আজ || বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪
শিরোনাম :
  গোপালপুরের মোহনপুরে পোস্টঅফিসের ঘর না থাকায় ভোগান্তি       গোপালপুরে বিশ্ব শিক্ষক দিবসে গুণী শিক্ষক সংবর্ধনা       গোপালপুরে আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল মোমেন গ্রেফতার; ফাঁসির দাবিতে মিছিল       গোপালপুরে ডেইরি ফার্ম মালিক ও আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতবিনিময়       গোপালপুর উপজেলা ডেইরি ফার্ম মালিক সমিতির কমিটি গঠন       বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে -ইলিয়াস হোসেন       গোপালপুরে সীরাতুন্নবী (সাঃ) মাহফিল অনুষ্ঠিত       গোপালপুরে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা       গোপালপুরে ১০ম গ্রেড প্রদানের দাবিতে শিক্ষকদের মানববন্ধন       গোপালপুরে জাতীয়করণের দাবিতে বেসরকারি শিক্ষকদের মানববন্ধন     
 


ফলাফল-কেন্দ্রিক শিক্ষার মান ও শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কট || আবিদুল ইসলাম

পড়াশোনা বিষয়টা বর্তমানে আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রীতিমতো ভয়াবহ একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এসএসসি অথবা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর পত্র-পত্রিকায় ভালো ফলাফল করে কৃতকার্য হওয়া কিংবা A+ধারীদের জয়োল্লাসের ছবি সেই আতঙ্কজনক পরিস্থিতিকে ঢেকে রাখতে পারে না। এই ছাত্র-ছাত্রীরা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর থেকে ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এক গভীর আতঙ্কে দিন কাটায়। এরপর ফলাফল প্রকাশিত হলেও তারা সম্মুখীন হয় আরেক মানসিক চাপের। A+ না পেলে তো কথাই নেই, পেলেও যে তারা কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হবার সুযোগ লাভ করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেননা প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা, কিন্তু ভালো মানের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন-সংখ্যা সেই অনুযায়ী বাড়ছে না। এ কারণে যারা কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারে না, তারা পছন্দনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়ার আশা ত্যাগ করে স্থানীয় সাদামাটা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার পরবর্তী সোপানে পা রাখে, এবং ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা সমগ্র বাংলাদেশ থেকে জড়ো হতে থাকে রাজধানী এবং অন্যান্য বড় বড় শহরের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি আসন লাভের মল্লযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। এভাবে দূর-দূরান্ত থেকে আগত এবং বড় শহরগুলোতে বেড়ে ওঠা ছাত্র-ছাত্রীদের এই লড়াইয়ে তাদের অভিভাবকগণও মনস্তাত্ত্বিকভাবে শরিক হন।

এখন কথা হচ্ছে, প্রতিবছর যে পাশের হার এবং A+ধারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির কোনো পরিচায়ক না। অন্যান্য দিকগুলো বাদ দিলেও এখানে পর্দার অন্তরালে ক্রিয়াশীল রাজনীতির বিষয়টি মোটেও উপেক্ষার বিষয় নয়। প্রতিটা সরকারই চায় তাদের শাসনামলে নিজের কৃতিত্বকে বড় করে দেখাতে। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারগুলোর সত্যিকারের কৃতিত্বপূর্ণ কর্মের তালিকা দীর্ঘ নয়। তাই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল তাদের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের অন্যতম সহায়ক। জনমানসে ইতিবাচক ছাপ রাখা এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার তাগিদে শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে তারা বিবেচনা করে থাকে। এ কারণে সব সরকারের আমলেই দেখা যায়, পাশের হার এবং A+ পাওয়ার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সরকারের একেবারে শেষ বছরে এই হার থাকে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ ক্ষমতায় আসবার আগে কিংবা এসে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে শিক্ষাবিস্তারের যে অঙ্গীকারগুলো পূরণের কথা বলা হয়, পাশের হার এবং ভালো ফলাফলকারী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেখিয়ে তা বাস্তবায়নের দৃষ্টিকল্প উপস্থাপন করা হয় জনসাধারণের সামনে। এর মাধ্যমে শুধু যে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয় তা-ই নয়, শিক্ষাব্যবস্থায়ও সৃষ্টি করা হয় এক ধরনের নৈরাজ্য এবং শিক্ষার মান অবনমনের পূর্বশর্ত।

