হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠছে নিষিদ্ধঘোষিত ও কালো তালিকাভুক্ত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর ও হিযবুত তাওহীদ। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর সংগঠন দুটির কর্মীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল, পোস্টারিং, লিফলেট বিতরণ ও প্রচারণা চালাতে দেখা যাচ্ছে। চলছে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও উদ্বুদ্ধকরণ (মোটিভেশন) কর্মসূচিও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, হালিশহর আবাসিক এলাকা, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, পাহাড়তলী গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকা, আন্দরকিল্লাসহ কয়েকটি স্থানে হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের কর্মীরা গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে।
গত ২৩ ডিসেম্বর নগরীর বাকলিয়া থানাধীন দক্ষিণ শহীদ বশরুজ্জামান গোল চত্বর থেকে বই ও লিফলেট বিতরণ করার সময় মজিবুর রহমান (৫০) ও বেলাল খাঁন (২৮) নামের হিযবুত তাওহীদের দুই কর্মীকে আটক করে র্যাব-৭ এর কর্মকর্তারা। এর আগে গত ২৪ নভেম্বর নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন আলমাস সিনেমা হলের সামনে পোস্টার লাগানোর সময় হিযবুত তাওহীদের কর্মী আরিফ মাহমুদ (২৪) নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে আটক করেছিল পুলিশ।এছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেললাইনের দু’পাশের বিভিন্ন স্থাপনায় বিশালাকৃতির পোস্টার ছাড়াও রেল লাইনের দুপাশ, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের নতুনপাড়া এলাকা, চৌধুরীহাট এবং ফতেয়াবাদ রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হিযবুত তাহরীরের কর্মীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত পোস্টার সেঁটে তাদের অপসারণ দাবি করে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছেন। এছাড়া এসব পোস্টারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে নিয়ে বেশ কিছু উস্কানিমূলক উক্তিও রয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ১৬ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১২টি ধর্মভিত্তিক সংগঠনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। সংগঠনগুলো হচ্ছে, জামা’আতুল মুজাহিদীন আল ইসলামী বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), হিজবুত তাওহীদ, উলামা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত, হিযবুত তাহরীর, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি), ইসলামী সমাজ, তৌহিদ ট্রাস্ট, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), শাহাদত-ই-আল হিকমা, তা’আমির উদ-দ্বীন বাংলাদেশ (হিজবে আবু ওমর) এবং আল্লার দল। এর মধ্যে জেএমবি, হুজি, জেএমজেবি, শাহাদত-ই-আল হিকমা ও হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে, বাকি সাতটি সংগঠনকে এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও হিযবুত তাহরীরের মতো সংগঠনের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড ঠেকানো যায়নি।
জানা গেছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো নাম-লেবাস পরিবর্তন করে অথবা অন্য সংগঠনের সঙ্গে মিশে কাজ করছে। জানা যায়, কালো তালিকাভুক্ত ও নিষিদ্ধ ঘোষিত কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে আদর্শগত ব্যাপক মিল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, হিযবুত তাহরীর, হিযবুত তাওহীদ ও জামা’আতুল মুজাহিদীন আল ইসলামী বাংলাদেশ (জেএমবি)। সূত্রের দাবি, আদর্শগত মিল থাকলেও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তারা পৃথকভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাব-৭, চট্টগ্রামের জঙ্গি সেলের সমন্বয়ক এএসপি মো. মফিজুল ইসলাম সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক কার্যক্রম চালালেও আমাদের কাছে সংগঠন দুটির তৎপরতার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তারা একেক সময় একেক স্থানে তাদের কার্যক্রম চালায়। তাও গোপনীয়ভাবে। প্রচারণা চালানোর সময় আমরা তো সাম্প্রতিক সময়ে এসব সংগঠনের কয়েকজন কর্মীকে আটক করেছি। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।
শিবিরের সাথে কানেকশন! :
জামায়াত ইসলামীর সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগ আছে। কালো তালিকাভুক্ত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের সাথে ছাত্রশিবিরের গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। মহানগর ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল একজন নেতাও এ প্রতিবেদকের কাছে বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, তাদের সাংগঠনিক আদর্শের সাথে ছাত্রশিবিরের আদর্শের ব্যাপক মিল রয়েছে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তারা পৃথকভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের সাথে সম্প্রতি শিবিরের কর্মীরা জড়িয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
