ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। শোকের মাস। অহংকারের মাস। এ মাসেই বাঙালী হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস রচনা করেছে। বিশ্বকে অবাক করে লাল সবুজের মহান বিজয় ঘরে তুলেছে সগৌরবে। একাত্তরের মার্চে শুরু হওয়া সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ পায় ডিসেম্বরে।
সাড়ে চার দশক আগে ডিসেম্বরের সেই ঘটনাবলী আমার মতো প্রবীণ অথবা প্রবীণতর যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা অবলোকন করেছেন অথবা স্বজন হারিয়েছেন অথবা যুদ্ধে অংশ নিয়ে আমাদের মহীয়ান করেছেন, তাদের সবাই কমবেশি স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েন।
দেখতে দেখতে এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ সাড়ে চার দশক পার করেছে। আরো চার বা পাঁচ দশক পর মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন এমন সৌভাগ্যবান মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অতদিন পর অনাগত সেই প্রজন্ম আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে দেখবেন, কীভাবে মূল্যায়ন করবেন সেটি মাঝেমধ্যে ভাবিত করে। কারণ আমরা নবাব সিরাজকে দেখিনি। তবে পলাশীকে মনে রেখেছি। আমরা পলাশীর মীরজাফরকে ঘৃণা করি। কিন্তু রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের মন্ত্রী বানিয়ে নিজের গায়ে কালিমা লেপন করেছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন এমন পিশাচরা মন্ত্রীর মর্যাদায় লাল সবুজ পতাকার গাড়িতে ঘুরার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। যা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করার নির্লজ্জ প্রয়াস। সেই থেকে অনেক সময় প্রশ্ন জাগে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেলে রাজনৈতিক মতবিরোধের জেরে আবারো সেই ঘৃণ্য পরিস্থিতির পুনরাবর্তণ ঘটবে নাতো?
‘গোপালপুর বার্তা’ মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্মের কথা তুলে ধরতে চায়। দেশ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রচলিত রাজনীতি নিয়ে কী ভাবনা তাদের সেটিই হবে প্রতিপাদ্য বিষয়। আমরা প্রথম কিস্তিতে আয়না ইয়াসমিন শিমুর ভাবনার অনুলিখন তুলে ধরতে চাই।
শিমুর নানা আব্দুল হাকিম একজন মুক্তিযোদ্ধা। নানার মুখে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির নির্যাতন, গণহত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগের কথা শুনে অবাক হয়েছে। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছে। এক সাগর রক্ত, মহাসমুদ্রসম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া যে স্বাধীনতা, এর বর্তমান স্বরুপ অথবা যে স্বপ্ন নিয়ে বীরসন্তানরা যুদ্ধ করেছিল সেই দেশের বর্তমান যুব সমাজ, প্রশাসণ অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা কাঙ্খিত রুপ পাচ্ছেনা কেন এমন শত প্রশ্ন উঠে এসেছে শিমুর ভাবনায়। তার কাঁচা লেখায় নতুন ভাবনাও রয়েছে কিছুটা। আশা করি গোপালপুর বার্তার পাঠকদের তা ভালো লাগবে।
শিমু এবার গোপালপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে নার্সিং বিষয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। নার্স পেশা তার খুব পছন্দের। এতে সে অসহায় ও মুর্মূষ মানুষের সেবা করতে পারবে বলে আশা করছে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য তার সেবার এ মানসিকতাকে আমরা সন্মান করি। এবার তার মুখেই শোনা যাক দেশ নিয়ে, বর্তমান সমাজ নিয়ে তার ভাবনার প্রতিমূর্ত।
‘আমার নাম আনিয়া ইয়াসমিন শিমু। জন্ম ২০০০ সালের ৪ মে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখছি। এটি আমার সৌভাগ্য যে এমন একটি দেশে জন্মগ্রহন করেছি। কিন্তু কোনো কোনো সময়, কোনো বিষয় মন খারাপ করিয়ে দেয়। এর একটি হলো মাদক। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ এতোটাই স্বাধীন হয়েছে যে শহরের অলিতেগলিতে গাজা, হেরোইন, মদ আর ইয়াবা ব্যবসা করছে। চৌরাস্তার মোড়ে বা বাঁকে অবাধে চলে ছিনতাই। দুদিন পর পর মিডিয়ায় প্রচারিত হয় অমুক জায়গায় অমুক ধর্ষিতা বা গণধর্ষনের শিকার হয়েছে। এ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল হয়। মানববন্ধন হয়। প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। পুলিশ প্রশাসণ মিডিয়ায় বক্তব্য দেন ধর্ষককে গ্রেফতার করা হবে। কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। হয়তো গ্রেফতারও হয়। কিন্তু কয়জনের শাস্তি হয় কতোজন ফাঁকফোকরে বেরিয়ে আসেন তার হিসাব নেই। কিন্তু ধর্ষণ থামেনা। এটি হরদম চলে। যেন এটি চলবেই। যেমন চলছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে স্বাধীন বাংলাদেশ কী ধর্ষকদের প্রতিরোধ বা সামলাতে পারছেনা?
