আজ || সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


মহান শিক্ষা আন্দোলন : শিক্ষার মন্নোয়নে আওয়ামী লীগ

রায়হান কবির

গতকাল ১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হলো ‘মহান শিক্ষা দিবস’। বাঙালি জাতির বীর সন্তানদের রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ইতিহাস সমৃদ্ধ ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের পরিফল। বাঙালির এমন কোনো দিবস খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জন্য সংগ্রাম করতে হয়নি, আত্মত্যাগ করতে হয়নি, প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়নি। এমন গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য পৃথবীর কোথাও নেই যা বাঙালি জাতি অর্জন করেছে। বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি তথা স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার অর্জনেও সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ঠিক তেমনি অনেক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রকৃত শিক্ষার অধিকার। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকেই। তাদের স্মরণে এই দিনকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৫৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর সামরিক শাসক আইয়ুব খান তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল। প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সস্তায় শিক্ষা করা যায় বলে যে ভুল ধারণা রয়েছে তা ত্যাগ করতে হবে। এতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। এই তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’তে যেসব বিষয় সুপারিশ করা হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে- শিক্ষাকে ব্যয়বহুল পণ্যের মতো শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানদের স্বার্থে উচ্চ শিক্ষাকে সীমিত করা এবং সাধারণের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত করে ফেলা। শিক্ষা ব্যয় পুঁজিবিনিয়োগ হিসেবে দেখে শিক্ষার্থীরা তা বহন করা, যে অভিভাবক বেশি বিনিয়োগ করবেন তিনি বেশি লাভবান হবেন; অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে উল্লেখ; ষষ্ট শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক; উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা; সাম্প্রদায়িকতাকে কৌশলে জিইয়ে রাখার চেষ্টা; ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করা ইত্যাদি।

এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল। ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি বাতিল করে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। ছাত্রদের সাথে সাধারণ মানুষও পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এ খবর শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তখন মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। এ সময় পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। ওই দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। এদিন টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশের গুলিতে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিকেরও হত্যার খবর রয়েছে। বহু ছাত্র-জনতা পুলিশ ও ইপিআরের নির্যাতন ও গুলিতে সারাদেশে আহত হন।

আওয়ামী লীগের শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিমূল ১৯৬২-এর শিক্ষা-আন্দোলনে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যান্ড ছিল। তবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষানীতি ও শিক্ষার অধিকার আদায়ের দাবি ও কর্মসূচিসমূহ জনগণকে শিক্ষা আন্দোলনের সাথে একাত্ব করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে গৃহীত খসড়া মেনিফেস্টোতে বলা হয় ‘রাষ্ট্রের প্রত্যেকের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাতে থাকিবে এবং প্রত্যেক নারী-পুরুষের পক্ষে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক থাকিবে। দেশের সর্ব্বত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়া শিক্ষা সহজলভ্য করিতে হইবে। উচ্চতর শিক্ষা বিশেষ করিয়া কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্র খুলিতে হইবে এবং পর্য্যাপ্ত পরিমাণে সরকারী বৃত্তির সাহায্যে উচ্চতর শিক্ষা উৎসাহিত করিতে হইবে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করিতে হইবে।’ এরপর ১৯৫৩ সালের ৩, ৪ ও ৫ জুলাই এবং ১৪ ও ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দুটি কাউন্সিল অধিবেশনে বাঙালি জাতির সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি এবং আওয়ামী লীগের তৃণপর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের সর্বত্র প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের দাবি জোরাল উচ্চারিত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের ১৯৫৪ সালের গঠনতন্ত্রে ‘নীতি ও উদ্দেশ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়Ñ ‘জাতি ধর্ম্ম নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানী নাগরিকের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাবিষয়ক ও অর্থনৈতিক উন্নতি বিধান করা। সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ন্যায়সঙ্গত উপার্জ্জনের ব্যবস্থা করা।’ আওয়ামী লীগের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা দর্শনের প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘোষিত যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১-দফায়। ২১-দফায় ১২, ১৩ ও ১৪ দফায় বলা হয় ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা হবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে পার্র্থক্যের অবসান করে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা হবে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার প্রবর্তন করা হবে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কালাকানুন বিলোপ করা হবে। শিক্ষাকে জনসাধারণের কাছে আরো সহজলভ্য করে তোলা হবে এবং ছাত্রদের জন্য স্বল্প খরচে আবাসের ব্যবস্থা করতে হবে।’

