একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী বলেছেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব অভিযোগ মিথ্যা। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল -এ বিচারিক কার্যক্রম শেষে তিনি লিখিত বক্তব্যে
এটা দাবি করেন। সাঈদী বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শতাব্দীর জঘন্য ও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। আল্লাহর কসম, আমার বিরুদ্ধে রচনা করা চার হাজার পৃষ্ঠার প্রতিটি পাতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেকটি বর্ণ মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কোনো এক দেলোয়ার শিকদারের করা অপরাধ আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যার পাহাড় রচনা করেছেন।
সাঈদী বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগই মিথ্যা। এ মিথ্যাচারের জন্য ইহকালে ও কঠিন হাশরের ময়দানে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে চড়া মূল্য দিতে হবে ইনশাল্লাহ। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
সাঈদী বলেন, আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা, তার সহযোগী প্রসিকিউশন এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদাতাদের হেদায়েত করো আর হেদায়েত তাদের নসিবে না থাকলে তাদের সবাইকে শারীরিক, মানসিক ও পারিবারিকভাবে সে রকম অশান্তির আগুনে ভষ্মীভূত করো যেমনটি আমাকে, আমার পরিবারকে এবং বিশ্বব্যাপী আমার অগণিত ভক্তদেরকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছেন। আর জাহান্নাম করো তাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের বিনা অনুমতিতে সাঈদীর লিখিত বক্তব্য পাঠ করা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের মধ্যে বাকবিত-া তৈরি হয়। সাঈদীর তিন ছেলে ও তার আইনজীবী রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরের দিকে তেড়ে যান। তবে উভয়পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলে সাঈদী তার বক্তব্য শেষ করেন।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের দাবি, আমি নাকি মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর পালিয়ে ছিলাম। মিথ্যাচারের তো একটা সীমা থাকে। তদন্ত কর্মকর্তা যাই রিপোর্ট করেছেন, প্রসিকিউশন সেটাকেই বেদ বাক্য মনে করে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঈমান বিসর্জন দিয়ে সমস্ত মেধা-প্রজ্ঞা খাটিয়ে মিথ্যাকে সত্য বানানোর জন্য প্রাণান্ত হয়েছেন, আফসোস। নিশ্চয়ই এ মিথ্যাচারের জন্য ইহকালে ও কঠিন হাশরের ময়দানে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে চড়া মূল্য দিতে হবে ইনশাল্লাহ। এতে বিন্দু মাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর আদালতের তদানীন্তন চেয়ারম্যান নিজামুল হক আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি দোষী না নির্দোষ। আপনি তখন এ আদালতে তিন সদস্য বিশিষ্ট বিচারকদের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ন্যায়বিচারের ভ্রষ্ট পথ অনুসরণ করেছিলেন বিধায় একরাশ গ্লানি নিয়ে স্বেচ্ছায় সরে পড়তে হয়েছে। আজ সেই চেয়ারে আপনি সম্মানিত চেয়ারম্যান। এটাই আল্লাহর বিচার।
ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে সাঈদী বলেন, মাননীয় আদালত, দেশবাসীর কাছে, বিশেষ করে আপনাদের কাছে আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্র এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার পরও এ মামলা চলে কিভাবে?
তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ও সহযোগীদের সৃষ্ট অভিযোগগুলো প্রমাণের জন্য কয়েকজন বিতর্কিত চরিত্রভ্রষ্ট ও সরকারি সুবিধাভোগী দলীয় লোক ছাড়া সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কাউকে হাজির করতে পারেননি। তারপরও প্রচ- ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচার প্রক্রিয়ার সমাপ্তি টেনেছেন। তিনি আইন-কানুন, ন্যায়বিচারের শপথসহ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেননি। বরং তিনি রায় ঘোষণার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় মহান রাব্বুল আলামিনের হস্তক্ষেপের ঘটনা। আজ সেই সমাপ্তকৃত বিতর্কিত মামলার পুনঃসমাপ্তির দ্বিতীয় আয়োজন। কিন্তু আমি আগের মতোই একই উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মামলা যেনতেন প্রকারে শেষ করার সেই একই ত্রস্ততা। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে সাবেক চেয়ারম্যানের মতামত বা রায় তার কথোপকথনেই প্রকাশিত হয়েছে। স্কাইপি সংলাপে তিনি স্বীকার করেছেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর সঙ্গে আইনের খুব একটা সম্পর্ক নেই।
ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বলে দাবি করে সাঈদী আরও প্রশ্ন করেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে বিচার পরিচালিত করবেন কিভাবে?