এভাবে প্রতিবছর যে অসংখ্য ‘মেধাবী’ মুখ পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চতর শিক্ষায় স্থান করে নেয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তারা যতো ভালো ফলাফলই করুক, তাদের প্রকৃত শিক্ষার অবস্থা কী হয় সে বিষয়ে বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাবিদ ছাড়াও শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন মহল্লায় আলোচনার উপস্থিতি খুবই সীমিত, প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রিত কালো অক্ষরগুলোর সাথে পরিচিত হলেই সত্যিকারের শিক্ষালাভ হয় কিনা সে বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। আমাদের দেশের মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকগুলো পূর্ণ হয়ে আছে বিকারগ্রস্ততা, বিভ্রান্তি, দলীয় রাজনৈতিক মিথ্যাচার, অন্ধবিশ্বাস, প্রথাগত চিন্তা আর প্রতারণামূলক বক্তব্যে। আবার সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মানবিক শাখার পাঠ্যপুস্তকগুলোর বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু তাতে মানের উন্নয়ন হওয়ার কোনো শর্ত সৃষ্টি হয় না। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতোই পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি এবং বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের জগাখিচুড়ি অবস্থার যাবতীয় লক্ষণ সেখানে বিদ্যমান থাকে। তাই বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রকৃত উন্নয়ন সাধন এবং পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তন করে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় না। অবস্থা এমন যে সমুদয় পাঠ্যপুস্তক গুলে খাওয়ালেও একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞানলাভ হয়েছে এ কথা বলার কোনো উপায় নেই।

এছাড়া আরেকটা বিষয় হলো, এই স্তরগুলোয় পাঠ্যক্রম এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ভারে এক রকম ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবে এর জন্য যে শুধু পাঠ্যক্রমই দায়ী তা নয়। আমাদের দেশে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। কেবল বইয়ের কালো অক্ষরের সারিবদ্ধ শৃঙ্খলগুলোর সাথে পরিচয় ঘটিয়েই শিক্ষকগণ তাদের দায় এবং দায়িত্ব সারেন। এক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের সাথে সহায়ক অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের অস্তিত্ব এবং ব্যবহার একেবারেই নেই। ফলে আনন্দের সাথে শিক্ষা আত্মস্থ করার পরিবর্তে এখানে বই মুখস্থের প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়। এসব কারণে পাঠ্যক্রম-বহির্ভুত বইপত্রসমূহ, যাকে অভিভাবকরা অনেক সময় বাছবিচারহীনভাবে ‘গল্পের বই’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন তীর্যক অর্থে, তার সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় ঘটে খুব সীমিত পর্যায়ে। অথচ পাঠ্যক্রমের সীমিত গণ্ডির বাইরে পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত বইয়ের যে অসীম দিগন্ত তার সাথে পরিচয় না ঘটলে কোনো শিক্ষার্থীর মানসজগতের যথাযথ বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। তাই সেটা হয়ও না। আর যেটুকু পরিচয় তারা এর মধ্যে দিয়ে লাভ করে তাতেও তাদের মানসিক অবস্থার তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে না। এর মূল কারণ পাঠ্যক্রমভুক্ত গ্রন্থসমূহের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া শিক্ষার্থীরা মূলত এর থেকে সাময়িক পরিত্রাণেরর জন্য আশ্রয় খোঁজে লঘু সাহিত্য, সস্তা বিনোদন, ফ্যান্টাসি-কেন্দ্রিক অবাস্তব গল্প-উপন্যাসে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন অথবা বিদ্যাচর্চার অন্য কোনো শাখায় রচিত মননশীল ভালো মানের বইপত্র পড়ার জন্য তাদের কোনোপ্রকার আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। কেননা পাঠ্যক্রমের বাইরে অধিক জ্ঞান লাভের প্রয়োজন যে আছে, জ্ঞান ও বিদ্যার চর্চা যে একই সাথে আনন্দ এবং মানসিক সমৃদ্ধি লাভের উপায় হতে পারে সেটা তারা বোধ করে না।

