অবিভক্ত বাংলা থেকে আজকের বাংলাদেশ অবধি যে ক’জন শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলার কৃষককুলকে বৃটিশ শাসনের নাগপাশ ও পকিস্তান শাসকদের সামন্তবাদী জমিদার পরগাছার নানা অত্যাচার-নির্যাতনমুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছেন তাঁদের মধ্যে হাতেম আলী খান অন্যতম।
তিনি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় একটি ছোট জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়ে জমিদারদের কৃষকের স্বার্থবিরোধী অন্যায়নিয়মনীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করেছেন, সংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতি-সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ খুজতে তাঁর জন্মের শত বছর পর তাঁকে আজও স্মরণ করা হয়।
হাতেম আলী খানের জন্ম টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বেলুয়ার জমিদার নায়েব আলী খানের পরিবারে ৭ ডিসেম্বর ১৯০৪ সালে। এবং মৃত্যু ১৯৭৭ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকার শাহজাহানপুরে বড় মেয়ের বাসায়।
হাতেম আলী খানের পিতা ছিলেন অত্র এলাকার জমিদার নায়েব আলী খান। নায়েব আলী খানের পিতা ঝোমর আলী খান এবং তদীয় পিতা বেলু খান পাঠান। নায়েব আলী খানের নয় ছেলে নওয়াব আলী খান, আহাম্মদ আলী খান, হযরত আলী খান, আব্দুল হামিদ খান, হাসমত আলী খান, হাতেম আলী খান, আব্দুল জব্বার খান, আব্দুল লতিফ খান ও আব্দুল রশিদ খান। ভাইদের মধ্যে হাতেম আলী খানের চিন্তা-চেতনার ধারের কাছে কেউ ছিল না। তাঁর তিন ছেলে কামরুজ্জামান খান খসরু, সামছুজ্জামান খান মাখন ও সেতারুজ্জামান খান বাদল এবং তিন মেয়ে বাসন্তি, মালতি ও আরতি। মেয়ে বাসন্তি ও আরতি ছাড়া কেউ জীবিত নেই। এতো বড় একটি খ্যাতিমান পরিবারের হাতেম আলী খানের আট ভাইদের মধ্যে একমাত্র আব্দুল জব্বার খান ব্যতিত কেউ তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না।
জমিদার বাড়ীর ছেলে হলেও হাতেম আলী খানের মধ্যে কখনো জমিদারি মেজাজ মনে প্রাণে ধারণ করতে না। ছোট বেলা থেকেই তাঁর মনপ্রাণ কোন এক মহত্তর আদর্শের সন্ধানে উন্মুখ হয়ে থাকতো। সাধারণ ছোটখাট জমিদার হলেও তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমার গোপালপুর উপজেলার বেলুয়া গ্রামের এই জমিদার সাহেবের প্রভাবসহ বেশ নামডাক ছিল এ অঞ্চলে। পাকা দেয়ালঘেরা বাড়ীতে দালানকোঠা ও পাকা বড় বড় টিনের ঘর, পাইক-পেয়াদা, চাকর-প্রজায় সরগরম থাকতো বাড়ীটি। বাড়ীর পাকা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে ইমামের সুমধুর আযান, কোরআন পাঠ সবই ইসলামিরীতি অনুযায়ী চলতো। অন্দর মহলে বাড়ীর বৌ-ঝি, চাকরাণী, বাবুর্চিদের কলকন্ঠে মুখরিত পরিবেশ কোন কিছুই খান সাহেবের নিজের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি তাঁর মতই চলাফেরা করতেন। কোন বাধা নিষেধ তাঁকে তাঁর পথ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। জমিদার বাড়ীর ছেলে হয়েও লক্ষী ছাড়াদের দলে ভিড়বেন এবং অভিজাত সমাজের আচার কানুন ছেড়ে দিয়ে দেশের দুর্দশাগ্রস্থ চাষীদের জীবনের সাথে নিজ জীবনকে এমন ভাবে জড়িয়ে দেবেন তাঁর আপনজনেরা কখনো কল্পনাও করতে পারেননি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে শুরু হলে এর দুবছর পর যুদ্ধে যোগদানের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। বারো বছরের বালক হাতেম আলী খান তখন হেমনগর হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধে যোগদানের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৈন্যদলে নাম লেখাবার জন্য দরখাস্ত করেন। এই দরখাস্তের উত্তরে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রযতেœ তাঁর নামে একটি ফরম পাঠিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফরম দেখে প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ চন্দ্র চক্রবর্তী হাতেম খানকে ডেকে এনে বুঝিয়ে কিছু বকুনি দিয়ে এ পথ থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করেন। বাঁধা পেয়ে তাঁর মন ভেঙ্গে যায়। তিনি জ্যোতিষ বাবুকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন এবং জ্যোতিষ চক্রবর্তীও মাঝে মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেশ ও দেশের প্রতি কর্তব্য বিষয়ে আলাপচারিতা করতেন। এভাবে আশাভঙ্গ কিছুটা কেটে যায়। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে হয়, সেই দরখাস্তের একটা খসড়া হাতেম আলীর খাতায় লেখা ছিল। দৈবক্রমে খসড়াটি হাতেম আলী খানের এক বড় ভাইয়ের সহপাঠী মাখন চন্দ্র দেবের নজরে পড়ে। মাখন বাবু ছিলেন সন্ত্রাসবাদীদল অনুশীল পার্টির কর্মী। এই মাখন বাবু খসড়াটির সূত্রধরে দেশের স্বাধীনতা ও ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়নের পন্থা নিয়ে খান সাহেবের সাথে আলাপ আলোচনা করতেন এবং এ বিষয়ের উপর লেখা দু’একটা বইও তাকে পড়তে দিতেন। এভাবে খান সাহেবের মন সন্ত্রাসবাদী আদর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। মাখন বাবু এজন্য তাঁকে শারীরিকভাবে যোগ্যতা অর্জনের ব্যায়াম, কুস্তি, লাঠিখেলা, তলোয়ার খেলা, নদীতে সাঁতার কাটা ইত্যাদি চর্চ্চা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং তাঁদের বাড়ীতেই প্রথমে গোপানে ও পরে প্রকাশ্যেই মাইনে করা একজন ওস্তাদের কাছে এসব শিখতেন।
বাল্য বয়সেই হাতেম আলী খান ভারতের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত মুসলিম রেনেসাঁর পীঠস্থান আলীগড়, দিল্লী, আগ্রা, সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেপুর, সিক্রি, পানিপথ, বিন্ধাপর্বত, নর্দমা, শিবাজীর পুনা, রাজপুত রানা ও প্রতাপের আরবল্লী ইত্যাদি স্থান ভ্রমণে তাঁর মন আগ্রহী হয়ে উঠে। ভ্রমণের সাধ মিটাতে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে তিনি বাড়ী থেকে পালিয়ে যান। কলকাতার হাওড়া ষ্টেশনে আলীগড়ের এক বাসিন্দার পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং তার সঙ্গে তিনি আলীগড় চলে যান। কিন্তু তাদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে দু’একদিন পরেই তিনি তাদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসেন। ক’দিন পথে পথে কাটিয়ে টাকা-পয়সা কমে গেলে ভারত ভ্রমণের বাসনা স্থগিত করে উনিশ দিন পরে বাড়ী ফিরে লেখাপড়ায় মনোযোগী হন।
হেমনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ১৯২১ এর অসহযোগ আন্দোলনে সারা ভারতবর্ষ প্লাবিত হয়। সম্ভবত জুন কি জুলাই মাসে ছাত্ররা ক্লাসে বসে প্রফেসারের বক্তৃতা শুনছেন এমন সময় হাজার হাজার ছাত্রজনতার গগনাবিদারী ‘বন্দে মাতরম’ বৃটিশ কুকুর দেশ ছাড় ধ্বনি কলেজের বাইরে উচ্চারিত হচ্ছিল। রিপন কলেজের প্রায় চার হাজার ছাত্র এক ডাকে বের হয়ে পড়লো। মিছিলে তখন প্রায় পাঁচ হাজার নারী পুরুষ সামিল। দিন দু’একের মধ্যে কলকাতার সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শূন্য হয়ে যায়। বহু খ্যাতনামা অধ্যাপক, শিক্ষক, উকিল ও ব্যারিষ্টার নিজেদের কাজ ছেড়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্ররা এসব ব্যক্তিদের বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়লো। কলকাতায় যেখানেই খোলা যায়গা সেখানেই সভা। রিপন কলেজের একমাত্র মুসলমান অধ্যাপক মৌলানা মোয়াজ্জেম হোসেন এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেন।
হাতেম আলী খান এই আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়লেন। কয়েক মাস পরে নিজের অঞ্চলে আন্দোলন সৃষ্টি করবার জন্য হেমনগর হাই স্কুলে সভা করলেন। তারপর গ্রামের স্কুল গুলোতে ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়। খানের ওজস্বিনী বক্তৃতায় সারা অঞ্চলটা মেতে উঠে। অন্যান্য স্কুলের মতো হেমনগর জমিদারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ছাত্ররাও ধর্মঘটে যোগ দিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে এসেছিল। জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী তার মা শশীমূখীর নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলের এই সঙ্কটজনক অবস্থায় হাতেম আলীর বাবাকে হেমচন্দ্র চৌধুরী অনুরোধ করেন তার ছেলেকে এ কাজ থেকে নিবৃত করতে। খানের বাবা এ বিষয়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হাতেম আলী খান বরং বাড়ীর সাথে সম্পর্ক ছেড়ে দিয়ে গ্রামের পর গ্রামে সভা-সমাবেশ করে চললেন। এসব সভায় তিনি বিলেতি পণ্য বর্জনের সাথে সাথে জমিদারদের খাজনা ও মহাজনের পাওনা টাকা বন্ধ করে দেবার কথাও বলতেন। জমিদারের ছেলে হয়েও কৃষকদের মধ্যে জমিদারের খাজনা বন্ধ করে দেবার কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন বলে তাঁর বাবা ছেলের উপর চটে যান। এদিকে হাতেম আলী খানের নিজের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে উঠে। তাঁর কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা কিছুই নেই। এ সময় বড় ভাইয়ের উপদেশ মত তিনি তাঁতের কাপড়ের কারবার শুরু করেন এবং ঘোড়ার পিঠে কাপড়ের বোঝা চাপিয়ে তার এলাকা থেকে দুতিন মাইল দূরে প্রতিদিন হাটে কাপড় বিক্রি করতেন। এভাবে বছর খানেক কাটল। তবে এতে তাঁর নিজের শরীর খারাপ হয়ে গেল।
এসব পরিস্থিতি কাটিয়ে তিনি ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে কলকাতায় গিয়ে একটি ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হয়ে যথারীতি লেখাপড়া শুরু করেন। মাস কয়েক বাদে তিনি ওখান থেকে চলে গিয়ে রিপন কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে আইএ পাস করে ওখানেই বিএ পড়তে লাগলেন। বিএ পড়ার সময় তিনি নিজ গ্রামে ও আশেপাশের গ্রামে আগের মত সভা-সমাবেশ করতেন। এসব সভায় তিনি বৃটিশ সরকার ও তার অনুচর দেশীয় জমিদার, তালুকদার, মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালে তাদের প্রজাদের মধ্যে অনেকে খাজনা বাকী রাখতে শুরু করে। তাঁর নিজের গ্রামের মহাজনীতে প্রায় ৯০ হাজার টাকা দাদন ছিল। তার কোন হিসাব রইলো না, কি সুদ কি আসল কোনটারই না। বর্গাদারাও নিয়মমত ফসল দেয়া বন্ধ করে দেন।
রিপন কলেজের হোষ্টেলে তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে ’ন্যাশনাল লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুললেন। চীনের কন্সাল তাতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরে আরও কয়েকজন এসে তাদের সাথে যোগদেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা কলেজ স্কোয়ারের থিওসোফিষ্ট হলে সভা করলেন। কিছু সামাজিক কর্মসূচী থাকলেও এই সংগঠনের রাজনীতিই ছিল মূল উদ্দেশ্য। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের কাছ থেকে বোমা ইত্যাদি তৈরীর সূত্রও তারা সংগ্রহ করতেন। কিছু যন্ত্রপাতিও তৈরী করার চেষ্টাও করতেন। এই সব করতে করতে গোপন কাজের জন্য জায়গা খুঁজতে খুঁজতে তারা বিহারের কিংবদন্তীর কথিত নায়ক রাজা হরিশ চন্দ্রের বাড়ী বোটাস হিলে গিয়ে পৌঁছিলেন। এই উদ্দেশ্যে সাধনে তৎপর তারা গয়া কাশি ইত্যাদি জায়গাও ঘুরে ফিরে দেখছিলেন। ফরাসী শহরে সে সময়ের চন্দননগর তাদের বিশেষ আড্ডাস্থান ছিল। এসব কাজের কথা জানাজানি হয়ে গেলে তাঁর এই বাউন্ডেলেপনার খবর বাবা নায়েব আলী খানের কাছে পৌঁছে। পড়াশোনা না করলে খরচপত্র বন্ধ করে দেয়ার হুসিয়ারী পাঠালেন তিনি ছেলেকে। পড়াশোনা তো ছিল একটা উপলক্ষ মাত্র। তাই বাড়ী থেকে ১৫০ টাকা মাসোহারা বন্ধ হয়ে গেলে কেমন করে চলবে। অথচ তাঁর বাবা মনে মনে ভাবছিলেন বিএ পাস করার পর তাঁকে ব্যারিষ্টারী পড়ার জন্য বিলেতে পাঠাবেন।
