অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ‘নিরাপদ’ অবস্থানে থাকলেও ২০১২ সালে সরকারের অনেকঅর্জনই ঢাকা পড়ে গেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির অনিয়ম আর পদ্মা সেতুনিয়ে অনিশ্চয়তার ছায়ায়।সব মিলিয়ে ‘অস্বস্তির’ একটি বছর পারকরার পর বাংলাদেশ সরকার পা দিতে যাচ্ছে নির্বাচনের বছরে। একজনঅর্থনীতিবিদের মতে, ২০১৩ সাল শেষ পর্যন্ত চিহ্নিত হতে পারে দেশের অর্থনীতিরজন্য অনিশ্চয়তার এক বছর হিসেবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১১সাল শেষ করেছিল শেয়ার বাজারে অস্থিরতা, তারল্য সঙ্কট, বিনিয়োগে খরা এবংবিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের অনিশ্চয়তা নিয়ে। ২০১২ সালে গ্যাস উত্তোলন ওবিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও স্বস্তিদায়ক কোনো অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনিজ্বালানি খাত।এরপরও প্রবাসীদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রার ওপর ভর করে এ বছর কেন্দ্রীয় বাংকের রিজার্ভ একের পর এক সুখবর দিয়ে গেছে।এইপ্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পৌঁছেছে প্রায়১৩ শ’ কোটি ডলারে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বহু ধনী দেশের তুলনায় ভালজিডিপি প্রবৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নানাভাবে প্রশংসিত হয়েছেবাংলাদেশের অর্থনীতি।সব মিলিয়ে ২০১২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি‘ভাল’ অবস্থানে ছিল বলেই মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের(বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।ফেলে আসা বছরটির দিকেফিরে তিনি বলেন, বছর শেষে কেবল বিনিয়োগছাড়া অর্থনীতির প্রধান প্রায় সবগুলো সূচকই রয়েছে ‘ইতিবাচক’ অবস্থানে।“আমাদেরঅর্থনীতির সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। গত এক বছরেপ্রতি মাসেই ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। আর এই রেমিটেন্সের উপরভর করে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। রপ্তানি আয়ে ৫শতাংশ প্রবৃদ্ধিও খারাপ না।” জায়েদ বখতের বিচারে, বর্তামনেকৃষি খাতের অবস্থা ‘খুবই ভাল’।
খাদ্যমূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল। এডিপিবাস্তবায়নও আশাব্যাঞ্জক। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ‘পজেটিভ’।
ফলে বিদেশিবিনিয়োগ আকর্ষণেরও পরিবেশ তৈরি হয়েছে।তবে সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ২০১২ সালে আর্থিক খাতের একটি ‘কালো অধ্যায়’ হয়ে থাকবে বলেই মনে করেন এই গবেষক।সরকারের প্রতি তার বার্তা, ২০১২ সাল মোটামুটি ভালো গেলেও ২০১৩ সাল অর্থনীতির জন্য একটি অনিশ্চয়তার বছর হিসাবে দেখা দিতে পারে।“যতোটুকুআভাস পাওয়া যাচ্ছে, ২০১৩ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে। জাতীয়নির্বাচনের কারণে অর্থনীতিতে নানা ধরনের চাপ থাকবে। ভোটের বিষয়টি বিবেচনায়রেখে সরকার জনতুষ্টির জন্য নানমুখি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর ফলে বাজেটে চাপপড়বে। অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে অর্থনীতিতে।”
আর্থিক খাতে ‘কেলেঙ্কারি’ বিদায়ীবছরে নতুন ৯টি ব্যাংককে অনুমোদন দেয়া ছাড়াআর্থিক খাতের সবচেআলোচিত-সমালোচিত ঘটনা ছিল রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট।কেন্দ্রীয়ব্যাংকের অনুসন্ধানে এ বছর বেরিয়ে আসে, সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তারযোগসাজশে হল-মার্ক গ্রুপসহ ৫টি প্রতিষ্ঠান অনিয়মের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬০৬কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে হলমার্ক একাই সরিয়েছে ২ হাজার ছয়শ কোটিটাকা।ব্যাংকিং খাতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই আর্থিককেলেঙ্কারির মূল কারিগর হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদসহ বেশ কয়েকজনকেগ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে দুদক। ২৭ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে১১টি মামলা।প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ ক্ষমতাসীন জোটের অনেকনেতাও এই কেলেঙ্কারি নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। সমালোচনা হয়েছে রাজনৈতিকবিবেচনায় ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ দেয়া নিয়েও।হলমার্ককাণ্ড নিয়েআলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই বছর শেষে সোনালী ব্যাংকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগদিয়েছে সরকার। এছাড়া সোনালী ব্যাংকে আটজন সহ রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক এবংচার বিশেষায়িত ব্যাংকে মোট ৩৪ জন পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন,যাদেরঅধিকাংশইপর্ষদে এসেছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়।
‘ঝুলন্ত’ পদ্মা সেতুআর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির পরও ২০১২ সালে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ‘হাতাশার’ নাম পদ্মা সেতু।২০১১সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন বিশ্ব ব্যাংকসহ চার ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেউৎসবের আমেজে সরকারের অর্থায়ন চুক্তি হয়, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যেদেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো প্রকল্প শেষ পর্যন্ত এতোটা অনিশ্চয়তায় ভোগাবে।এ প্রকল্পের তদারকির কাজ কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনকেপাইয়ে দেয়া নিয়ে একজন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সচিবসহএকাধিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ এনেগত বছরই ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছিল বিশ্বব্যাংক।এ বিষয়ে সরকারের তদন্ত মনঃপুত না হওয়ায় ২০১২ সালের ২৯জুন ঋণ স্থগিতের ঘোষণা আসে। এরপর সরকার কয়েকটি শর্ত মেনে নিলে২০সেপ্টেম্বর পদ্মা প্রকল্পে ফেরার ঘোষণা দেয় বিশ্ব ব্যাংক।শেষপর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন সাত জনেরবিরুদ্ধে মামলা করলেও বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান সন্দেহভাজন হিসাবে যার নাম বলাহচ্ছে, সেই আবুল হোসেনকে রাখা হয়নি আসামির তালিকায়। সেতু বিভাগের সাবেকসচিবকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনো নিশ্চিত হয়নি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন। বিশ্বব্যাংকের ঋণ মিলবে কি না- তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে জানুয়ারি পর্যন্ত।আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মাসেতুর কাজ এগিয়ে নিতে মালয়শিয়ার সঙ্গেও সমঝোতায় যায়। বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গেটানাপড়েনের এক পর্যায়ে নিজস্ব অর্থায়নেই সেতু নির্মাণের ঘোষণা আসে খোদপ্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে।সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়বে। তবে কীভাবে সেইপ্রতিশ্রুতি পূরণ হবে তা জানতে নতুন বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
ডেসটিনির ‘ফাঁদ’ চটকদারমুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ১০ লাখেরও বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ হাজার কোটিটাকার বেশি জমা করার পর তাদের গভীর অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে ডেসটিনি ২০০লিমিটেড।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এইঅর্থের একটি বড় অংশ ডেসটিনির পরিচালকদের পকেটে গেছে। এই অভিযোগে ৩১ জুলাইরাজধানীর কলাবাগান থানায় করা মামলায় কারাগারে গেছেন ডেসটিনির ব্যবস্থাপনাপরিচালক রফিকুল আমিনসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ গ্রেপ্তার হলেও বর্তমানে জামিনে আছেন।ডেসটিনিরএমএলএম ব্যবসা নিয়ে বহু আগে থেকেই সন্দেহ আর অভিযোগ থাকলেও এই প্রথমবারেরমতো আইনের আওতায় এলো প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম। তবে ডেসটিনির মতো কোম্পানিগুলোরহাতে সর্বস্ব তুলে দেয়া লাখ লাখ গ্রাহকের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে- সেফয়সালা এখনো হয়নি।হতাশায় ‘ম্রিয়মাণ’ শেয়ার বাজারআগেরবছরের মতো ২০১২ সালও গলার কাঁটা হয়ে ছিল শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদেরজন্য। লোকসানের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে এ বছর বাজার ছেড়ে চলে গেছেন ৩ লাখ ৪৩হাজার ৬১৮জন।বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমে আসার মধ্যেইপুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ১৪টি কোম্পানি। বছর শুরুর ৬শ’ কোটির গড়লেনদেন মার্চে হাজার কোটিতে উন্নীত হয়ে আবার তা নেমে এসেছে তিনশ কোটিরনিচে। এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা।এইহতাশা কাটিয়ে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে ক্যাপিটাল মার্কেট মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জকমিশন (এসইসি)। এসইসির ক্ষমতা বাড়িয়ে আইন সংশোধনের প্রস্তাবও মন্ত্রিসভারঅনুমোদন পেয়েছে। পাশাপাশি কমিশনার ও চেয়ারম্যানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করারওচেষ্টা থাকছে প্রস্তাবিত আইনে।প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিঅনুযায়ী ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছেইতোমধ্যে। ১৭ ডিসেম্বর থেকে নিজস্ব সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার চালু করেছেএসইসি। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক পরিবর্তনেরও।এসব উদ্যোগ বিনিয়োগকারীদের আবার বাজারে ফেরাতে পারবে কি না- তার উত্তর মিলবে ১ জানুয়ারি শুরু হতে যাওয়া নতুন বছরে।
পোশাক শিল্পে শোকের বছরদেশেররপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে যে খাত থেকে, সেই তৈরি পোকাশ শিল্পেরজন্য ২০১২ সার চিহ্নিত হয়ে থাকবে শোকের বছর হিসাবে। ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ারনিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিমেডে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডেশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার কাজেরপরিবেশ নিয়ে পুরনো অভিযোগগুলোই আবার সামনে নিয়ে এসেছে।তাজরীনেরঘটনায় এখনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে বাংলাদেশ ও তৈরি পোশাকখাত। ওয়ালমার্টের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে সস্তায়পোশাক বানিয়ে নিলেও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাদের‘গাফিলতির’ কথা এসব প্রতিবেদনে উঠে আসছে।যা কিছু জাগিয়ে রেখেছে আশাকিছুহতাশাজনক ঘটনা বাদ দিলে ২০১২ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মন্দ কাটেনিএকেবারে। বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ছিল ইতিবাচক। বছর শেষেএসে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পৌঁছে গেছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারে।বিদায়ীবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সবেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী তৎপরতায় আমদানি ব্যয়কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। ফলে নেতিবাচক অবস্থা থেকে বহুদিন পর চলতি হিসেবেউদ্বৃত্ত অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।নভেম্বর শেষে গড়বার্ষিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশে। ডলারের বিপরীতেশক্তিশালী হতে শুরু করেছে টাকা। ৮০ টাকার নিচে নেমে এসেছে ডলারের বিনিময়হার, এক বছর আগে যা প্রায় ৮৫ টাকা ছিল।চলতি অর্থবছরে ১৪ হাজার১৩০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত বিতরণকরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারিউদ্যোক্তাদের প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। রাজস্ব আয় বেড়েছে ২৫শতাংশ। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতাও কমে এসেছে।
ঘাটতিবাজেটের দেশে বাজেট উদ্বৃত্ত থাকাটা কতোটা স্বস্তির হতে পারে, তাঅর্থমন্ত্রীর নির্ভার হাসিমুখ দেখলেই বোঝা যায়। পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়েদোলাচলের মধ্যেই আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে মেট্রো রেলের জন্য জাপানসরকারের ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণের সম্মতিপত্র বছর শেষে আশা জাগানিয়াখবর বটে।