ফলাফল-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আরো দুটো নেতিবাচক উপজাত লক্ষ্য করা যায় আমাদের সমাজেঃ (১) নকল-প্রবণতা এবং (২) অর্জিত শিক্ষার সাথে মানসিকতার সংযোগহীনতা। সমাজের মনস্তত্ত্বে যেহেতু পরীক্ষায় ভালো ফলাফল লাভের ধারণাই সর্বময় মাহাত্ম্যে অধিষ্ঠিত হয়েছে, পাঠ্যক্রমভুক্ত গ্রন্থাবলীতে যা লিখিত থাকে তা সত্য কিংবা মিথ্যা যা-ই হোক না কেন তার কোনো বাস্তব প্রয়োগ যেহেতু জীবনে নেই, তাই বইয়ের লেখাগুলো যে কোনোভাবেই হোক পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভের উদগ্র বাসনা থেকেই জন্ম নেয় নকলের আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা। লক্ষ্য করা যায় যে প্রতিটা সরকারই পরীক্ষায় নকলের এই প্রবণতার বিরুদ্ধে এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করে থাকে এবং নকল বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন দৃষ্টিগ্রাহ্য পদক্ষেপও নেয়, কিন্তু মনের যে গভীর তলদেশ থেকে এই প্রবণতার উৎপত্তি সেখানে তাকে উপড়ে ফেলে প্রকৃত শিক্ষালাভের ইতিবাচকতার বাস্তব ভিত্তি তৈরি করতে না পারলে উপরিকাঠামোয় আরোপিত ব্যবস্থার দ্বারা যে অবস্থার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য। কাজেই রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুর সতর্ক প্রহরা এবং নীতিবাক্যের বিস্তার সত্ত্বেও পরীক্ষায় নকল সগর্বে চলছে এবং ভবিষ্যতে চলবে।

দ্বিতীয় বিষয়টা সমাজে কম আলোচিত এবং সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। কাজেই পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বইগুলো থেকে যে সীমিত শিক্ষাও লাভ হয় তার কোনো প্রতিফলন বাস্তব জীবনে ঘটে না, কিন্তু বিষয়টি সরকার, সমাজ এবং অভিভাবকের দৃষ্টি অগোচরেই রয়ে যায়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর কাছে যখন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন সে মুখস্থ বিদ্যার ওপরই হয়ে ওঠে অধিক নির্ভরশীল, তার মনস্তত্ত্বে অর্জিত শিক্ষার কোনো ইতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি হয় না। পুস্তকের লেখাগুলোর বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর কথা সে চিন্তা করে না। এভাবেই বইয়ের লেখার সাথে সংযোগহীনতা সৃষ্টি হয় ব্যক্তিজীবনে। এ কারণেই চারিদিকে দেখা যায় বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মানসজগতে অন্ধত্ব, গোঁড়ামি এবং শিশুসুলব কুসংস্কারাচ্ছন্নতার নিরবচ্ছিন্ন জটিল উপস্থিতি, ছাত্রজীবনে সর্বত্র নীতিবাক্য গলাধকরণ করা পদস্থ কর্মকর্তার দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের বেপরোয়া অভিলাষ।

আরেকটা যে সমস্যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আছে সেটাও বেশ জটিল। এটা মূলত এই নিবন্ধে কথিত দ্বিতীয় উপজাত থেকে সৃষ্ট। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলে না। আগেই বলেছি, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে সর্বোচ্চ পড়াশোনা করেও একজন ব্যক্তি বিশ্বাস রাখে অন্ধত্বে, কিংবা রূপকথায়। তার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হয় না। অর্থাৎ সে যে বিষয়গুলো পড়ে পরীক্ষায় পাশ করে সেগুলোতে তার ব্যক্তিগত প্রতীতি জন্মায় না। আর আমাদের দেশের বিজ্ঞানের বইগুলোতে বিজ্ঞানের নামে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের এক ধরনের নিরীহ বিবরণ থাকে। অর্থাৎ মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস অথবা সংস্কারকে আঘাত কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে এ জাতীয় বিজ্ঞান-ভিত্তিক তথ্য সেখানে সংযোজিত হয় না। ফলে অনেক পুরোনো এবং জীর্ণপ্রায় প্রচলিত প্রথাগত ধারণাগুলো নিয়েই ছাত্র-ছাত্রীরা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে পাশ করে যায়। তবে বিজ্ঞানমনস্কতা শুধু বিজ্ঞান শাখায় অধ্যয়ন করা ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয় নয়। এটি সামগ্রিক শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেননা বৃহত্তর অর্থে আধুনিক শিক্ষার প্রতিটি স্তরে এবং শাখায় রয়েছে বিজ্ঞানের নির্যাস। প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের যে দায়িত্ব বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দ্বারা নির্ধারিত বৃহত্তর অর্থে তা পরিণতি লাভ করে পরিপার্শ্বে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে সফলভাবে কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সার্থকতায়। সুতরাং সূত্র, কাঠামো এবং তত্ত্বের পরিবর্তে আধুনিক যুগে বিজ্ঞান পরিণত হয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে। এ কারণে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সাথে বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জনের সম্পর্ক প্রায় অলঙ্ঘনীয়।

আমাদের দেশে অভিভাবকবৃন্দ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সন্তানেরা কী পড়বে না পড়বে সেটা নির্ধারণ করে দেন, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় এ বিষয়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব পাঠ্য বিষয় বাছাই করার যে সংস্কৃতি সেটা এখনো এদেশে চালু হয় নি পুরোদমে। তাই প্রথাগত চিন্তার অধিকারী অভিভাবকদের আবদার রক্ষায় তাদের নির্দেশানুযায়ীই সন্তানেরা তাদের ভবিষ্যত পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করে থাকে। এক্ষেত্রে মূলত অভিভাবকবৃন্দের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিককার স্থানগুলো অধিকার করে থাকে বিজ্ঞান শাখায় পঠিত বিষয়াবলী, বিশেষত চিকিৎসা শাস্ত্র ও প্রকৌশল। তবে কোনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অথবা বিজ্ঞানমনস্কতার বশবর্তী হয়ে তারা এভাবে সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা যে করেন না সেটা বলাই বাহুল্য। কেননা আগেই বলেছি বিজ্ঞানমনস্কতা শুধু বিজ্ঞান শাখার পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা সামগ্রিকভাবেই আধুনিক শিক্ষা এবং জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়।

শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক বিষয়গুলোতে অধ্যয়নের প্রবণতা। একটা সময় পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগের পাঠ্য বিষয়গুলোর প্রতি মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশের বিশেষ আগ্রহ ছিল। এইদিকটি বিবেচনায় মানবিক বিভাগ সব সময়ই তুলনামূলকভাবে কিছুটা অবহেলিত ছিল, বিজ্ঞান শিক্ষার পরে ছিল তার অবস্থান। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামাজিক বিজ্ঞান এবং কলা অনুষদের সীমিত সংখ্যক বিষয়ই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। অর্থনীতি, আইন, ইংরেজি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সাংবাদিকতা, লোক প্রশাসন প্রভৃতি বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাহিদা বজায় রাখলেও বাংলা, ইতিহাস, দর্শন সহ কলা অনুষদের বেশির ভাগ বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হয় নিতান্ত বাধ্য হয়ে। কোনো রকমে পছন্দসই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একটি বিষয়ে ভর্তি হতে পারার চিন্তাভাবনা থেকেই তারা এই বিভাগগুলোতে সুযোগ পেয়ে নিজেদের নাম লেখায়। এ কারণে কোনো রকম জানার আগ্রহ কিংবা অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার বশবর্তী হয়ে তারা পড়াশোনা অব্যাহত রাখে না, বরং এক ধরনের হতাশা ও অনন্যোপায় মনোভাব নিয়ে তারা মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভর করে পরীক্ষাগুলোতে পাশ করে যায়। যেসব সাবজেক্টে পড়লে চাকরির বাজারে দ্রুত প্রবেশ করা যাবে সেগুলোর দিকেই তাদের আগ্রহ থাকে বেশি। শুধু তা-ই নয়, চাকরির বাজারে চাহিদা থাকা বিষয়গুলোতে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাভাবনার উপস্থিতি লক্ষ করার মতো। কলা অনুষদের অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা সব সময় তাচ্ছিল্যসুলভ মানসিকতা বজায় রাখে। তাদের কথাবার্তা এবং আচরণে চিন্তাকাঠামোর এই বিশেষ দিকটি প্রায়শই প্রতিফলিত হয়। প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মর্ম উপলব্ধিতে প্রোথিত না হওয়াই এর মূল কারণ। প্রকৃত জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ এদেশে প্রতিষ্ঠিত থাকলে বাংলা, দর্শন, ইতিহাস সহ মানবিক বিভাগের বিষয়গুলোর প্রতি নাক উঁচু ভাব দেখিয়ে যে অবহেলা প্রদর্শনের পরিস্থিতি বজায় রয়েছে তা কখনোই সম্ভব হতো না। কিন্তু এটা মূল কারণ হলেও দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাকেও কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না। শিক্ষা-দীক্ষার উন্নত সংস্কৃতি যেসব দেশে বিকাশ লাভ করেছে, সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো শাখাকেই এভাবে ক্ষুদ্রজ্ঞান করা হয় না। কেননা গবেষণা, অধ্যাপনা থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে বিবিধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন অনুভব করার মতো বাস্তব পরিস্থিতি সেসব দেশে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে, যেখানে কোনোমতে পড়াশোনার নির্দিষ্ট স্তর অতিক্রম করে চাকরি-বাকরিতে ব্যাপৃত হওয়াই মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর চিন্তার জগৎকে অধিকার করে রাখে, সেখানে ব্যক্তিবিশেষের নির্দিষ্ট আগ্রহ অথবা প্রবণতার বিষয়টি মার খেয়ে যায়।