র্যাব-৭ এর উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘গ্রেফতারকৃত হিযবুত তাওহীদের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আমরা অনেককাংশে ধারণা করছি, জামায়াত-শিবিরের সাথে তাদের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। কেননা সংগঠনটির সাথে তাদের মতাদর্শের ব্যাপক মিল রয়েছে। তবে হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের সাথে শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন দাবি করে নগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি (উত্তর) মো. ইসমাইল হোসেন সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইসলামিক দল হিসেবে তাদের সাথে আমাদের আদর্শ কিংবা চেতনাগত মিল থাকতেই পারে। কিন্তু তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। ছাত্রশিবির গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আমরা গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাস করি। রাজনীতি করার জন্য ছাত্রশিবিরকে কখনোই হিযবুত তাহরীর কিংবা হিযবুত তাওহীদের প্রয়োজন নেই।’
আকস্মিক তৎপরতা:
হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের কর্মীরা রাস্তায় চলন্ত যানবাহনে আকস্মিকভাবে লিফলেট বিতরণ করে সটকে পড়ে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন মসজিদের সামনে এসব সংগঠনের দু’তিন জন কর্মী দাঁড়িয়ে মুসল্লিদের হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। র্যাব-৭ এর উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সংগঠন দুটির কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যারা ধরা পড়ছে তারা তাদের নেতাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারছে না। তারা শুধু তাদের পর্যায়ের বা এক ধাপ ওপরের সদস্যদের কথাই জানাতে পারছে।
বর্তমানে হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওয়েবসাইট-ইন্টারনেটের মাধ্যমে। যে কেউ চাইলেই তাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারছেন। গোয়েন্দা সূত্রমতে, চিহ্নিত আস্তানার পাশাপাশি হিযবুত তাওহীদ ও হিযবুত তাহরীরের কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
ফাঁদে পড়ছে শিক্ষার্থীরা:
বিভিন্ন সূত্র জানায়, বর্তমানে হিযবুত তাহরীর ও হিযবুত তাওহীদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে। তবে এর মধ্যে তাদের প্রথম পছন্দ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা টার্গেট করেছেন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। তাদের ফাঁদে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী এসব জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। অথচ তাদের বাবা-মা জানেন না, ছেলে নিষিদ্ধ সংগঠনে জড়িয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর পিতা বলেন, হিযবুত তাহরীরের সাথে যুক্ত হয়ে তার ছেলে গ্রেফতার হয়। প্রায় বছর খা’নেক জেল খেটে ছাড়া পেয়েছে। এখন ছেলেটা আর আগের মতো সবার সঙ্গে মিশছে না। সব সময়ই রেগে থাকে। ছেলেকে নিয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘দেশে যেভাবে এসিডবিরোধী, মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন হচ্ছে, সেভাবে জঙ্গি বিরোধী প্রচারণা চালানো উচিত।’
জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড না থাকায় সেগুলোই হিযবুত তাওহীদ ও হিযবুত তাহরীরের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নতুন সদস্যভুক্তির হারও বেশি। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সূত্র জানায়, শুধু শিক্ষার্থী নয়, অনেক শিক্ষকও এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের মধ্যেও কেউ কেউ এর সদস্য। তারা নিজ প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোথাও ধর্মানুরাগী কোনো তরুণ দেখতে পেলে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এর পর তাদেরকে সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। দিনের পর দিন লেগে থাকেন ওই যুবকের পেছনে। একপর্যায়ে যুবকটি সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার পর তার ওপর আরও সদস্য বানানোর দায়িত্বও পড়ে। আর এভাবেই বাড়ানো হচ্ছে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা।
হিযবুত তাহ্রীর ও হিযবুত তাওহীদের তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) মো. সফিকুল ইসলাম সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, জঙ্গি তৎপরতা রোধে জনমত সৃষ্টির বিকল্প নেই। কেননা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে সাধারণত উচ্চশিক্ষিত লোকেরাই সম্পৃক্ত থাকে। তবে এসব শিক্ষিত লোকদের অনেকেই জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না। তাই জনমত সৃষ্টি করা ছাড়া জঙ্গি তৎপরতা রোধ সম্ভব নয়। এছাড়া সিএমপিতে আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধ’ নামক একটি সেল চালু হচ্ছে। এই সেল জঙ্গি অপতৎপরতা রোধেও সক্রিয় থাকবে।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