বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর বিশ্ববরেণ্য মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পুরোপুরি মিথ্যা এবং সাজানো। পুরো মামালাটিই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা। আর এর মূল ষড়যন্ত্রকারী হলেন তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। তিনি তদন্ত সংস্থার নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাস আগেই মাওলানা সাঈদীকে গ্রেফতারের আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর বরাবর। তিনি ১৯৭১ সালের পিরোজপুর বা পারেরহাট এলাকায় সংঘটিত কোনো অপরাধের তদন্ত করেননি। তিনি একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তের নামে মিথ্যা কাহিনী রচনা করেছেন। তিনি নিয়োগ পাওয়ার আগেই সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন যা বাস্তবসম্মত নয়। সরকার পক্ষের দ্বিতীয় দফা চূড়ান্ত আর্গুমেন্টের জবাবে গতকাল রোববার যুক্তি উপস্থাপনকালে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী এডভোকেট মিজানুল ইসলাম উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। গতকাল সকাল-বিকেল দুই বেলা আর্গুমেন্ট করেন এডভোকেট মিজানুল ইসলাম। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল এই আর্গুমেন্টে সহযোগিতা করেন এডভোকেট তাজুল ইসলাম, এডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানবীর আহমেদ আল আমিন, মতিউর রহমান আকন্দ, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।
এডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, মামলার সাথে সম্পর্কিত না হওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তা কতিপয় বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এসবের উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববরেণ্য এই মোফাসসিরে কুরআনকে জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করা। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মাওলানা সাঈদী শর্ষিনা মাদরাসা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। অথচ এর পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করেননি। তিনি শর্ষিনা মাদরাসার কোনো সাক্ষী হাজির করেননি। ১ নং সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদারকে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন। কিন্তু তাকে জেরা করলে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় যে, তার বাড়ি থেকে ২৫/৩০ কিলোমিটার দূরে শর্ষিনা মাদরাসায় তিনি কখনোই যাননি। মাওলানা সাঈদী যখন ঐ মাদরাসার ছাত্র ছিলেন তখনকার কোনো শিক্ষক অধ্যক্ষ বা উনার কোনো সহপাঠী, সিনিয়র ছাত্র বা জুনিয়র ছাত্র কারো সাথেই তিনি কথা বলেননি। তাহলে তিনি জানলেন কি করে যে মাওলানা সাঈদীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল? আল্লামা বা মাওলানা শব্দ লেখার কোনো যোগ্যতা সাঈদী সাহেবের নেই বলে উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। আল্লামা লেখতে হলে নাকি একাধিক ডক্টরেট ডিগ্রি থাকতে হবে। আল্লামা ইকবাল মহাকবি। তার কটি পিএইচডি ছিল। কখনো তিনি মাদরাসায়ই যাননি। এই উপমহাদেশের বড় রাজনীতিবিদ কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কোনো মাদরাসার সার্টিফিকেট নেই। মওলানা ভাসানীর কোনো মাদরাসা সার্টিফিকেট নেই। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকেরও কোনো ডক্টরেট ডিগ্রি নেই। এসব উপাধী কিসের ভিত্তিতে এসব মহান ব্যক্তিরা পেয়েছেন। আমি এ জন্যই তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি ‘মুফতী’ হেলাল উদ্দিন। কারণ তিনি নিজেই এসব ফতোয়া দিয়েছেন।
এডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, মাওলানা সাঈদী নাকি তার শ্বশুর ইউনুস মুন্সীর বাড়িতে ঘরজামাই থাকতেন। অথচ প্রকিউশনের ১৩ নং সাক্ষী গৌরাঙ্গ এখানে বলে গেছেন যে আমাদের বাড়ির পাশে সাঈদী সাহেব ভাড়া থাকতেন। এই অসত্য তথ্য দেয়া হয়েছে সাঈদী সাহেবকে জনসম্মুখে হেয় করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী তার সুনাম নষ্ট করার জন্য।
এডভোকেট মিজান বলেন, মাওলানা সাঈদী আরবী, উর্দু ভাল জানতেন বিধায় আর্মিদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং তিনি পাক আর্মিদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ মোসলেম মাওলানা তখন মাদরাসা শিক্ষক ছিলেন। আরবী, উর্দু তারই ভাল জানার কথা। সাঈদী সাহেবের তো শিক্ষাগত যোগ্যতাই নেই। তিনি কি করে আরবী, উর্দু ভাল জানলেন। এই তদন্ত কর্মকর্তার কোন্ বক্তব্য সত্য। আবার সাক্ষীদের কেউ কেউ একইকথা বলেছেন। তারা জেরাতে বলেছেন, তারা নিজেরা আরবী-উর্দু জানেন না, বোঝেন না, যিনি নিজেই বোঝেন না, তিনি কি করে বলেন যে ওমুক ব্যক্তি আরবী, উর্দুতে বাকপটু?
মিজানুল ইসলাম বলেন, এই মামলার পুরোটাই ষড়যন্ত্রমূলক। আর এর মূল ষড়যন্ত্রকারী তদন্ত কর্মকর্তা নিজে। তিনি তার জবানবন্দীর শুরুতেই বলেছেন যে, ৮ জুলাই ২০১০ তারিখে সরকার তাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। আর আমরা ডকুমেন্টে যা পাই তা হলো তিনি ২০/৭/২০১০ তারিখে একটি নালিশী মামলা নথিভুক্ত করেছেন। তিনি নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাস আগে ২৯ মার্চ ২০১০ তারিখে চীফ প্রসিকিউটর বরাবর দরখাস্ত করেছেন সাঈদী সাহেবকে গ্রেফতারের জন্য। ২নং সাক্ষীর জবানবন্দী তিনি গ্রহণ করেছেন নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাস আগে মার্চ মাসে। এটা সাক্ষী নিজেই এখানে এসে বলে গেছেন। ৩১ মার্চ ২০১০ তারিখে তিনি একটি ঘটনাস্থলের ভিডিও করেছেন, যা একানে প্রদর্শন করা হয়েছে। এই তদন্ত কর্মকর্তা পিরোজপুর কোর্টে একটি মামলার সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে ঐ মামলার ১১ জন আসামীর মধ্যে ৭ নম্বরে থাকা মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে শুধু তদন্ত করেছেন। বাকি সাক্ষীদের বিষয়ে তদন্ত করেননি। এতে স্পষ্ট যে, তিনি অপরাধের তদন্ত করেননি। তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক চাপে একটি নীলনকশার অংশ হিসেবে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্তের নামে একটি বানোয়াট কাহিনী রচনা করেছেন।
প্রসিকিউশনের ১২ নম্বর সাক্ষী মাওলানা সাঈদীর প্রতিপক্ষ বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ কে আওয়ালের জবানবন্দী থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, তিনি সকালে বললেন, মে মাসের শেষ দিকে পিরোজপুরে আর্মি আসার পর শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ঐদিন বিরতির পর প্রসিকিউশনের শেখানো মতে তিনি একটি দরখাস্ত দিয়ে বললেন, তিনি এপ্রিলের পরিবর্তে ভুলক্রমে মে বলেছেন। তার এই বক্তব্য প্রথমে যা বলেছিলেন, তা সত্য হলে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১ থেকে ১০ নং চার্জের একটিও থাকে না। পরে তিনি দরখাস্ত দিয়ে যা বললেন, তাতেও মামলা থাকে না। প্রসিকিউশন ২২ মে ১৯৭১-এর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পেপার কাটিং দাখিল করেছেন। ঐ খবরে দেখা যায় খান বাহাদুর সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের নেতৃত্বে পিরোজপুরে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে ১৭ মে তারিখে। রাজাকার বাহিনী তারও পরে গঠিত হয়। আর সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, ৭ মে পারেরহাটে তিনি আর্মিদের স্বাগত জানিয়েছেন। তার আগে শান্তি কমিটি গঠন করেছেন, রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন এবং হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, তাদের দেয়া ডকুমেন্ট অনুসারেই সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা এবং বানোয়াট। তারা ঘোড়ার আগে গাড়িজুড়ে দেয়ার মতো একটি কাহিনী রচনা করেছেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, কমন নলেজ এবং জুডিশিয়াল নোটিশের কথা বলেন প্রসিকিউশন সব সময়। আমার কমন নলেজ হলো পাকিস্তান আর্মি যখনই নতুন কোনো জায়গায় অপারেশনে গিয়েছে, তখনই তারা রাস্তার দু’ধারে গুলী করতে করতে গিয়েছে।
কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার, কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে আওয়ামী লীগ আর কে মুসলিম লীগ এসব তারা বিবেচনা করেনি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, তাদের ডকুমেন্টেই আছে যে, ১৭ মে মাওলানা একেএম ইউসুফের নেতৃত্বে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। তাহলে এটাই সত্য যে, ১৭ মে’র আগে রাজাকার নামক কোন বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না। রাজাকার অর্ডিন্যান্স অনুমোদন হয় ১৯৭১ সালের ২৫ জুন। আর তা কার্যকর হয়েছে ২রা আগস্ট। আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে রাজাকার অর্ডিন্যান্স কার্যকর করা হয়। রাজাকার বাহিনীকে অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ৭ সেপ্টেম্বর। আর সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি এপ্রিলের শেষ দিক থেকেই রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে অপরাধ করেছেন। ৭ মে’র এক মাস আগে শান্তি কমিটি গঠিত হয় পারেরহাটে। এটাও তারা বলেছে। অথচ তাদেরই ডকুমেন্টে আছে যে, কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল ৯ মে তারিখে। তারা একদিকে বলছে, পারেরহাটে আর্মি আসে ৭ মে। আবার বলছে, ৪ মে তারিখে ১৩টি গ্রামে হত্যা, গুলী, লুট ও অগ্নিসংযোগ করেছে আর্মি। আর সাঈদী সাহেব এগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন। যেসব গ্রামের নাম বলা হয়েছে ঐসব গ্রামের কাউকে সাক্ষী করা হয়নি। আবার পারেরহাটের সাক্ষীকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেছেন যে, ৭ মে’র এক সপ্তাহ আগে থেকেই তারা সাঈদী সাহেবকে পারেরহাটে দেখেছেন। তা হলে ৪ মে ঐ ১১ গ্রাম যার আয়তন অন্তত ৫০ বর্গ কিলোমিটার সেখানে গেলেন কিভাবে। তাদের কোন্ তথ্য সঠিক?
মধ্যমাছিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে বধ্যভূমির ছবি দেখানো হয়েছে। আর সেটা হলো সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের বাড়ির পেছনে। কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হত্যাকান্ড ঘটানোর অভিযোগ করা হয়। মেজর জিয়াউদ্দিনকে সাক্ষী হিসেবে নাম দিয়েও তাকে হাজির করেননি তারা সত্য বেরিয়ে পড়ার ভয়ে। আর সরকারি ডকুমেন্ট বলছে, পিরোজপুরে কোন বধ্যভূমি নেই।
আজ সোমবারও ডিফেন্স আর্গুমেন্ট অব্যাহত থাকবে।
সূত্রঃ http://jamaat-e-islami.org