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শিক্ষানীতির পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচিতে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। আজ পর্য্যন্ত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রচলন হয়নি, কচি ছেলে-মেয়েদের স্কন্ধে আজও তিন-চারটি বিদেশী ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে চেপে রয়েছে। স্কুল কলেজের উন্নতির কোন প্রচেষ্টাই নেই। ছাত্রদের বেতন হ্রাস ও আবাস স্থলের ব্যবস্থা করার কোনই ইচ্ছা সরকারের দেখা যাইতেছে না।’ এরপর ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল প্রথম আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা এবং ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ কেন্দ্রেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগ ওই আমলে শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠন করা হয় ‘শিক্ষা সংস্কার কমিটি’। আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় জাতীয় ছুটির দিন ‘শহীদ দিবস’। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে থমকে দাঁড়ায় সকল শুভ উদ্যোগ। ১৯৫৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর সামরিক শাসক আইয়ুব খান তৎকালীন ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে বাঙালির শিক্ষা অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক রেখে টেনে দেয়। এই কমিশন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। আওয়ামী লীগের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা অধিকার সম্পর্কে দীর্ঘদিনের দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচির সাথে পরিচিত জনগণ ছাত্রসমাজের শিক্ষা আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জোগায়। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যান্ড ছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে বন্দী ছিলেন। তরপরও ১৯৬২-এর ফেব্রুয়ারিতে সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবির সাথে ছাত্রসমাজের শিক্ষার দাবি যুক্ত হলে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। ১৯৬২-৭১ পর্বে আওয়ামী লীগ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে শিক্ষা আন্দোলনের মৌল চেতনাকে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৬৪ সালের মার্চ, ১৯৬৬ সালের মার্চ ও ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনসমূহে গৃহীত সংশোধনীসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৬৯ সালে ঘোষিত আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ (ম্যানিফেস্টো)-তে একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি উচ্চারিত হয়।

শিক্ষার মানোন্নয়নে আওয়ামী লীগ মূলত আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রত্যেকটি নাগরিকের শিক্ষা অর্জনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে আসছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং প্রত্যেক নাগরিকের জন্য শিক্ষা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের (ক)-তে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ স্পষ্ট ঘোষণা করেছে ‘বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী স্থানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা লাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা। শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা।’

১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেন। কুদরত-ই-খুদা কমিশন দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাপক জরিপ ও পর্যালোচনাভিত্তিক বাংলাদেশের শিক্ষা সংস্কারের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে একটি রিপোর্ট ১৯৭৪ সালের ৩০ মে সরকারের নিকট দাখিল করেন। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। কমিশন রিপোর্টের অপেক্ষা না করে তিনি কতিপয় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মার্চ ’৭১ থেকে ডিসেম্বর ’৭১ পর্যন্ত সময়কালের ছাত্রদের সকল বকেয়া টিউশন ফি মওকুফ করেন; শিক্ষকদের ৯ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন; আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করেন এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে তিনি দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেন। এর ফলে ১ লাখ ৬৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাই স্কুল পুনর্নির্মাণ করেন। বঙ্গবন্ধুর আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন প্রদান। বঙ্গবন্ধু অফিস-আদালতে বাংলা প্রচলনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীসহ সকল অফিসে বাংলা চালু করা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা একাডেমিতে সাঁটলিপি, মুদ্রাক্ষর ও নথি লেখার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয়। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন।

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর প্রথম মেয়াদ (১৯৯৬-২০০১) ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলে অন্যান্য খাতের ন্যায় শিক্ষা খাতেও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। আওয়ামী লীগের শিক্ষা-দর্শন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার মান্নোনয়ন ঘটে। এ সময় একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণীত হয়। শিক্ষা খাতে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ। সাক্ষরতার হার বিএনপি আমলের ৪৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশে দাঁড়ায়। দেশে এই প্রথম একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি নতুন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিপুল সংখ্যক নতুন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগই প্রথম দেশে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাঙালি জাতির গর্ব ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। মাতৃভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনে ২০০১ সালের মার্চে ঢাকায় স্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। শিল্পী-সাহিত্যিকদের কল্যাণে গঠন করা হয় শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট।

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদ (২০০৯-১৭) ২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর অন্যান্য সকল খাতের মতোই পিছিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০০১-এ বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় শিক্ষার হার ৬৫ থেকে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। আর সেখানে বর্তমান শিক্ষার হার বৃদ্ধি করে ৭১ শতাংশে উন্নীত করেছে। গত আট বছরে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে সর্বমোট প্রায় ২২৫ কোটি ৪৩ লাখ ১ হাজার ১২৬টি বই বিতরণ করা হয়েছে। ২৬ হাজার ১৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ ও শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে। ১ কোটি ৭৩ লাখ ছেলেমেয়ে বৃত্তি পাচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই ১ কোটি ৩০ লাখ মায়ের হাতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ৩৫ হাজার ৫০০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। মিডডে মিল চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শতভাগ শিশুর ভর্তি, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার প্রবর্তন, ঝরে পড়ার হার হ্রাস, ছাত্রীদের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন একই দিনে প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষা হয়। ৬০ দিনের মাথায় প্রত্যেকটা এসএসসি, এইচএসসি ফল প্রকাশ পায়। একই তারিখে হয়। ক্লাস শুরু হয় ১ জানুয়ারি। দেশের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে মাল্টিমিডিয়া ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা, প্রতি উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয়কে মডেল বিদ্যালয়ে পরিণত করার কার্যক্রম চলছে। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল প্রকাশ প্রভৃতি কার্যক্রম জনগণের প্রশংসা অর্জন করেছে। ১ হাজার কোটি টাকার স্থায়ী তহবিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়ক ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকদের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা, ট্রেনিং ও দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সেশন জটমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

মোটকথা ১৯৬২-৬৪ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মৌল চেতনা এবং একটি কল্যাণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম যতটুকুই বাস্তবায়িত হয়েছে তা আওয়ামী লীগ আমলেই হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলেই প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ, প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণের মধ্য দিয়ে ধনী-গরিব সকলের জন্য শিক্ষাগ্রহণের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি, বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদান, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সেশন জটমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি সবই অর্জিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।

সূত্র : উত্তরণ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!