ছোটবেলায় আমাদের ট্রানস্লেশন করতে হতো প্যারাগ্রাফের। গ্রামার বইয়ের সুন্দর সুন্দর অনুচ্ছেদ থাকত। সেগুলো আমরা ইংরেজিতে অনুবাদ করতাম।
একটা গল্প ছিল সব ব্যাকরণ বইয়েই। দিল্লির বাদশা নাসিরউদ্দিন। বাদশা হইয়াও তিনি ফকিরের ন্যায় জীবনযাপন করিতেন। নিজহাতে নিজের ছিন্ন কাপড় সেলাই করিতেন। একদিন তাহার বেগম বলিলেন…।
আরেকটা গল্প ছিল পাখি ধরে রাখার। এক শহরের লোকেরা ঠিক করল, তারা পাখি পুষবে। তখন তারা একটা দেয়ালঘেরা বাগানে পাখি রাখল। দেখা গেল, সব পাখি উড়ে চলে গেছে। তখন শহরের জ্ঞানী ব্যক্তিরা গোলটেবিল বৈঠকে বসলেন। সভা-সেমিনার করলেন। টক শো করলেন। অবশেষে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত দিলেন, আমরা আমাদের দেয়াল যথেষ্ট উঁচু করিনি।
বাংলাদেশে ইউটিউব নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে অনেক দিন হয়ে গেল। যে লোকের বদমায়েশির কারণে ইউটিউব বাংলাদেশে বন্ধ হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে অন্য অজুহাতে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে রেখেছে। আর যে বাজে সিনেমাটা সমস্ত নষ্টের গোড়া, সেই সিনেমাটা ইউটিউব ছাড়াও অন্য অনেক সাইটে ছড়ানো আছে। যদিও কেউ ওই ছবি বাংলাদেশে দেখেও না, কেউ এটার খোঁজও করে না। না করাই ভালো। নোংরা জিনিস ঘাঁটতে নেই। এগুলো ভাগাড়ে নিক্ষেপ করতে হয়।
আর প্রক্সি সাইট দিয়ে চৌকস ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে বসেও ইউটিউব দেখতে পারে।
তাহলে ইউটিউব বন্ধ রাখা হয়েছে কেন?
এই যে ছেলেমেয়েরা বাঁকা পথে গিয়ে ইউটিউব দেখছে, এ জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত তদন্ত কমিটি গঠন করা। সভা-সেমিনার করা। বিদেশ ভ্রমণ করে আসা। তারপর তাঁরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ উপসংহারে আসতে পারেন, আমরা আমাদের বেড়া যথেষ্ট উঁচু করিনি।
ছোটবেলায় পড়া এই গল্পটাও আমার খুব প্রিয়। বাঁদর নদী পার হতে চায়। কুমিরকে বলল, আমাকে পিঠে করে একটু নদী পার করে দাও না। কুমির বলল, খুব ভালো প্রস্তাব। ওঠো পিঠে। বাঁদর কুমিরের পিঠে উঠল। কুমির সাঁতরে মাঝনদীতে গিয়ে বলল, আসলে ব্যাপার হয়েছে কি, আমার বউয়ের খুব শখ বাঁদরের কলিজা খাবে। এই জন্য আমি তোমাকে এনেছি। আমার বউ আসছে। সে এখন তোমার কলিজা খাবে।
বাঁদর বলল, এ আবার এমন কী! কলিজাই তো খাবে, আর তো কিছু নয়। তবে দুঃখের কথা কি জানো, আমি তো আসার আগে আমার কলিজাটা ওই গাছের মগডালে রেখে এসেছি। তুমি আমাকে ওই পাড়ে নামিয়ে দাও, আমি তোমাকে কলিজা এনে দিচ্ছি।
বোকা কুমির বাঁদরকে নদীর পাড়ে নামিয়ে দিল।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাজকারবার দেখলে এই গল্পের কথা মনে পড়ে। এঁরা এঁদের মগজ কোথায় রেখে অফিসে আসেন! মনে হয়, বাসায় ফ্রিজে রেখে আসেন। সে ভালোই, যা ছিনতাই বেড়েছে, কেউ আবার তাঁদের বুদ্ধি ছিনতাই করে নিয়ে যেতে পারে।
যেকোনো যন্ত্র ভালো না খারাপ, তা নির্ভর করছে আপনি কীভাবে ব্যবহার করবেন, তার ওপরে। আপনি মোবাইল ফোন দিয়ে জরুরি যোগাযোগ সেরে নিতে পারেন, আবার ওটা দিয়ে এসএমএস চালাচালি করে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামাও বাধিয়ে দিতে পারেন। ছুরি সম্পর্কে যে কথা বহু আগে থেকে প্রচলিত, ডাক্তার ছুরি দিয়ে অপারেশন করে রোগীকে সারিয়ে তোলেন, ছিনতাইকারী ছুরি দেখিয়ে ছিনতাই করে।
বাংলাদেশে ইউটিউব না থাকায় অনেকের অনেক রকম অসুবিধা হচ্ছে। আউটসোর্সিং করে অনেকে ঘরে বসে বৈদেশিক মুদ্রা আনেন, তাঁরা ভুগছেন। কারণ, কখন কোন সাইটের ওপরে বাংলাদেশের ইন্টারনেট প্রহরীরা হামলা করবেন, তা তো তাঁদের জানা নেই। ইউটিউবে টিউটোরিয়াল আছে অনেকগুলো, যা দিয়ে বাচ্চারা লেখাপড়া করতে পারে। ইউটিউবে ধর্মীয় শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আছে, পবিত্র কোরআন শরিফের তিলাওয়াত আছে, ব্যাখ্যাও আছে। আবার বাজে জিনিস যে নেই, তা বলব না। তবে এসব ব্যাপারে ইউটিউব সবচেয়ে রক্ষণশীল, এটা বলা যায়।
বাংলাদেশে গুগল কাজ করতে শুরু করেছে, আগেই একটা প্রতিবেদনে পাঠকদের আমি অবহিত করেছিলাম। দুই দিন হলো দেখতে পাচ্ছি, গুগল বাংলাদেশ কাজ করতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশ সরকার চাইলে গুগল বিডির সঙ্গে কথা বলতে পারে। কোনো সাইট বন্ধ করতে চাইলে আইন দেখিয়ে গুগলকে নিশ্চয়ই অনুরোধ করতে পারে।
মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটতে হয় না। আর মাথায় উকুন হলে মাথা কাটার তো প্রশ্নই আসে না। বড়জোর চুল কেটে ন্যাড়া হওয়া চলে।
হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ দেশে যখন আপনার নির্দেশ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া কিছুই হয় না, তখন আপনার সমীপে বিনীত আবেদন, ইউটিউব খুলে দিন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করুন। পৃথিবীতে মাত্র দুটি দেশে ইউটিউব বন্ধ—বাংলাদেশ-পাকিস্তান। পাকিস্তানের সঙ্গে হাইফেনবদ্ধ অবস্থায় আমরা বাংলাদেশকে দেখতে চাই না। ইউটিউব খুলে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় যুক্তির কি দরকার আছে!
আমরা কথা দিচ্ছি, ইউটিউব আমরা কেবল ভালো কাজেই ব্যবহার করব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।