কিন্তু শুধু কলা বা মানবিক বিভাগের অন্তর্গত বিষয়াবলীই নয়, বিজ্ঞান বিভাগের অধীনে পঠিত বিষয়সমূহও এখন চাহিদার ক্ষেত্রে এক প্রকার সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং প্রকৌশল ছাড়া গবেষণা-নির্ভর বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখায় পড়াশোনার ব্যাপারে বর্তমানে একটি বিশাল অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের চরম অনীহা দেখা যায়। এই মুহূর্তে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান প্রবণতা ব্যবসায় প্রশাসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করা। ব্যবসায় প্রশাসনে একটা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের আশ্চর্য রকম হন্যে হতে দেখা যায়। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞান অথবা কলা অনুষদের শিক্ষার্থীদেরও তাদের স্ব-স্ব বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষে আবার জন কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে পেশাগত ডিগ্রি অর্জনের জন্য ভর্তি হতে দেখা যায়। সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়গুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পড়ানো হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য সম্ভাব্য শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে এই ধরনের বিজ্ঞাপনের আধিক্য চোখে না পড়ে পারে না। সেই সাথে জন-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের আয়বৃদ্ধির তাগিদে খণ্ডকালীন শিক্ষার্থীদের জন্য এই শিক্ষা কার্যক্রমের দ্বার অবারিত করেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো অনেক চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীকেও দেখা যায় এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের জন্য ব্যস্ত হতে! অথচ চিকিৎসাশাস্ত্র কিংবা প্রকৌশলের বিভিন্ন শাখায় প্রতিনিয়ত যে নিত্যনতুন তথ্যাদি এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞানের অন্তর্ভুক্তি ঘটছে, চিন্তাভাবনার দিগন্ত বিস্তৃত হচ্ছে এবং বিবিধ সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন ঘটছে সে বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করা, নিজস্ব এবং বৃহত্তর প্রয়োজন অনুযায়ী পড়াশোনায় ও গবেষণায় রত থাকা- এসবই ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রকৃত কর্তব্য এ কাজে তাদের খুব অংশকেই ব্যাপৃত থাকতে দেখা যায়, যারা থাকেন তাদেরকে ব্যতিক্রম বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। একজন চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলীর এমবিএ ডিগ্রির কী প্রয়োজন সেটা সাধারণ জ্ঞানে বোধের অতীত হলেও দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরির বাজার, শিক্ষা সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংলগ্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করা গেলে বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে। এ বিষয়ে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল খাতের কোনো বিকাশ ঘটে নি। উদ্ভাবনী শক্তি-নির্ভর খাত দূরের কথা, প্রথাগত উৎপাদনশীল শিল্পগুলো এখানে চরমভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে শক্তিশালী কৃষি ও উৎপাদনশীল শিল্প-ভিত্তির পরিবর্তে যা দেখা যায় তা হলো, দেশি-বিদেশি পুঁজির অধীনে পরিচালিত সেবা খাত, আবাসন ও বৃহৎ বিপণী কেন্দ্রের প্রাধান্য এবং বিস্তৃতি। এখানে বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলে গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের একেকটির বিলুপ্তি কিংবা ধসে পড়ার বিনিময়ে রাজধানী সহ প্রধান প্রধান নগরের বুকে গড়ে ওঠে আলোকোজ্জ্বল বিশালকায় শপিং মল, ধনিক শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের আরামপ্রদ ও বিলাসবহুল জীবনযাপনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সুবৃহৎ অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া কপোর্রেট সংস্কৃতি-নির্ভর সেবা খাত-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় চাকরি হাতছানি। কর্মসংস্থানের এই খাতগুলো প্রকৃত অর্থে জ্ঞান-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার চাহিদা সৃষ্টি করে না, দাবি করে না বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিজ্ঞান-ভিত্তিক বিদ্যাচর্চার সাথে সম্পর্কিত জনগোষ্ঠীর। বিকশিত এবং বিকাশমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক খাতগুলো এভাবেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের সাম্প্রতিক গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির এই প্রবণতা বজায় থাকলে ও ক্রমাগত বিস্তৃতি লাভ করলে সেখানে মানবিক এবং বিজ্ঞান-ভিত্তিক বিদ্যাচর্চার অধিকাংশ শাখা-প্রশাখা যে শিক্ষার্থীদের দ্বারা বাস্তবত পরিত্যক্ত হবে- এভাবে দেখতে সক্ষম হলে সেটা শুধু সহজবোধ্যই হয় না, এ দুটো বিষয়ের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্কের সূত্রায়নও সম্ভব হয়।