টাকা ছাড়া কেনো চাকরি হয়না? যখন যারা ক্ষমতায় যায় সবাই এ কাজ করে। টাকা দিয়ে যারা স্কুল-কলেজে চাকরি নিচ্ছে সেইসব অযোগ্য শিক্ষকরা কিভাবে যোগ্য নাগরিক গড়ে তুলবে? একশ পার্সেন্ট কৃতকার্যের গৌরব দেখাতে শিক্ষকরা যখন পরীক্ষার হলে ঢুকে শিক্ষার্থীদের খাতায় ডিরেক্ট উত্তর লেখায় সহযোগিতা করে তখন সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন হারিয়ে যায়।
এই যে গোপালপুর হাসপাতাল যেখানে গেলে গরীব রোগীরা বিনামূল্যের ওষুধ পায়না। ডাক্তাররা নিয়মিত হাসপাতালে আসেন না। ভালো করে সেবা দিতে চাননা। এর কেনো প্রতিকার হয়না? এই যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে শতশত নেতা, পাতিনেতার ডিজিটাল ব্যানারে শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক যা দেখলে গা রি রি করে, যাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করে ওরা রাজনৈতিককর্মী হয় কী করে? ওরা নেতার খাতায় নাম লিখিয়ে মাদক ব্যবসা করছে, চাঁদাবাজি করছে তা সবাই জানলেও কেউ প্রতিকার করেনা। আবার মুক্তিযোদ্ধা কোঠার নামে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পড়াশোনা না করেই ভালো রেজাল্ট করছে। সেই সার্টফিকেট দিয়ে ঘুষের বিনিময়ে চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছে। তাহলে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে কী হবে? টাকা না থাকলে তো চাকরিও জুটবেনা।
নেশাখোররা দলীয় নেতাকর্মী হন। নেতারা গ্রুপিংয়ের কারণে তাদের তোয়াজ করেন। তাহলে মেধাবীরা রাজনীতি করার উৎসাহ পাবেন কেমনে? এরকম হাজারো কি, কেমনে, কেনো, কোথায়, কিজন্য ইত্যাদি প্রশ্ন মনে গুমরে দলা পাকায়। এ সবের উত্তর কোথায় আর কার কাছে পাবো জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে গতি শ্লথ। কারণ শেখ হাসিনা যখন অগাধ সলিলে প্রতিকূল পরিবেশে নৌকাকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রানান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন তখন কোনো কোনো ধান্ধাবাজ নেতা, উপনেতা ও চামচা সেই নৌকায় উঠে আরাম করছেন, ঝিমুচ্ছেন, আরো টাকা বানানোর খোয়াব দেখছেন।
আমরা রাজাকার আলবদর মুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ যেমন চাই তেমনি জেলা উপজেলার নেতা নামধারি নেশাখোর, ঘুষখোর, ধান্ধাবাজ, এজেন্ডাবাজ, দুর্নীতিবাজ, বকোওয়াজবাজ ও চাপাবাজদের থেকে মুক্তি চাই। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিফলিত হোক ঘরে ঘরে। নানা খাতের উন্নয়নে বিশ্বকে চমক দেখানোর যে প্রচেষ্টা চলছে তাতে আরো গতি বাড়ুক এ প্রত্যাশা মহান ডিসেম্বরে ’।