লেখাপড়ার ছলে হাতেম খানের কলকাতা থাকা ও বাড়ী আসা যাওয়া। হোষ্টেলে থাকা অবস্থায় ১৯২৬ সনের আগষ্ট মাসে সম্ভবত বিকেল বেলা তারা গল্প করছিলেন এমন সময় তাদের পরিচিত একজনের সাথে সুটপড়া একজনকে সাথে নিয়ে হাজির হন। অচেনা লোকটিই হলেন লক্ষেèৗ মামলায় চার বছরের জেলখাটা কমরেড মুজাফফর আহমদ। হ্যারিসন রোড ষড়যন্ত্র মামলার অন্যান্য সঙ্গীরাও থাকতেন। তাদের সাথে এক সময়ের ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা এস. এ. ডাঙ্গেও ছিলেন। এই সূত্রে তাদের হাতেম আলী খানের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ঘটে ও আসা-যাওয়া চলে। আলাপ-আলোচনার মুল বিষয় রাজনীতি। এ সময় হঠাৎ একদিন বাবার মৃত্যুর সংবাদ আসে খানের কাছে এবং খবর পেয়ে তিনি বাড়ী চলে যান। মাস খানেক পর দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এলেন কলকাতায় এবং বন্ধু-বান্ধবদের তাগিদে পড়াশোনায় একটু মনোনিবেশ ঘটলো। হাতেম আলী আবার ভর্তি হয়ে গেলেন। মুজাফফর সাহেবের আমন্ত্রণে বিলেত থেকে আসেন তৎকালীন বৃটিশ পার্লামেন্টের ভারতীয় সদস্য কমিউনিষ্ট নেতা সাহপুরজী শাকলাতওয়ালা। তাঁরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হন এবং মুজাফফর সাহেব সব সময় লেখাপড়ার তাগিত দিতেন। তিনি (মুজাফফর সাহেব) ‘গণবাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন। হাতেম খান নিজ পয়সায় পত্রিকা কিনে কলেজ হোষ্টেলসহ বিভিন্ন জায়গায় বিলি করতেন চুপিচুপি।
মাঝে মধ্যে বাড়ী এসে হাতেম আলী খান বিভিন্ন গ্রামে বৈঠক ও সভা করতেন। এ সমস্ত বৈঠকে তিনি সাম্যবাদী নীতি ঘোষণা করতেন। মানুষ তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন। এ সময় তাঁর এলাকায় দুজন প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। একজন হেমনগরের হেমচন্দ্র চৌধুরী বার্ষিক ৪ লাখ টাকা আয়ের জমিদার। আর অন্যজন ধনবাড়ীর নবাব আলী চৌধুরী। তিনি শুধু বড় নবাবই নয়, বাংলা সরকারের ৬৪ হাজারের মন্ত্রী। এরা দুজনে মিলে ৩০ শতাংশের এক পাকিতে ১ টাকা খাজনা ধার্য্য ছিল-এর বদলে ২৭ শতাংশের পাকির মাপ চালু করে ১ টাকা খাজনা আদায়ের এক মতলব আঁটে। গ্রামে গ্রামে পেয়াদা বরকন্দাজদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয় এটা বাস্তবায়নের জন্য। নবাব বাহাদুরের ভয়ে হিন্দু-মুসলমান সকল মানুষ দিশেহারা। তার অত্যাচারের কাহিনী এখনো লোকের মনে ভীতির সঞ্চার করে। নবাবের বাড়ীতে ছিল এক বিরাট শিমুল গাছ। খাজনা বাকী থাকলে প্রজাদের এই গাছে বেঁধে সোয়াহাত জুতা দিয়ে পেটানো হতো। ও দিকে হেমনগরের জমিদারও কম কীর্তিমান পুরুষ নন, তিনি শিমলাপাড়া নামে একটি গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়ীঘর হাতী চড়িয়ে ভেঙ্গে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিজের নামে হেমনগর গ্রামের পত্তন করেন। মানুষ এতে প্রমাদ গণল। অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চললো তখন মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশেষত দরিদ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এর প্রতি রোধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান। এই পরিবেশে হাতেম খান নির্বিকার থাকতে পারলেন না। তিনি এসব লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা ও বৈঠক করে চললেন এবং এই অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গ্রামের মাতাব্বর ও কৃষক লাঠিয়ালরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি কমিটি গঠন করলেন। ছাতারকান্দি, হরিষা, হাদিরা, বনমালি ইত্যাদি গ্রামের কৃষকরা রুখে দাঁড়ালো। প্রায় ২২টি গ্রামের মানুষ কমিটির সক্রিয় সদস্য হয়ে এই দুই জমিদারের খাজনা, দাদন ও বর্গা জমির ফসল বন্ধ করে দিল। নবাব বাহাদুরের সাহায্যে এগিয়ে এলো থানা পুলিশ এবং জমিদারের পক্ষে প্রায় আড়াইশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কৃষক ও লাঠিয়ালদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হলো খাজনা বন্ধ, লুটতরাজ এর অভিযোগে। অবশেষে দুপক্ষের মধ্যে একটি আপোষ হয় জমিদারের নতুন খাজনার হার চালু হল না। তবে আন্দোলনকারীদের পক্ষের কিছু লোকের জেল হয়ে গেল। হাতেম খান এই পরিণতি দেখে ব্যথিত ও লজ্জিত হয়ে কলকাতায় চলে গেলেন।