বর্তমান সরকারের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তার বিরুদ্ধে এ মামলা সাজানো হয়েছে বলে অভিযোগ করে সাঈদী বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত হানার হাস্যকর ও মিথ্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে আজ পর্যন্ত কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে মানবেতর অবস্থায় দিনাতিপাত করছি। সেটি করেছে এমন এক সরকার, যারা আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস কথাটি দেশের সংবিধানে বহাল রাখাকে সহ্য করতে না পেরে অবলীলায় তা মুছে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। অথচ স্বাধীনতার এই ৪২ বছরের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না, জিডিও ছিল না। গণতন্ত্রের লেবাসধারী বর্তমান এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের ষড়যন্ত্রে আজ আমি ১৭টি মামলার আসামি।
তিনি আরও বলেন, সরকারের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই ২০টি মানবতাবিরোধী অভিযোগে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর বা পাড়েরহাটে পাকিস্তানি বাহিনী যা ঘটিয়েছে সেসব কাহিনী সৃষ্টি করে চরম মিথ্যাবাদী ও প্রতারক এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তার সহযোগীরা নীতি-নৈতিকতার মূলে পদাঘাত করে আমার নামটি জুড়ে দিয়েছেন। এতো জঘন্য মিথ্যাচার করা কোনো মুসলমানের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, আজ আমি আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে আপনাদের সামনে বলতে চাই, সরকার ও তার রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক চিত্রিত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, গণহত্যকারী, ধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগকারী দেলোয়ার শিকদার বা ‘দেলো’ বা ‘দেল্লা রাজাকার’ আমি নই। আমি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পবিত্র কোরআনের একজন তাফসিরকারক, কোরআনের পথে মানুষকে আহবানকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
তিনি বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এর আগে দুইবার ক্ষমতায় ছিল। তখন আমি যুদ্ধপরাধী ছিলাম না। তখন আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে কিংবা ১৯৭২-১৯৭৫ মেয়াদকালে ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের ইসলাম বিদ্বেষী বর্তমান অবস্থান ছিল না বিধায় আমাকে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণ খুঁজে পায়নি। কিন্তু এবার ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ জোট বেঁধে সরকার আমাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মহানায়ক হিসেবে আবিষ্কার করেছে।
আমি আমার সারা জীবন নাস্তিক্যবাদী ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধেই কোরআন ও হাদীসের আলোকে বক্তব্য দিয়ে এসেছি। সরকার তাদের ইসলাম বিদ্বেষী মিশন বাস্তবায়নে আমাকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে বিতর্কিত ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং আমাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেছে।
তিনি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান সরকার ও সরকারি দল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাকে তাদের বিশাল প্রতিপক্ষ বানিয়ে তাদের সকল ক্ষমতার অপব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধের কল্পকাহিনী তৈরি করে কোনো এক দেলোয়ার শিকদারের অপরাধের দায় আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমাকে আজ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার জন্য যে ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক পিরিস্থিতির আবহ সৃষ্টি করেছে, তা উপলদ্ধি কিংবা মোকাবেলা করার কোনো ক্ষমতা আমারে নেই।
জামায়াতের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে সাঈদী বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা এই আদালতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আমি নাকি ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পলাতক ছিলাম। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এমন মিথ্যাচারও তিনি করেছেন। ১৯৭৯ সালে আমি সাধারণ সমর্থক হিসেবে জামায়াতে যোগদান করি। এর আগে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক ছিলাম না। ১৯৮৯ সালে আমি জামায়াতের মজলিসে শূরায় সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হই। এরপর কর্মপরিষদ সদস্য, নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও পরবর্তীতে তথাকথিত মানবতাবিরোধী এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে আপনার কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত আমি জামায়াতের নায়েবে আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম।