সরকার বিরোধী বিক্ষোভ, সমাবেশ দমনে ব্যবহার করা পিপার স্প্রেযুদ্ধে প্রতিপক্ষ দমনেও ব্যবহার নিষিদ্ধ। কেমিক্যাল ওয়েপন কনভেনশনের ১.৫অনুচ্ছেদে এ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ক্ষতিকর এ তরল দেশে দেশে ব্যবহারহলেও তা নিতান্ত হয়ে থাকে জরুরি প্রয়োজনে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ তরলব্যবহার করলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মেডিকেল গবেষণায় পিপারসেপ্র’কে ক্ষতিকর আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে এই তরলের মৃত্যু ঝুঁকির বিষয়টিও ।আন্তর্জাতিক ভাবে পিপার সেপ্র-ওলেওরেসিন ক্যাপসিকাম বা সংক্ষেপে ওসি গ্যাসনামে পরিচিত। ‘পেনাসাইল ক্লোরাইড’ নামক রাসায়নিক পদার্থ থেকেই তৈরি হয় এইপিপার স্প্রে। এটি চোখে লাগলে মুহূর্তের মধ্যেই চোখ দিয়ে পানি ঝরবে, চোখে জ্বালাপোড়া এবং সঙ্গে পুরো শরীরে এর প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত পিপার সেপ্র’র কৌটার গায়ের নির্দেশিকায় দেখা যায় পাগলা কুকুর ও ভয়ঙ্কর জীবজন্তু থেকে আত্মরক্ষার জন্যই এর ব্যবহার হয়।দি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল অপশনঅসেসমেন্ট (এসটিওএ) ১৯৯৮ সালে রাজনৈতিক দমন-পীড়নে যে সব অস্ত্র ব্যবহারহয় তার ওপর পরীক্ষা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে পিপারসেপ্র প্রয়োগে মৃত্যুর ঝুঁকির বিষয় উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় এটি প্রয়োগে মৃত্যুও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ‘লস অ্যানজেলেস টাইমস- এর একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ওই পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯০ সালের পর থেকে৬১টি মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে আমেরিকায়। এসব মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ ছিলপুলিশের পিপার স্প্রে ছিটানো। আমেরিকান সিভিল লিবারটিস ইউনিয়ন(এসিএলইউ)-এর তথ্য মতে ১৯৯৩ সাল থেকে পুলিশ হেফাজতে ক্যার্লিফোনিয়ায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়। যাদের মৃত্যুর আগে পিপার সেপ্র প্রয়োগ করা হয়েছিল।
১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর করা এক সমীক্ষায়ও পিপার সেপ্র’র ক্ষতির দিক উঠে আসে। তাদের গবেষণায় এ তরল গ্যাসের মৃত্যু ঝুঁকির বিষয়টিও তুলে ধরা হয় জোরালো ভাবে। ওই গবেষণায় বলা হয়, পিপার সেপ্র’র ফলে মানুষের দৃষ্টি সমস্যা, স্নায়ু সমস্যা, শ্বাসবন্ধ হওয়া বা হৃদক্রিয়া বিঘ্ন হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। ক্ষতিকর এ গ্যাস ব্যবহারে ক্যান্সারের মতো জীবন ঘাতী রোগের জন্ম হতে পারে বলেও গবেষণায় উঠে আসে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে পিপার সেপ্র ব্যবহার হয় ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার জন্য।এছাড়া, পাগলা কুকুর বা বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ঝাঁঝালো এইতরল ব্যবহার হয়। অনেক দেশে ব্যক্তিগতভাবে এটি ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও সাধারণ একটি কৌটায় কি পরিমাণ তরল থাকবে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়াআছে। অনুমোদিত পরিবেশকের কাছ থেকেই কেবল আত্মরক্ষার এই পণ্য কেনা যায় এসবদেশে। তবে বেশির ভাগ দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জরুরি প্রয়োজনে আত্মরক্ষার জন্য এই পিপার সেপ্র ব্যবহার করে।
জনসমাগম বা মানুষের জটলায় এধরনের সেপ্র ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এ তরলের সংজ্ঞায়ও এটিকে আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইউএস আর্মির সমীক্ষায়ও বলা হয়েছে জনসমাগম বা অনেক লোকের ওপর এক সঙ্গে এই তরল ছোড়া ঝুঁকিপূর্ণ।দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নতুন এই তরল অস্ত্র ব্যবহার শুরুহওয়ায় এখন এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এইতরলকে টিয়ার গ্যাসের নতুন সংস্করণ বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে পিপার সেপ্রএবং টিয়ার সেলের প্রয়োগ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া অভিন্ন বলে কোন গবেষণায়ই জানা যায়নি। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরও দাবিকরেছেন, পিপার সেপ্রতে কারও মৃত্যু হয় না। তিনি এও বলেছেন, অবৈধ বিক্ষোভ দমাতে পিপার সেপ্র প্রয়োগ কনভেনশনে স্বীকৃত।স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই স্প্রে চোখের কর্ণিয়ার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একাধিকবার এই স্প্রে চোখে লাগলে এক পর্যায়ে চোখ অন্ধহয়ে যেতে পারে। এতে চোখের কর্ণিয়ার টিস্যুগুলো নষ্ট করে ফেলে। এই স্প্রেদ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি চোখে ঝাঁপসা দেখতে পারেন। মানবদেহের অন্য অংশেরকোন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা ওষুধের মাধ্যমে তা নিরাময় করা যায়। তবেচোখের কর্ণিয়ার ক্ষতি হলে বেশির ভাগক্ষেত্রেই তা আর আগের অবস্থায় ফিরিয়েআনা যায় না।এমপিওভুক্তির দাবিতে রাজধানীতে কর্মসূচি পালন করার সময়
বেসরকারিশিক্ষকদের ওপর বাংলাদেশে প্রথম পিপার সেপ্র ছোড়া হয়। এই সেপ্রতে অসুস্থহওয়ার পর চিকিৎসাধীন এক শিক্ষক মারা যান। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীঐক্যজোটের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ক্ষতিকারক তরল সেপ্রতে আক্রান্ত হয়েই ওইশিক্ষকের মৃত্যু হয়। তাদের এ দাবির প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীজানিয়েছিলেন, পিপার সেপ্রতে কারও মৃত্যু হয় না। এরপর গত ১৬ই জানুয়ারিজ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা হরতালেরদিনে পুলিশ আবারও পিপার সেপ্র ব্যবহার করে। এদিন বাসদের সাধারণ সম্পাদকসহবেশ কয়েকজন নেতাকর্মী এবং সাংবাদিক এ তরলে আক্রান্ত হন। তাদের কেউ কেউহাসপাতালেও চিকিৎসা নেন।
পুলিশ সাধারণ জনতাকে দমাতে কয়েক দফায় এই পিপার সেপ্র ব্যবহারের পর এর ব্যবহার বন্ধে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া। ওই নোটিশে তিনি বলেন, কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকার বিরোধী বিভিন্ন সমাবেশে, এমনকি পেশাজীবী শিক্ষকদের ওপরও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক পিপার স্প্রে নামে একধরনের অস্ত্র প্রয়োগ করাহচ্ছে। এর ফলে এরই মধ্যে আক্রান্ত মানুষ চোখের কর্ণিয়াসহ বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছেন। নোটিশে বলা হয় একজন নাগরিকের সুস্থভাবে বাঁচার এবংশান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্ট রয়েছে। এনোটিশের কোন জবাব সরকারের তরফে দেয়া না হলেও চাঁদপুরের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পিপার সেপ্র অনুমোদিত একটি অস্ত্র। যা অবৈধ বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা যায়। নৈরাজ্য বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন মাঠে যায় তখন তারা ফুলের মালা নিয়ে যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।