১৯২৮ সনে তিনি লেখাপড়ায় মনোযোগী হলেন ও পড়ালেখা করে এমএ পাস করলেন। ইতোমধ্যে তাঁর বাবার মৃত্যুর দশ মাস পর তাঁর বিয়ে হয়ে গেল এবং এবছরই তাঁর মেয়ে সন্তান জন্মালো। বসন্তকালে জন্ম হওয়ায় মেয়ের নাম রাখলেন বাসন্তী। এরপর তিনি কলকাতায় গিয়ে অনুভব করলেন মানুষের দুঃখ-কষ্ট আন্দোলনের কথা লিখবার কোন পত্রিকা নেই। তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে কোন উপায়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেই হবে। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করতে হলেতো টাকা লাগবে। বন্ধুরা সবাই মিলে এই সমস্যার কোন কুলকিনারা করতে পারলেন না। হাতেম খান কোন পথ না পেয়ে বাড়ী চলে এলেন এবং স্ত্রীর অজান্তে ৭০ ভরি গহনা হস্তগত করে কলকাতা চলে এলেন। এই গহনা বিক্রির টাকা দিয়ে পত্রিকার কাজ শুরু করলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদের ইচ্ছানুযায়ী সাপ্তাহিক পত্রিকার নামকরণ করা হলো ‘সর্বহারা’। এএমএ জামানকে সভাপতি করে পত্রিকাটি প্রকাশ করা হয়। এটা ছয়মাস নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এর পর ‘চাষী মজুর’ ও পরে ‘দিনমজুর’ আরো ২টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল; কিন্তু অর্থের অভাবে তাও বেশী দিন চলেনি, যদিও তিনি সকাল-সন্ধ্যা কুলির কাজ ও খিদিরপুর ডকে শ্রমিকের কাজ করে পত্রিকার সাথে যুক্ত কর্মীদের খাবারের ব্যবস্থাটা কিছুদিন করতে পারছিলেন।
১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর স্ত্রী উন্মাদ হয়ে যান। ১৯৩৫ সনে তিনি (খান সাহেব) ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৮ অবধি এ কাজ নিয়েই বাড়ীতে থাকেন। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাড়ী ছেড়ে ভালুকা থানার বাটাজোর গ্রামে চলে আসেন এবং জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তিনি শিক্ষা বিস্তার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। গ্রামের একটি জুনিয়র মাদ্রাসা হাই স্কুলে পরিণত করেন। এটা ভাওয়াল গড়ে গজারীর বনের মধ্যে। দিন রাত এখানে বাঘের ডাক শোনা যেত এবং এখানকার ভূমিহীন চাষী মুসলমান, গারো, মানদি আদিবাসীলোকের সাথে অন্তরঙ্গভাবে মিশে যান। তিনি হয়ে উঠেন জনপ্রিয়। ১৯৪২-এর জানুয়ারি তিনি স্কুলটিকে অনেক উন্নত করে হঠাৎ করেই সকলের অজান্তে গাইবান্ধা চলে যান বেড়াতে এবং সেখানে এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজে আটকা পড়ে যান। কিছুদিন পরে তিনি সেখান থেকে ভুঞাপুর অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলে তদীয় অনুরোধে ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। এসময় ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তাঁর নিজের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর নিজের গ্রাম বেলুয়া থেকে সাড়ে তিন মাইল দূরে নলিন বাজারে একটি হাই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪৬ সনে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, তিনি একই সঙ্গে তিনটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সাইকেল যোগে পালন করেন। তার আটমাস পর অন্য দুটি স্কুলের শিক্ষক সংগ্রহ করে দিয়ে নিজের গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন।
সময়টা ছিল সারা দেশ জুড়ে কৃষক সভার নেতৃত্বে তেভাগার আন্দোলন। হাতেম আলী খান কৃষক সভার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের অঞ্চলে তেভাগার আন্দোলন শুরু করেন। এতে তাঁর বড় ভাইরা খুব ক্ষেপে যান এবং হাতেম খান নিজ ঘরে শত্রু হয়ে দাঁড়ান। আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং মহকুমা হাকিম এই ব্যাপারে একটা আপোষ মিমাংসার জন্য এগিয়ে এলেন। বর্গাদাররা এবার থেকে মণ প্রতি ৫ সের বেশী ধান পাবে। কিন্তু ৬-৭ বছর পর গ্রামের মাতব্বরদের কারসাজিতে চুক্তি বরবাদ হয়ে যায়। এই সময় পাকিস্তান আন্দোলন চলছিল। এ সময় হেমনগরের জমিদার তাদের নিত্যদিনের বাজার থেকে একজন নমশুদ্র ও একজন মুসলমানের দোকান উচ্ছেদ করে দেয়। হাতেম আলী উচ্ছেদকৃতদের পক্ষ নেন ও জমিদার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এনিয়ে প্রচার কাজ চলতে থাকে এবং এক সময় সভা ডাকা হয়। প্রচার কাজের আহ্বানে আগুনের মত কৃষকরা ঝলসে উঠে। জনসভায় প্রায় ৩০ হাজার লোক এসে জমায়েত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় জমিদার বাড়ী থেকে সিকি মাইল দূরে এক বাজার বসাতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাজার বসানো হল। বাজারের নাম দেয়া হলো পাকিস্তান বাজার। এ নিয়ে দুপক্ষে সংঘর্ষ হলো এবং স্থানীয় লোকেরা উত্তেজিত হয়ে লাঠি, হলাংগা ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে জমিদার বাড়ী গিয়ে জমিদারের বাজার আক্রমণ করলো। কাচারীতে পাইক, বরকন্দাজ ও আমলাদের মারপিট করলো। এতে থানা ও জমিদারের পক্ষ থেকে হাতেম আলী ও অপর সাত জনের বিরুদ্ধে ৩৯টি মামলা করা হয়। কিস্তু এই মামলায় মহকুমার কোন উকিল মোক্তার দাঁড়াতে রাজী হননি। তাদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষীই পাওয়া যায়নি। ফলে তিন বছর পর সব আসামি বেকসুর খালাস হয়ে যান।
ইত্যোমধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্র বৃটিশরা মুসলমানদের উপহার দিয়ে দেয়। ১৯৫০ সনে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে দলে দলে বাস্তুহারা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে থাকে এবং জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও সরিষাবাড়ি রেল ষ্টেশন থেকে হাতেম আলী খানের ইউনিয়নের বিশ্রাম নিয়ে নানা দিকে চলে যেত। এক সময় প্রায় ২০ হাজার লোক একমাস কাল থেকে যায়। তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হাতেম আলী খানকে দলবলসহ খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়। তিনি এতে যে আন্তরিকতার পরিচয় দেন সরকারি কর্মচারীরা তা স্বচক্ষে দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন ও তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছিল তাতে তারা কোন উচ্চবাচ্য না করে চলে যান।
১৯৫২ সনে মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিমলীগ গঠনের জন্য ময়মনসিংহ আসেন। এই উপলক্ষে তার কাছে সংবাদ পাঠালে তিনি ময়মনসিংহ এসে তাঁদের সাথে দেখা করেন। টাঙ্গাইল মহকুমার দলটি গঠনের দায়িত্ব তাকে অর্পণ করা হয়। তিনি পূর্ণ উদ্যোগে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে কাজ করে চলেন। অতঃপর ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে তাকে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন সভার প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে বলা হয়। তিনি এতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে যুক্তফ্রন্ট নেতাদের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয় নির্বাচনের অর্থ তারাই দেবেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়ান মুসলিম লীগের শক্তিশালী প্রার্থী অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু নির্বাচনে পরে কোন অর্থই দেয়া হয়নি কেন্দ্র থেকে। এই অবস্থায় খান সাহেব তাঁর ছাত্রদের সাহায্য নিয়ে মাত্র সাতটি জায়গায় সভা করেন গোপালপুর নির্বাচনী এলাকায়। হাতেম আলী খান সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। নির্বাচনের মাত্র দু’মাস পর ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারার আঘাত আসে এবং বহু রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হন। হাতেম আলী খান ছিলেন তাদের অন্যতম। পাকিস্তানে এটাই তাঁর প্রথম কারাবরণ। বৃটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি দু’বার জেল খেটেছেন। এ সময় হাতেম খানকে (এম-এল-এ হয়ে) কিস্তিটুপি পড়িহিত হয়ে সাইকেলে তিনি যাতায়াত করতেন এবং জনগণ সশ্রদ্ধ চিত্তে সালাম জানাতেন।
পাকিস্তানের শুরুতেই গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা-সামরিক বাহিনী দ্বারা। ১৯৫৮-র সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় প্রাদেশিক কৃষক সমাবেশের এক অধিবেশন হয় এবং এক বিরাট মিছিল পল্টন ময়দানে গিয়ে সভা করে। এর এক মাস পরই আইয়ুব খান সামরিরক আইন জারি করে সব সংগঠন গড়ার উদ্যোগ নস্যাত করে দেয়। হাতেম খান সে সময় চট্টগ্রাম ছিলেন। ঢাকায় এসে দেখলেন অন্যান্য সংগঠনের মত তৎকালের ৮/৯ লিয়াকত এভেন্যুর কৃষক সমিতির অফিসও তালাবন্ধ করা হয়েছে। তখন তিনি নিজ গ্রাম বেলুয়ায় ফিরে এলেন। এসে দেখেন যার উপর তাদের গ্রমের স্কুলটির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তার অবহেলায় স্কুলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁর নিজের হাতে গড়া নলিন হাই মাদ্রাসাটির অবস্থা শোচনীয়। তিনি তখন উদ্যোগ নিয়ে স্কুলটি পুনরুজ্জীবিত করলেন এবং ১৯৬২ অবধি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
সামরিক আইন শেষ হবার পর রাজনৈতিক দল ও সংগঠন পুনরুজ্জীবিত করার অধিকার পাওয়া যায়। হাতেম আলী খান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে প্রাদেশিক কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার জন্য কাগমারি চলে আসেন। অনেক জেলার কৃষক সংগঠকরাও এখানে এসে মিলিত হন। অনেক আলাপ-আলোচনার পর কৃষক সমিতির চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। এক মাস কাগমারিতে থেকে কৃষক সমিতির লক্ষ্য ও দাবী সম্বলিত ৫ হাজার প্রচারপত্র ও রশিদবই ছাপিয়ে প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাবার ব্যবস্থা করে কাগমারি থেকে ঢাকা চলে আসেন। কিন্তু শহরে তার কোথাও দাঁড়াবার জায়গা ছিল না। অনেক চেষ্টা করে কোথাও জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেল ষ্টেশনের প্লাটফরমে আশ্রয় নেন। কোন কোন সময় তাঁকে পায়ে চলার পথেও রাত কাটাতে হয়। এভাবে ঢাকা শহরে ১০ মাস কাটলো। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর তিনি ও সদ্য কারামুক্ত জিতেন ঘোষ ওসমানি গণি রোডে একটি ঘরভাড়া নিয়ে কৃষক সমিতির অফিস খোলেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। এর দু’মাস পর ১৯৬৪ তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে বাধ্য হয়ে অফিস বন্দ করে দিতে হয়। বছরের প্রথম দিকে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একটি লিথো সাইক্লোষ্টাইল প্রেস মেশিন নিয়ে তিনি টাঙ্গাইল রওনা হন এমন সময় আইবি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। সেখানে তাঁকে ৭ দিন আটকে রেখে অনেক নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ বছরেই বগুড়া পাঁচবিবিতে একটি কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ কাজে টাকা যোগান দিতে তাঁকে জমি বিক্রি করতে হয়।
১৯৬৪ তে পাবনা জেলার লাহিড়ী মোহনপুর গ্রামে প্রাদেশিক কৃষক সমিতির সম্মেলন হয় এবং পরের বছর ১৯৬৫ তে এপ্রিল মাসে রংপুরে বার্ষিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনের আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মৌলিক গণতন্ত্রের কাঠামোতে অনুষ্ঠিত হয়। সেই উপলক্ষে খানকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ জেলে রাখা হয়। পরে হাইকোর্টে রীট করে তিনি মুক্ত হন। কৃষক সমিতির উদ্যোগে ঢাকা জেলার রায়পুরা অঞ্চলের প্রায় ৯০ হাজার কৃষক তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে গভর্ণরের সাথে ১৯৬৭ তে দেখা করার জন্য মিছিল করে ঢাকা রওনা হলে মাধবদি বাজারের কাছে গভীর রাতে ৫/৭ শত পুলিশ আক্রমণ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই সরকারি জুলুমের প্রতিবাদে সভার আয়োজন করতে গেলে হাতেম আলী খান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাজী দানেশ ও শ্রমিক নেতা সিরাজুল আলম খান গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তিনি নেত্রকোণা মহকুমার বেকুরহাট বাজারে কৃষক সম্মেলনে বক্তৃতা করার অপরাধে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে এক মামলা করে জরুরি আইনের ধারায় তাঁকে আড়াই বছর কারাদন্ডে দন্ডিত করে। পরবর্তীতে ছাত্রজনতার ১৯৬৯-এর আন্দোলনের ফলে জরুরি আইন সরকার তুলে নেয়। এর ফলে হাতেম আলী আপন মানুষের কাছে ফিরে আসেন।
কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের (১৯৫৭) পর আওয়ামী লীগ ছেড়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে ন্যাপের প্রার্থী হয়ে গোপালপুর থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করে পরাজিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি নিজ গ্রাম বেলুয়াতে আত্মগোপন অবস্থায় কাটান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সহায়তা প্রদান করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি কৃষক সমিতি পুনর্গঠন ও সংগঠিত করার নব উদ্যমে কাজ করে চলেন। ১৯৭৩ সনে ময়মনসিংহ জেলায় কৃষক সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠানে কমরেড মনি সিংহসহ সবনেতা যোগদান করেন এবং এবং হাতেম খান শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৭৩) তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকা গোপালপুর থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন এবং ধারণা করা হয় তাকে ৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করা হয়। এই নির্বাচনে পায়ে হেটে নির্বাচনী এলাকার গ্রাম গুলোতে অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে ভোট চেয়েছেন এবং ছোট ছোট জনসভা করেছেন। মানুষ এসব জনসভায় তাঁর কাছে বিরাট কোন দাবিদাওয়া তুলেননি। তিনি নিজে থেকেই একজন সৎ নিষ্ঠাবান নেতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছেন মানুষের কাছে। এ রকম একজন ত্যাগী মানুষ তিনি গোপালপুর নির্বাচনী এলাকায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁকে পরাজিত হতে হবে নির্বাচনে তা তিনি নিজেও ভাবেননি।
তাঁর কর্মময় জীবন ও এদেশের অবহেলিত কৃষককুলের আপনজন হিসেবে কৃষক সমিতিকে প্রতিষ্ঠিত করবার যে উদ্যোগ ও প্রয়াস নিয়েছেন এবং এভাবে মানুষের মধ্যে জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ খুঁজে পেয়েছিলেন অনেক বিলম্বে। আজ মার্ক্সবাদী হিসেবে নিজেকে জাহির করেন অনেকে। কিন্তু তিনি কোন দিন নিজেকে জাহির করেননি। যদিও তিনি মার্ক্সবাদেই নিজের জীবনের লক্ষ্য ও নিশানা খুঁজে পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে সেই আদর্শেরই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৭২-এর সংবিধান মুুক্তিযুদ্ধের ফসল এবং সেই ফসল এখনো ঘরে তোলা সম্ভব হয়নি হাজার বছরের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও। এর কারণ অনুসন্ধান করার সময় এসেছে এবং কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্তকে এক কাতারে দাঁড় করার প্রয়াস ১৯৭৫’র পর করা হয়েছে। বিক্ষিপ্ত ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এবং শত্রুরা বসে থাকেনি। শাসক দলকে আজকের সঙ্কটগুলোর জন্য একচেটিয়া দায়ি করছেন প্রচার ও সংবাদপত্র মাধ্যমগুলো। হ্যাঁ, শাসকদল অবশ্যই দায়ি তাদের নেতিবাচক (দুর্নীতি ও অব্যবস্থা) কর্মকান্ডের মাধ্যমে, কিন্তু আত্মসমালোচনামূলক প্রচার নেই। জনগণ ২০০৮ এ যে আশায় ভোট দিয়ে এদের নির্বাচিত করেছে সেই আশার প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন ঘটাবার শক্তি এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। দেশে আজ হাতেম আলী খানের মত দেশ প্রেমিক ও নিবেদিত ব্যক্তিদের প্রচন্ড অভাব। এই অভাব পূরণ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে রচিত মূল ধারায় জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। আসুন, আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করি, নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলি এবং এর মাধ্যমে হাতেম আলী খানকে স্মরণ করি। তথ্যসূত্র : সংগ্রামী কৃষক নেতা আলী খান -কমরেড সত্যেন সেন।
গোপালপুরের গর্বিত সন্তান জননেতা হাতেম আলী তালুকদার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, গোপালপুর-ভূঞাপুরের সাবেক সাংসদ ও গোপালপুর পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা জননেতা আলহাজ্ব হাতেম আলী তালুকদার ১৯২৭ সালের ১১ জানুয়ারি পিতা আফসার আলী তালুকদার ও মাতা জামিরুন্নেছার গর্ভে গোপালপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।
অসীম সাহসী আর প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হাতেম আলী তালুকদার ১২-১৪ বছর বয়স থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও জামালপুর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিতসহ ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনিত এবং ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে এমএলএ র্নিবাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে বহুবার তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে তাঁর গৌরবান্বিত ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে হাতেম আলী তালুকদারকে টাঙ্গাইল জেলা বাকশালেরর দ্বায়িত্ব অর্পণ করেন। উপজেলা পরিষদ গঠিত হলে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি এলাকার শত শত মানুষকে চাকুরী প্রদানে সহযোগিতাসহ সামাজ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি হাদিরা হাতেম আলী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, শিমলা জামিরুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়, মির্জাপুর হাতেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়, পানকাতা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ চাতুটিয়া, অর্জুনা, শশুয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
জননেতা আলহাজ্ব হাতেম আলী তালুকদার ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকার রাশমনো হাসপাতালে সময়মত চিকিৎসার অভাবে পরলোক গমন করেন। গোপালপুর পৌরশহরের নন্দনপুর নিজ বাসভবন দক্ষিণামলয়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার নূর হোসেন আঙ্গুর তালুকদার ১৯৪৫ সালের ১ আগস্ট গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নলিন গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে উন্নত প্রশিক্ষনের জন্য মাইনকার চর হয়ে ঢালু ক্যাম্প ও তুরা পাহারে ট্রেনিং প্রাপ্ত হন। ট্রেনিং শেষে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর নিকরাইল রানী দিনমনি হাইস্কুলে সত্তুর জন কমান্ডারের মিটিংয়ে কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী গোপালপুর থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকজন কোম্পানী কমান্ডারকে নির্দেশ দিলে নূর হোসেন আঙ্গুর তালুকদার কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ভোলারপাড়া, হেমনগর, সূতী, জগন্নাথ, পিংনা ও ফুলদারপাড়া যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন।
নূর হোসেন আঙ্গুর তালুকদার ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর শনিবার গোপালপুর থানা পাক হানাদার মুক্ত হলে শত্রু সেনাদের কাছ থেকে পাওয়া সকল অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র গ্রহন করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে গোপালপুর থানায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন ত্যাগী নেতা ও সৎ, নির্ভিক ও ত্যাগী পুরুষ।
২০১১ সালে অবিবাহিত অবস্থায় গোপালপুর সদরে নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন এবং গোপালপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী খেতাবপ্রাপ্ত বীরমুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বীরবিচ্ছু ও সর্বকনিষ্ঠ বীরমুক্তিযোদ্ধা হলেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরএলাকার সূতীপলাশ পাড়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম লালু। তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ন অবদান রেখে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়ে ছিলেন।
পিতা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, মাতা আমিনা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শহীদুল ইসলাম লালু। ছোট বেলা থেকেই অত্যান্ত সাহসী ও দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন লালু। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোপালপুরে পাকহানাদার বাহিনী ফায়ারিং শুরু করলে স্থানীয়রা প্রাণ ভয়ে এলাকা ছাড়া শুরু করলে কিশোর শহীদুল ইসলামও স্বজনদের সঙ্গে পালিয়ে বর্তমান ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানী নামক স্থানে আশ্রয় নেয়। দুরন্ত লালুর সাথে কেরামজানী বাজার ও স্কুল মাঠে পরিচয় ঘটে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমান্ডার কাজী হুমায়ুন আশরাফ বাঙ্গাল ও আনোয়ার হোসেন এর সাথে। তারপর হতেই সে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ফুট ফরমাশ কাজে লেগে যায়। বীরমুক্তিযোদ্ধাদের চা-পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি মাঝে মধ্যে অস্ত্র পরিস্কারের কাজও করতেন। আস্তে আস্তে অস্ত্র ধরাও শিখে ফেলেন কিশোর শহীদুল। সপ্তাহ খানেক পর মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারত চলে যান। ভারতে গিয়ে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিংএ অংশ গ্রহন করে অস্ত্র হিসেবে স্ট্রেনগান ও গ্রেনেড পান। আর পোশাক হিসেবে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি ও মাথার ক্যাপ। ট্রেনিংয়ের সময় ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকালে ব্রিগেডিয়ার সামসিং শহীদুল ইসলামের নামের সাথে লালু নামটি যুক্ত করে দেন। সেই থেকে শহিদুল ইসলামের নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু। যুদ্ধের পরবর্তীতে তিনি লালু নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে ছিলেন। এই লালু ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় হুইসেল বাজিয়ে সব মুক্তিযোদ্ধাদেরকে লাইনে দাড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকা উঠাতেন ও নামাতেন। এ কাজের তাকে সহযোগীতা করতেন শ্যামল চন্দ্র দে ওরফে ভুলু। শ্যামল চন্দ্র দে সে সময় ভোলা ভোলা নাদুস নুদুস থাকায় তিনিও ব্রিগেডিয়ার সামসিং বাবাজীর কাছ থেকে সে ভুলু নামে অখ্যায়িত হয়েছিলেন।
ভারতের তুরাতে লালু স্ট্রেনগান ও গ্রেনেড বিষয়ে ভালো শিক্ষা গ্রহন করে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারের সাথে গোপালপুরের কেরামজানীতে ফিরে আসেন। শহীদুল ইসলাম লালুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো গোপালপুর থানার পাক হানাদার বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অলক্ষ্যে এ কাজ সহজে করা যাবে, ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবে এবং শত্রু বলে সন্দেহও করবেনা কেউ তাকে। নির্ধারিত দিনে লালু হাফপ্যান্ট পরে বিকেল বেলা তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। থানার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। থানার গেটের সামনে বটগাছের নিচে যেতেই লালুর গ্রামের দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। সে রাজাকারদের ক্যাম্পে কাজ করতো। লালুকে দেখে জিজ্ঞাস করে ‘কিরে শহীদ এতো দিন কোথায় ছিলি?’ শহীদ উত্তর দেয়-‘ কোথায় আর থাকবো, চার দিকে শুধু গোলাগুলি, আমার ভয় লাগে তাই নানা বাড়ী চলে গিয়ে ছিলাম’। দূর সম্পর্কের ভাইটি প্রস্তাব দেয়-তুই আমাদের ক্যাম্পে থেকে যা, ঐ বাংকারে পাঞ্জাবী সেনাদের চা-টা খাওয়াবি। সুযোগ হাত ছাড়া না করে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় লালু। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুর পাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করে। এক সময় সুযোগ বুঝে সবার অগোচরে থানার ভেতরের একটি পরিত্যক্ত ঘরে গ্রেনেড তিনটি রেখে তা ব্যবহারের সময় খুঁজতে থাকে আর চা-পানি খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চারদিকে কে কোথায় আছে তা দেখতে থাকে। লালু তিনটি ব্যাংকার টাগের্ট করে নেয় যা সহজেই গ্রেনেড ফাঁটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাতে ক’জন পাক সেনা ঘায়েল হবে তার হিসাবও কষে নেন। একেক ব্যাংকারে ৫জন, ৪জন ও ৩জন করে পাক সেনা রয়েছে। তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে ব্যাংকার গুলোতে পজিশন নিয়ে আছে। লালু ছোট হবার কারনে সকলের সন্দেহের বাইরে থেকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন।
এক সময় লালু লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনতে যায়। সেখানে লালু কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হয়। কারণ গ্রেনেডের উপর শুয়ে ছিলো মস্তবড় একটা সাপ। সাপ চলে যাবার পর গ্রেনেড গুলোর সেফটিপিন খুলে দ্রুত প্রত্যেক ব্যাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় লালুর ছুঁড়ে মারা গ্রেনেড গুলো। এতে তিনটি ব্যাংকারের সবাই মারা যায়। আর সে দিনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখল করে নেয়। লালু থানা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসে। সে দিন লালু ফিরে আসতে পারবে সে ধারণা কমান্ডারদেরও ছিলোনা। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়ে শহীদুল ইসলাম লালু মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যখন টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট কাদেরিয়া বাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিচ্ছিল, তখন শহীদুল ইসলাম লালুও তার ব্যবহৃত স্ট্রেনগানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঐদিন অবাক হয়ে শহীদুল ইসলাম লালুর পিঠ থাপড়ে বলেছিলেন-‘সাব্বাস বাংলার দামাল ছেলে।’ যখন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর ব্যাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলেন-‘বীর বিচ্ছু।’ সেই ছবি দিয়ে একটি পোষ্টারও পরবর্তীতে ছাপা হয়ে ছিলো। শেখ রাসেল ও গোপালপুরের শহীদুল ইসলাম লালু মঞ্চে পাশাপাশি বসেছিলেন। এই দৃশ্য পরবর্তীতে বাঘা বাঙ্গালী ছবিতে দেখানো হয়ে ছিলো। অনেক দেরি হলেও বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম লালু তার বীরপ্রতীক খেতাবের কথা ১৯৯৬ সালে জানতে পারেন।
মানবেতর জীবনযাপন করে চার সন্তানের জনক বঙ্গবন্ধুর বীর বিচ্ছু ও দেশের সর্ব কনিষ্ঠ বীরপ্রতীক শহীদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে ঢাকাস্থ মিরপুরের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এ বীরমুক্তিযোদ্ধার মরদেহ মিরপুরেই সমাহীত করা হয়।
মতিয়ার রহমান তালুকদার দুদু ১৯৪৪ সালে গোপালপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গোপালপুর-ভূঞাপুরের সাবেক সাংসদ ও গোপালপুর পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা জননেতা আলহাজ্ব হাতেম আলী তালুকদার।
স্বাধীনতা পরবর্তী হাতেম আলী তালুকদার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের একজন প্রভাবশালী এমএলএ হওয়ায় ১৯৭৪ সালে গোপালপুর শহরকে পৌরসভায় রুপান্তরিত করে পুত্র মতিয়ার রহমান তালুকদার দুদুকে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান মনোনীত করেন।
তিনি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৬ সালে পরলোক গমন করেন।
সম্পাদনা : কে এম মিঠু, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ খ্রি.