ক্ষমতাসীনদের মামলার জালে এখন কারাবন্দী বিএনপির ভারপ্রাপ্তমহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সহসা কি এই পরিছন্ন রাজনীতিবিদ মুক্তি পাবেন? না একের পর এক মামলায় কারাগারে কাটাতে হবে এই রাজনীতিবিদের আরো কিছু দিন। এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। সহসাই তার যে মুক্তি মিলছে না এমন হিসাব তার দলের নেতা কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খিসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিএনপিসমর্থিত আইনজীবীদের । তাদের প্রশ্ন অবরোধের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীর ৩৮ মামলার অধিকাংশ মামলায়ই ফখরুলকে গ্রেফতার দেখাবে পুলিশ? যদিও ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর বলেছেন হয়রানি নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পুলিশ। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গত বছরের ৯ ডিসেম্বরের অবরোধের পরের দিন সন্ধ্যায় বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেফতার করে। ৯ ডিসেম্বর সকাল ছয়টা থেকে অবরোধ কর্মসূচি হয়েছিল তথাপি পুলিশের পক্ষ থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় কাকরাইল এলাকায় অবরোধের সময় সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি ভাংচুর ও শেরে বাংলানগর থানা এলাকায় গাড়িতে অগ্নিংযোগের অভিযোগ আনা হয় মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে। পরের দিন এ দুটি মামলায় ফখরুলকে আদালতে হাজির করে পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে এবং তার আইনজীবীরা জামিন চান। আদালত এ দুটি আবেদন নামঞ্জুর করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে জেলে পাঠায়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট এ দুটি মামলায় ফখরুলকে জামিন দেয়। কিন্তু এর পরের দিন সুত্রাপুর ও মতিঝিল এলাকার অবরোধের সময় পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা ও ককটেল বিস্ফোরনের মামলায় মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। এরমধ্যে সুত্রাপুর থানার মামলায় ১৫ জানুয়ারী ফখরুলকে নিম্ন আদালত জামিন দিলেও মতিঝিলের বিস্ফোরক মামলায় জামিন নামঞ্জুর করেন। যদিও এরইমধ্যে গত ২১ জানুয়ারী রাজধানীর মতিঝিল থানায় দায়ের করা বিস্ফোরক মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ৬ মাসের জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ও বিচারপতি মোহাম্মদ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। তবে আরো দুটি মামলায় গ্রেফতার থাকায় এখনই মুক্তি পাচ্ছেননা মির্জা ফখরুল। এছাড়া, যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া নতুন মামলায় মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতার না করার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের শুনানীর জন্য ২২ জানুয়ারী মঙ্গলবার শুনানী শেষে ২৭ জানুয়ারি রোববার পরবর্তী শুনানীর দিন ঠিক করেছেন উচ্চ আদালত। এক্ষেত্রে আদালতের আদেশের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই । এদিকে,১৮ দলীয় জোটের অবরোধের সময় কলাবাগান এলাকায় পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা ও গাড়ি ভাংচুরের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রিমান্ড ও জামিন নামঞ্জুর করেছে আদালত। ফখরুলের উপস্থিতিতে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে শুনানি শেষে এ আদেশ দেয়া হয় । অবরোধের সময় কলাবাগান এলাকায় গাড়ী ভাংচুর ও পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার মামলায় ২৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। তার উপস্থিতিতে ঢাকার অতিরিক্ত মূখ্য মহানগর হাকিম সাইফুর রহমানের আদালতে রিমান্ড শুনানীতে অংশ নেন রাস্ট্র ও আসামীপক্ষের আইনজীবীরা। রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু আদালতকে জানান, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অবরোধের দিন গাড়ী বের না করতে জনসাধারনকে আহবান জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অবরোধের সহিংস ঘটনায় কারা জড়িত ছিলেন তা বের করার জন্য ফখরুলকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। রিমান্ডের বিরোধিতা করে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, এমামলার এজাহারে মির্জা ফখরুলের নাম নেই। তাই এ মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয়ার কোন কারন নেই। আদালত দুপুরে শুনানী শেষে রিমান্ড এবং জামিন নামঞ্জুর করেন । ১৮ দলীয় জোটের অবরোধের সময় সহিংস ঘটনায় পল্টন ও শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় গত ১০ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। এ দুটি মামলায় নিম্ন আদালত ফখরুলের জামিন নামঞ্জুর করলে হাইকোর্টে যান তিনি। হাইকোর্ট ৬ মাসের অন্তবর্তীকালীন জামিন দেয়ার পরের দিন মতিঝিল ও সুত্রাপুরের আরও দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় ফখরুলকে। এদুটি মামলায় তাকে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট জামিন দেয়ার পর কলাবাগান ও পল্টন থানার আরও দুটি মামলায় ফখরুলকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। এ পর্যন্ত অবরোধের ঘটনায় ফখরুলের বিরুদ্ধে করা ৬টি মামলার মধ্যে ৪টিতে তিনি জামিন পেয়েছেন।এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালত চত্তরে বিক্ষোভ মিছিল করে। ওই মিছিল থেকে মিথ্যা মামলায় ফখরুলের মুক্তি দাবী করেন তারা।
সর্বশেষ গত ১৬জানুয়ারী মির্জা ফখরুলকে পল্টন ও কলাবাগান থানায় আরো দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। এ দুটি মামলায় পুলিশ মির্জা ফখরুলের ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। আগামী ২৪ ও ২৭ জানুয়ারী রিমান্ড শুনানীর দিন ঠিক করেছেন আদালত । রাজপথ অবরোধ কর্ম সূচির সহিংসতার অভিযোগে এ পর্যন্ত মির্জা ফখরুলকে ৬টি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে তিনটি মামলায় ফখরুল জামিন পেয়েছেন তিনি। হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের পরও কেন এই ধরনের হয়রানী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতি? বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন দেশের রাজনীতির ত্রিশ বছরের ইতিহাসে কোন বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিবকে এভাবে আটক কিংবা গ্রেফতারের ঘটনা নজিরবিহীন। তবে কি মির্জা ফখরুলের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে নানা কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। রাজনৈতিক পর্যবেকদের মতে, এ ঘটনার মাধ্যমে মিথ্যা মামলা, হানাহানী কিংবা প্রতিহিংসার বেড়াজাল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।আর মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে সে রেকর্ড নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কেননা হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের পরও তাকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। প্রবীন আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক এ ঘটনাকে দু:খজনক ও নজীর বিহীন হিসেবে অভিহিত করেছেন।বলেছেন এটা আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু আদালতে অভিযোগ করেছেন, অবরোধের সময় ঢাকা মহানগরীতে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটে তার প্রায় সব ঘটনায়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে মির্জা ফখরুলের। তবে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের আইনজীবি ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, মির্জা ফখরুল কোন ভাবেই এসব মামলায় সস্পৃক্ত নন । তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সরকার প্রতিহিংসা থেকে তার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক এসব মামলা দিয়েছে। যদিও দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি আদালতে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে তারা মুক্ত করে আনবেন।
শুধু বিএনপি কিংবা ১৮ দলের নেতারাই নন, মির্জা ফখরুলের প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ, দেশের শিতি,সুশিল সমাজ কিংবা অল্প শিতি সাধারন শ্রেনী পেশার মানুষের কাছে ইতিমধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলামের একটা গ্রহনযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। একজন শিক্ষিত, আদর্শ ও রুচিবান স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবে নিজ দল বিএনপি’র বাইরে প্রতিপক্ষের কাছে তিনি ইতিমধ্যেই সমাদৃত হয়েছেন।। আমি মনে করি আওয়ামী লীগের সিনিয়র রাজনীতিবিদরা তার ঐসব গুনাবলীর ব্যাপারে একমত পোষন করবেন। যদিও রাজনীতির খেলায় তারা মির্জা ফখরুলকে ঘায়েল করতে নানা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে থাকেন।তবে কেন এই ব্যক্তির প্রতি ক্ষমতাসীনদের এমন কঠোর নীতি। কারন হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন ,দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভের পর মির্জা ফখরুল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভাষায় ও সাবলীল কন্ঠে মহাজোট সরকারের দুর্ণীতি দু:শাসন, হত্যা গুম , আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নানা কর্মকান্ডের কঠোর সমালোচনায় সোচ্চারকন্ঠ । আর সেকারনেই মির্জা ফখরুল এখন মতাসীনদের টার্গেট । একের পর এক মামলার খড়গ এখন তার মাথায়। তাই এখন বিএনপি’র নেতা কর্মী সমর্থকসহ সাধারন মানুষের মনে প্রশ্ন দানা বাঁধছে মামলার জট থেকে কবে নাগাদ বেরিয়ে আসতে পারবেন মির্জার ফখরুল। তার মুক্তির দাবিতে বিএনপি সহ আঠারো দল ঢাকা সহ সারা দেশে হরতাল বিক্ষোভ সমাবেশ মিছিল অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। তবে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গ্রেফতার এবং উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভের পরও তাকে মুক্তি না দিয়ে সরকার সাময়িকভাবে রাজনৈতিক চালে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও মির্জা ফখরুল কে গ্রেফতারে ক্ষমতাসীনদের এই কৌশল দেশে গনতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা ও ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে কতটুকু সহায়ক হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। আমার সাথে অনেকই একমত পোষন করতে পারেন কিংবা নাও করতে পারেন যে,বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহা সচিবের গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র সংগঠন গোছানোর কাজ এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনে কিছুটা হলেও ছন্দ পতন ঘটেছে। সেই সাথে দলের কাউন্সিল অনুষ্টানে প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও আঘাত লেগেছে। যদিও বিএনপি পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত ডিসেম্বরে না হলেও চলতি জানুয়ারী মাসে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কাজ জোরালো ভাবে শুরু করেছিলেন মির্জা ফখরুল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মির্জা ফখরুলের এ গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় নিরপে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে জনমত সংগঠিত করতে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১৮ দল যে আন্দোলন করছে তার উত্তাপের থার্মোমিটার নিচের দিকে টেনে ধরেছে সরকারের রাজনৈতিক কৌশল। সাময়িক হলেও এ কৌশলে সরকার সফল হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। আর বিএনপি’র আন্দোলনে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে।সাময়িক ভাবে হলেও ধাক্কা লেগেছে দল ও জোটের রাজনীতিতে । যদিও দলের মুখপাত্র হিসেবে বর্তমানে পরিচিত প্রবীন ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ অনেক সিনিয়র নেতাদের মতে, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের গ্রেফতারের মাধ্যমে দলের নেতা কর্মীদের মনোবল আরো বেড়েছে। যোগ হয়েছে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা। জোরদার হচ্ছে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে জনমত ১৮ দলের পক্ষে আসার সম্ভাবনা।
আবু দারদা যোবায়ের
লেখক : সাংবাদিক
[email protected], [email protected],