এত দিন হুমকি, মারধর চলছিল। এ বার মাঝরাতে এবিজি-র তিন কর্তাকে (এক জনের স্ত্রী ও ১৫ মাসের শিশুকন্যা সমেত) বন্দুক দেখিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে কার্যত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হলদিয়া থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠল। এবিজি’র দাবি, ‘অপহৃত’দের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে শারীরিক নিগ্রহ করে মেচেদার কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হয়, হলদিয়ায় ফিরে এলে পরিণতি হবে শোচনীয়।
এবং ঘটনাটা ঘটল এমন একটা সময়ে, যখন হলদিয়া বন্দরের কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়ে আসার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। মাসখানেকের উপরে কাজ বন্ধ থাকার পরে ঠিক হয়েছিল, রবিবার সকালে বন্দরের ২ ও ৮ নম্বর বার্থে মাল খালাস শুরু হবে। তাই বন্দরের মূল ফটকের বাইরে বেশ ক’টা জায়গায় পুলিশ ক্যাম্পও বসে গিয়েছিল। কিন্তু শনিবার গভীর রাতে আবাসনে হানা দিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে এবিজির তিন কর্তাকে ‘অপহরণের’ এই ঘটনায় হলদিয়া বন্দরের জট আরও জটিল হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এর পরে এবিজি আদৌ সেখানে কাজে ফিরবে কি না। পশ্চিমবঙ্গে ‘শিল্পের-মুখ’ হলদিয়ার শিল্প-পরিবেশ কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে নতুন করে দানা বেঁধেছে সংশয়। এবিজি-র সিইও গুরপ্রীত মালহি-র অভিযোগ: শনিবার রাত একটা নাগাদ হলদিয়া টাউনশিপের শঙ্খিনী আবাসনের সদর দরজা ভেঙে ঢুকে মাঙ্কিক্যাপ-মাফলারে মুখ ঢাকা জনা পঞ্চাশ দুষ্কৃতী তাঁদের তিন অফিসারকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন মনপ্রীত জলি, জগদীশ বেহেরা ও ভূষণ পাটিল।
ভূষণের স্ত্রী ও শিশুকন্যাকেও অপহরণ করা হয়। এবিজি-কর্তৃপক্ষের অভিযোগ: পাঁচ অপহৃতকে রাতভর হলদিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানোর পরে রবিবার ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ মেচেদা স্টেশন থেকে হাওড়ামুখী প্রথম মেচেদা লোকালে বসিয়ে দুষ্কৃতীরা চলে যায়। যাওয়ার সময়ে শাসিয়ে যায়, ফের হলদিয়ায় পা রাখলে ফল খুব খারাপ হবে। ওঁদের শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ এবিজি-র। সংস্থা-সূত্রের খবর: কলকাতায় ফিরে আসার পরে এ দিন সন্ধ্যায় তিন অফিসারই বিশাখাপত্তনমে চলে গিয়েছেন। এই ঘটনার পরে এবিজি-র পক্ষে যে আর হলদিয়ায় কাজ করা কঠিন, সিইও তেমন ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন। পাশাপাশি এ হেন ঘটনার পরে এ রাজ্যে শিল্প স্থাপনে কেউ আগ্রহী হবেন কি না, বিভিন্ন বণিকসভার তরফে সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
হলদিয়ার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘একেবারে ভেঙে পড়েছে’ বলে অভিযোগ করে গুরপ্রীত এ দিন বলেন, “আবাসনের সদর দরজা যখন ভাঙা হচ্ছে, তখন অন্য আবাসিকদের কেউ কেউ পুলিশে ফোন করেছিলেন। পুলিশের তরফে কোনও সাড়া মেলেনি।” অপহৃত এবিজি-কর্তাদের অন্যতম জগদীশ বেহরা বলেন, “শনিবার রাত এগারোটা নাগাদ প্রথম হামলা হয়। আমরা তখনই এসপি, এএসপি ও হলদিয়ার এসডিপিও-কে বার বার ফোন করেছিলাম। সাড়া পাওয়া যায়নি। দুষ্কৃতীরা আবার আসে রাত একটা নাগাদ।” এ দিন বিকেলে হলদিয়া টাউন থানায় এবিজি-র পক্ষ থেকে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করা হয়। রাত পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি। পুলিশ ও প্রশাসনের কী বক্তব্য?
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন বলেন, “এবিজি-র অভিযোগের ভিত্তিতে অপহরণের মামলা রুজু করে তদন্তে নেমেছি। পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” হলদিয়ার এসডিপিও অমিতাভ মাইতির অবশ্য দাবি, “বন্দরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল।” রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের মন্তব্য, “আমাকে পুরো ব্যাপারটা জানতে হবে। তার আগে কিছু বলতে পারছি না।” শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “বিস্তারিত খোঁজখবর না-নিয়ে কিছু মন্তব্য করতে পারব না।” তা হলে এবিজি কি এখনই হলদিয়া থেকে পাট গোটাবে?
এবিজি কী? • জাহাজ নির্মাণ থেকে পণ্য খালাস, বহু কাজই করে সংস্থাটি। ১৯৮৫ সালে জন্ম। সারা দেশে বছরে ২৫০ লক্ষ টন মাল খালাস করে। বিদেশেও ব্যবসা রয়েছে। কবে থেকে হলদিয়ায়? • ২০১০ সাল থেকে এবিজি হলদিয়ার দুই এবং আট নম্বর বার্থে পণ্য খালাসের কাজ করছে। কী ভাবে কাজ পেল? • যন্ত্রনির্ভর মাল খালাস ব্যবস্থা চালু করতে ২০০৯ সালে গ্লোবাল টেন্ডার ডাকে কলকাতা বন্দর। বরাত পায় এবিজি। তাদের জন্য দু’টি বার্থ নির্দিষ্ট হয়। সাত মাস পরে তারা ঢুকতে পারে যন্ত্রপাতি নিয়ে। সমস্যা কেন? • স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করার বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের চাপে অতিরিক্ত ৬৫০ জন শ্রমিককে কাজে নিতে বাধ্য হয় এবিজি। ওই শ্রমিকেরা আগে থেকে ওই দু’টি বার্থে কাজ করতেন। মৌখিক বোঝাপড়ায় ঠিক হয়, বন্দর-কর্তৃপক্ষ ওই দু’টি বার্থে বছরে ৯ লক্ষ টন মাল খালাস নিশ্চিত করবে। কার্যত কী হল? • গত দু’বছরে মাল খালাস বাড়েনি। প্রতিযোগী সংস্থাগুলির চাপে ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে যথেষ্ট জাহাজ ঢোকানো যায়নি। কিন্তু অতিরিক্ত শ্রমিক নেওয়ায় প্রতি মাসে তাদের ২ কোটি টাকা ক্ষতি। বাড়ে শ্রমিক জুলুমবাজিও। লাগাতার লোকসান এবং অশান্তির জেরে হলদিয়া থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবিজি। ২৩ অগস্ট বন্দরকে নোটিস দিয়ে জানায়, ৮ সেপ্টেম্বর থেকে তারা আর কাজ করবে না। থেকে গেল কেন? • হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবিজি। আদালতের নির্দেশ মতো নিরাপত্তার খরচ হিসেবে ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জমাও দেয় তারা। রবিবার থেকেই তাদের কাজ শুরু করার কথা ছিল। গেলে কী হবে? • বন্দরের পণ্য খালাসে সেই কোদাল-বেলচার যুগ ফিরে আসবে। ক্ষতি কার? • এবিজি দু’টি বার্থ মিলিয়ে দিনে ২০ হাজার টন মাল খালাস করতে পারে। প্রতি টনে বন্দরের রোজগার হয় ১৫২ টাকা। এবিজি-র ৭০ টাকা। অন্য বার্থে দিনে ৫ হাজার টন পণ্য খালাস হয়। প্রতি টনে বন্দরের আয় হয় মাত্র ৬০ টাকা। অথচ মাল খালাসকারী সংস্থাগুলি পণ্য নামাতে মর্জি মাফিক দর হাঁকে। জাহাজ সংস্থাগুলিকেও অতিরিক্ত গুণাগার দিতে হবে। মাল ওঠানো নামানোয় দেরি হলে তাদের বেশি সময় থাকতে হবে বন্দরে। বেশি অপেক্ষা করতে হবে স্যান্ডহেডে (মোহনায়)। যত বেশি অপেক্ষা তত বেশি ভাড়া গুনতে হবে। ফলে হলদিয়ায় জাহাজ আসা কমবে। লাভ কাদের? • প্রতিযোগী সংস্থা এবং শ্রমিক সরবরাহকারী সংগঠনগুলির। প্রতিযোগী সংস্থার মধ্যে সব থেকে বেশি বার্থে কাজ করে তৃণমূলের এক রাজ্যসভা সাংসদের সংস্থা। শ্রমিক সরবরাহকারী সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ।
গুরপ্রীতের আক্ষেপ, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে নিরাপত্তা বন্দোবস্তের খরচ বাবদ ১৭ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা জমা দিয়েও কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা গেল না। পুরো ঘটনাটা তাঁরা হাইকোর্টকে জানাবেন। এবং হাইকোর্টের নির্দেশমতো পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। উল্লেখ্য, ‘লাগাতার হামলা ও জুলুমবাজি’র জেরে হলদিয়া বন্দর থেকে কাজ গুটিয়ে চলে যেতে চেয়ে গত ২৩ অগস্ট কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষকে নোটিস দিয়েছিল এবিজি। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে সে যাত্রা তারা থেকে যায়।