অথচ প্রকৃত জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ নির্মিত হলে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। তাই সমৃদ্ধিশালী পুঁজিবাদী বিশ্বে এবং যেখানে শিক্ষা-দীক্ষার মান উন্নত সেসব জায়গায় এই প্রবণতা এতো প্রকটভাবে লক্ষ করা যায় না। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করার পর সেখানে লোকজন হয় অর্জিত শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পেশা বেছে নেয়, তা নাহলে সে বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা এবং গবেষণা অব্যাহত রাখে, শিক্ষকতার পেশা বেছে নেয়। অর্থাৎ একজন যে বিষয়ে তার স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম আরম্ভ করে সাধারণত সে বিষয়েই তার পড়াশোনা চালিয়ে যায়। কর্পোরেট খাতে কর্মরতদের কেউ কেউ অবশ্য নিজস্ব পেশার প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী চাকরিকালীন এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে। তবে অনেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরি লাভ করে। এই বিশেষজ্ঞদের সবার পেশার চরিত্র যে নিরীহ এমন নয়। অনেকেই তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জিত জ্ঞান এবং দক্ষতাকে কাজে লাগায় অনুন্নত ও নির্ভরশীল দেশ থেকে পুঁজি পাচারের বিবিধ সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায়। কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

