেলেদের সাথেই ফুটবল খেলতে হতো। এতে পরিবারকে নানাভাবে কটুক্তি সইতে হয়েছে। ফুটবলের প্রতি আসক্তি কমাতে মা নমিতা রানী একসময় ক্ষোভে কৃষ্ণার ফুটবল কেটে ফেলেন। তবুও অদম্য কৃষ্ণাকে থামানো যায়নি।
প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ দেখে ডাক পড়ে সূতী ভিএম মডেল পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের তত্ত্বাবধানে তার এগিয়ে যাওয়া শুরু।
সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২-এর ফাইনালে কৃষ্ণার দুই গোলের সুবাদে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে নেপালকে হারিয়ে শিরোপা জিতে। তিনি বসুন্ধরা কিংস মহিলা দলের হয়ে ক্লাব ফুটবল খেলেন। এছাড়াও সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ, বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ নারী আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ–দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় এশিয়া টুর্নামেন্টে অংশ নেন।
তিনি বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলের অধিনায়ক ছিলেন। ২০১৫ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে। খেলাধুলার পাশাপাশি বর্তমানে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে স্নাতক অধ্যয়নরত।
শাহীন খান
হেমনগর ইউনিয়নের সোনাটা গ্রামে জন্ম নেওয়া শাহীন খান উঠে আসেন চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে। এন. আই. শুভর লেখা তার একক অ্যালবাম আনকোড়া’র একটি গান “আমার জনম জনম গেল ভুলে ভুলে কইরা পিড়িতি” এবং কিস্তিমাত সিনেমায় পড়শীর সাথে প্লেব্যাক করা ‘পড়েছি প্রেমে প্রথম দেখায়’ গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
শাহীন খানের বাবা গান করতেন। ছোটবেলায় বাবার কোলে বসেই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি চাচার কাছে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন এবং থিয়েটার করতেন। ২০১২ সালে চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ রিয়েলিটি শোয়ের প্রথম রানার্স আপ হন। এরপর বড় বড় চাকরির অফার পেলেও সংগীত চর্চায় মনোযোগ দিতে সেগুলো ফিরিয়ে দেন। বর্তমানে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক দলে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
শাহীন জানান, রিয়েলিটি শোয়ের বিচারক সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে পরিচয় তার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। তিনি তাকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন।
পলাশ শীল
হেমনগর ইউনিয়নের হেমনগর জমিদার বাড়ির পাশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা পলাশ শীলের পরিবারে ছিল গান-বাজনার পরিবেশ। ছোট থেকেই ঘরে ঢোল, তবলা, বেহালা দেখে সংগীতের প্রতি আকর্ষণ জন্মে। হেমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের হাত ধরে তার সংগীত জীবনের শুরু।
মাছরাঙা টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো ম্যাজিক বাউলিয়ানা ২০১৯-এ যৌথ বিজয়ী হন। এখান থেকেই জনপ্রিয় বাউল শিল্পী শফি মণ্ডলের শিষ্যত্ব নেন। জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সাথে ডুয়েট গান গেয়ে আলোচনায় আসেন। তিনি ফোক ও লালনের গান গাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে নিয়মিত স্টেজ প্রোগ্রাম করেন। সম্প্রতি ইয়োডা ইউনিভার্সিটি থেকে লোকসংগীতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
পলাশ শীল বলেন, সংগীতের উপর পড়াশোনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগীত আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই।
শেখ সোলায়মান
নগদা শিমলা ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের শেখ সোলায়মান শখের বশে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ফেসবুকের কল্যাণে তার বাঁশির সুর লাখো মানুষের হৃদয় জয় করেছে। তবে বিভিন্ন সময় কটু কথাও শুনতে হয়েছে। এমনকি বড় চুল কেটে ছোট করতে বাধ্য হয়েছেন। ফেসবুকে তার প্রায় ৬ লক্ষ ফলোয়ার এবং টিকটকেও বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। অনেক প্রবাসী ভক্তও রয়েছে।
বাঁশির পাশাপাশি নিজের দরাজ কণ্ঠে খালি গলায় গানও করেন। ফলোয়ারদের অনুরোধে স্টেজ প্রোগ্রামেও যান। প্রতিটি প্রোগ্রামে তিনি ডিসক্লেইমার দিয়ে বলেন “আমি কোনো পেশাদার শিল্পী নই। শখের বশে বাঁশি বাজাই ও গান গাই।”
সোশ্যাল মিডিয়ার ভক্তদের সহযোগিতায় মসজিদ নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছেন।
রাকিব হাসান
ঝাওয়াইল ইউনিয়নের ভেঙ্গুলা গ্রামের রাকিব হাসান গান কাভার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অনার্সে পড়াশোনা চলাকালীন ২০২১ সালে করোনায় সব বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ইউকুলেলে বাজানো শেখেন। এরপর গান কাভার করে ফেসবুকে আপলোড শুরু করেন। প্রথমে সাড়া না পেলেও ২০২৩ সালে একটি গান ভাইরাল হলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে তার ৮ লক্ষাধিক ফলোয়ার রয়েছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও ডাক পাচ্ছেন। ফ্ল্যাশব্যাক নামে একটি ব্যান্ডের সাথে নিয়মিত স্টেজ প্রোগ্রাম করেন। ভবিষ্যতে ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সংগীতের মাধ্যমে দেশসেবার স্বপ্ন দেখেন।
রবি কিশোর
মির্জাপুর ইউনিয়নের উত্তর মান্দিয়া গ্রামের রবিউল ইসলামকে ‘রবি কিশোর’ নামটি দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর নিজেই। ছোটবেলা থেকেই এন্ড্রু কিশোরের গান অনুকরণ করতেন। বাংলাদেশ আইডল রিয়েলিটি শোতে অংশগ্রহণের সময় এন্ড্রু কিশোরের সাথে আবেগঘন মুহূর্ত ভাইরাল হয়।
পরে তিনি নিয়মিত এন্ড্রু কিশোরের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ভুঞাপুরে এন্ড্রু কিশোরের শেষ স্টেজ প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকার সুযোগ পান।
এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর পর তার স্মরণে, রুবেল আহমেদ এর কথায় “দাদা তুমি চলে গেলে আমায় ফেলে একা” গান গেয়ে আলোচনায় আসেন রবি কিশোর। বর্তমানে তিনি বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী।
জীবন আহমেদ নিলয়
নগদা শিমলা ইউনিয়নের জামতৈল গ্রামে জন্ম নেওয়া জীবন আহমেদ নিলয় সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট তৈরি করে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।
তার বর্তমানে টিকটকে ৩৪ লক্ষ, ফেসবুকে ৯ লক্ষ এবং ইউটিউবে ২ লক্ষাধিক ফলোয়ার রয়েছে।
২০১৬ সালে কয়েকজন বন্ধু মিলে ইউটিউবিং শুরু করলেও সফল হননি। পরে একাই কাজ চালিয়ে যান। ২০২১ সালে সফলতা ধরা দিলে বন্ধুরা আবার যুক্ত হন।
জীবন আহমেদ নিলয় বলেন, পরিচিতি যেমন আশীর্বাদ, তেমনি শুটিংয়ের সময় নানা বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়। আমার প্রতিটি ভিডিওতে সমাজসেবামূলক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি। সবার ভালোবাসা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চাই।