এবিজি-র এ-ও অভিযোগ, তাদের হলদিয়া-ছাড়া করার পরিকল্পিত প্রয়াসের পিছনে একটি বিশেষ কায়েমি স্বার্থ কাজ করছে। বন্দর-সূত্রের খবর: লিখিত অভিযোগে কারও নাম না-করলেও এবিজি’র আঙুল মূলত তমলুকের তৃণমূল সাংসদ এবং তাদের প্রতিযোগী এক সংস্থার বিরুদ্ধে, যার সিইও আবার তৃণমূলের রাজ্যসভার এক সদস্যের ভাই। বস্তুত তৃণমূল আইএনটিইউসি-র ‘জঙ্গি আন্দোলনের’ জেরে হলদিয়া বন্দরের স্বাভাবিক কাজকর্ম যে ব্যাহত হচ্ছে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিবকে চিঠি লিখে তা জানিয়েছিলেন বন্দর চেয়ারম্যান স্বয়ং। তাতে হলদিয়া বন্দরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য তিনি প্রশাসনকে আবেদন জানিয়েছিলেন। শনিবার রাতের ঘটনাতেও অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকেই। সম্প্রতি হলদিয়ায় পুরভোটের আগে এক কংগ্রেস প্রার্থীর এজেন্টকে অপহরণের অভিযোগও উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তৃণমূল নেতৃত্ব কী বলছেন? তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী শনিবার রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর ঘনিষ্ট সূত্রের দাবি, সহানুভূতি কুড়ানোর তাগিদে এবিজি-ই পুরো ঘটনাটা সাজিয়েছে। অন্য দিকে তমলুকের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ লক্ষণ শেঠ বলেন, “বন্দরে কাজ করা একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর (যারা আবার এবিজি-র মূল প্রতিযোগী) ঘনিষ্ঠ চার-পাঁচ জন বন্দরের নীতি নির্ধারণের সর্বোচ্চ কমিটির (অছি পরিষদ) সদস্য। এ থেকেই অনুমেয়, হলদিয়া বন্দরে কী হচ্ছে।” তবে এবিজি এবং লক্ষণবাবুর ইঙ্গিত যে সংস্থার দিকে, সেই ‘রিপ্লে অ্যন্ড কোম্পানি লিমিটেড’-এর সিইও সৌমিক বসু এক প্রেস বিবৃতিতে বলেছেন, “আমাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা গত চল্লিশ বছর ধরে বন্দরের কাজে যুক্ত। বন্দরের স্বার্থেই কাজ করে যাব।”
বিষয়টি নিয়ে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষও উদ্বিগ্ন। বন্দরের মুখপাত্র দামোদর নায়েক এ দিন বলেন, “যা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ঘটনাটি বন্দর এলাকার ভিতরে ঘটলে আমরাও পুলিশকে লিখতে পারতাম। কিন্তু ঘটেছে বন্দর এলাকার বাইরে। আমাদের উদ্বেগের কথা রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরে আমরা আগেই জানিয়েছিলাম। গোটা ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে হলদিয়া বন্দরেরই।”
কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুন, পরিস্থিতির আশু উন্নতির কোনও ইঙ্গিত নেই। বরং শনিবার রাতের ঘটনাকে ‘নাটক’ বলে অভিহিত করে এবিজি-র ২৭৫ জন ছাঁটাই শ্রমিককে পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন জারি রেখেছে তৃণমূলের বন্দর ঠিকা-মজদুর শ্রমিক ইউনিয়ন। আন্দোলনে অবশ্য ছাঁটাই শ্রমিকদের তুলনায় এবিজি-র প্রতিযোগী সংস্থার শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। যাঁদের তরফে উত্তম প্রধান, বিল্বপদ দাসেদের সাফ কথা, “২৭৫ জনকে পুনর্বহাল করতে হবে। না-হলে আমরা এবিজি-কে কাজ করতেই দেব না।” হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশি টহলদারি বাড়ার প্রেক্ষাপটে রবিবার সকালে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঠিক তার আগে বন্দুক দেখিয়ে এবিজি-কর্তাদের অপহরণের অভিযোগ ওঠায় বন্দরের চার পাশে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। সংস্থার এক ‘শিপ লিডার’ বলেন, “আশায় ছিলাম, রবিবার ফের কাজ চালু হবে। কিন্তু তার আগে এই কাণ্ড। আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। আমরা আতঙ্কিতও।” [আনন্দবাজার]