এ কারণেই দেখা যায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেকোনো শাখা-প্রশাখায় এখন যে নিত্যনতুন চিন্তাভাবনা যোগ হয়ে ক্রমাগত এর বিকাশ ঘটছে, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুনতর সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে- তার সবই মূলত ঘটছে উন্নত বিশ্বে। সেখান থেকে আহরিত বিষয়সমূহ পশ্চাৎপদ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হচ্ছে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো সংযোজন ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, উন্নত বিশ্বে যারা এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করছে তারা সবাই সেই সব দেশের শ্বেতচর্মধারী লোকজন। আমাদের উপমহাদেশ সহ বিশ্বের পশ্চাৎপদ বিবিধ অংশ থেকে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা এই সমস্ত দেশে গিয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে নিজেদের সৃজনশীল প্রতিভাকে বিকশিত করছে এবং অর্জিত জ্ঞানকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম ইউরোপ সহ বিশ্বের উন্নত অংশ সমূহে এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা নিজেদের অর্জিত বিদ্যাকে কাজে লাগাচ্ছে। সুতরাং সমস্যা সমূহ অর্থাৎ এই মুখস্থ-বিদ্যার আধিপত্য, নকল প্রবণতা, অর্জিত শিক্ষার সাথে বাস্তব জীবনের সংযোগহীনতা, বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব কিংবা পড়াশোনা আতঙ্কের ব্যাপারে পরিণত হওয়া- এগুলো আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের স্থায়ী এবং নিয়তি-নির্ধারিত কোনো সমস্যা নয়, এটা মূলত শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম, পাঠদান পদ্ধতি, বেকারত্ব সমস্যা এবং অর্জিত শিক্ষা অনুযায়ী যথাযথ পেশা বাছাইয়ের সুযোগের অনুপস্থিতির মধ্যে নিহিত। এই সবই আবার গভীরভাবে সম্পর্কিত দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে, যে বিষয়ে ইতোপূর্বে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই আমাদের দেশে প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার এবং A+ধারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর সংবাদপত্রে যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর জয়োল্লাসের ছবি দেখা যায়, তারা প্রাপ্ত ফলাফলকেই নিজেদের মেধার নির্ভরযোগ্য পরিমাপক হিসেবে ধরে নিয়ে নিজেদেরকে সফল এবং মেধাবী জ্ঞান করে উৎসবে মেতে ওঠে। এদের মধ্যে যে প্রকৃত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী নেই এটা সত্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশের অবৈজ্ঞানিক, প্রথাগত জ্ঞান-নির্ভর ও জীবনের সাথে সংযোগহীন শিক্ষাব্যবস্থার যাঁতাকলে পড়ে তাদের একাংশের মেধা ও প্রতিভার পরিণতি হয় পৌরাণিক গাঁথায় বর্ণিত মুনিঋষির অভিশাপে পরিণত হওয়া প্রস্তরখণ্ডের মতো। এর বাইরে যে অংশটি এই প্রক্রিয়াকে ফাঁকি দিয়ে বেরোতে পারে তারা পাড়ি জমায় দেশের বাইরে। খুব সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীই শিক্ষাব্যবস্থার স্তরগুলো অতিক্রম করার পর স্বাধীন এবং সৃজনশীল চিন্তার চর্চা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। এভাবেই উপযুক্ত শিক্ষা এবং পর্যাপ্ত সুযোগ ও উপকরণের অভাবে অনুন্নত বিশ্বের একটা বিশাল অংশের মেধাবী শিক্ষার্থীর মস্তিষ্ক ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত বিশ্বের শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উন্নয়নে, সেসব দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজব্যবস্থাকে সমৃদ্ধতর করার কাজে।

দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকারের, তথা শাসকগোষ্ঠীর। প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, যথোপযুক্ত শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন, পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও পাঠ্যক্রম নির্ধারণ সহ এ বিষয়ে যাবতীয় দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান সমূহের ওপর বর্তায়। কিন্তু এই দেশের শাসক গোষ্ঠী কখনোই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করে নি, মাথা ঘামায় নি। বরং এর উল্টোটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য। শিক্ষার বন্ধ্যাত্বকরণের জন্য এককভাবে তারাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। এর কারণ দ্বিবিধ। এই শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিদ্যার্জন হচ্ছে অর্থোপার্জনের একটি মাধ্যম। নিজস্ব লালিত সংস্কৃতি এবং চৈতন্যের দৈন্যদশার কারণে এর বাইরে তারা শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অন্য কোনো ইতিবাচক ও প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে চিন্তা করতে সক্ষম হয় না। কিন্তু যেহেতু অর্থোপার্জনের অধিক কার্যকর পন্থা তাদের ভালোভাবে জানা আছে এবং সেগুলো তাদের হাতের মুঠোয়, তাই শিক্ষার উন্নতির কোনো বাস্তব প্রয়োজন তাদের কাছে নেই। তারপরও এইসব বিত্তবান রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা যে সকল সন্তান মেধাবী এবং পড়াশোনায় আগ্রহী হিসেবে চিহ্নিত হয় তাদেরকে উন্নততর শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ কাজে প্রভূত অর্থব্যয়ে তাদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। এদেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংকট তাদের জীবনে কোনো নিকট অথবা দূরবর্তী স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে না- যেটা করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষদের জীবনে।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!