মোঙ্গলা, খুগু, রবি, সুনিল আরো একজন মিলে মোট পাঁচ ভাই। বড় মোঙ্গলা (মৃত) সুনিল (মৃত) রবি (মৃত) আরো একজন তিনিও (মৃত) বেঁচে আছে শুধু খুগু পুরো নাম তার খগেন রবি দাশ। সবাই তাকে খুগু নামে চিনে। গোপালপুর উপজেলার ভেংগুলা বাজারের পার্শ্বে গুচ্ছ গ্রামে খুগুর বসবাস। তাঁর দুই কন্যা একপুত্র। সবাই বিবাহিত। পুত্রের নাম রিপন। রিপনের একটি ক্ষৌরকার্যাদির গৃহ রয়েছে ভেংগুলা বাজারের ছাগল হাটিতে। বাবা খুগু ও মাকে নিয়ে তাঁর বসবাস।
খুগু ও তার ভাই রবির তখন শৈশব। সদ্য স্বাধীন আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি। হানাদার পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা এ মাটিতে অনেক ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে। বাতাসে নিশ্বাস নেয়া যায় না, বারুদের গন্ধে বাতাস নষ্ট হয়েছে। মানুষের শরীরে তখন দেখা দিয়েছে চর্ম রোগ, খোচ-পাঁচরা ও অন্যান্য। ঔষধ পত্রের অভাব। অন্নের অভাব। বস্ত্র নেই। ক্ষেতে ফসল হয় না। সব কিছু মিলিয়ে মানুষের জীবন হয়েছে অত্যন্ত দুর্বিসহ। সে সময়ে খুগু আর রবি কাজের সন্ধানে গ্রামে আসতেন। দুই ভ্রাতার মোটামোটি স্থায়ী ব্যবসায়ী আস্তানা ছিল ডাকুরীর চৌধুরী বাড়ির বাহির আঙ্গিনা। এখানে বসেই সারাদিন তারা জুতা সেলাই-কালির কাজ করতেন। সারাদিনের অবস্থানে সব সময়ই কাজ থাকতো না। বসে থাকতেন একটু জিরিয়ে নিতেন। পারলে চৌধুরীর পুকুর পাড়ের বেঁঞ্চে গা গড়িয়ে নিতেন। শীতের সময় তাদের শরীরে বস্ত্রের অভাব তীব্র অনুভূত হতো। দু’জনের শরীরে জড়িয়ে থাকতো সামান্য এক চিলতে বসন। জুবু-থুবু শীর্ণকায় দেহে মাঝে মাঝে কাঁপুনি আসতো। মধ্যহ্নে ক্ষুধার তাড়না দিত। আমার সাথে দুই ভাইয়ের সখ্যতা গড়ে উঠে।
তাদের খাদ্যাভাসের কারণে কখনও শুকনো খাবার আবার কখনওবা আমার মমতাময়ী মা জ্যোৎস্না চৌধুরাণী গরম ভাত খাবারের ব্যবস্থা করতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হতো। শ্রদ্ধেয় মরহুম পিতামহ আবদুস ছোবাহান চৌধুরী অত্যন্ত দরদভরা হ্নদয়ে তাদেরকে নানা কিছু জিজ্ঞেস করতেন। জীবন-যাপন সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে কথা হতো। আবার একাগ্রচিত্তে নিজ পেশায় মনোনিবেশ করতেন। শান্ত-নিরব প্রকৃতির দুই ভ্রাতার আগমনে যেমন আনন্দিত হতাম তেমনি চলে যাবার সময় কষ্ট পেতাম। এভাবেই দিন কেটে যায়। আমারও লেখাপড়ার পাঠ মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক তারপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ায়। এরই মাঝে তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক খোঁজ করেও সঠিক সন্ধান পেলাম না। আমাদের এলাকায় তাদের আর আসা-যাওয়া হতো না। কর্ম জীবনে প্রবেশ করেও গ্রামের বাড়ি এলে ওদের কথা জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু না ওদেরকে আর পাচ্ছিলাম না। পরে জেনেছি দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর খুগু টাংগাইলে ছিল।
অবশেষে চার-পাঁচ বছর পূর্বে ভেংগুলা বাজারের শ্রদ্ধেয় এখলাস মেম্বার বা আক্কা কাকার দৌহিত্র পলাশ ডাক্তারের কাছে খুগুদের ইতি কথা তুলে ধরি। বলি, তুমি ওদেরকে চিন কিনা? পলাশ জানায় খুগুর কথা আর তাঁর ভাই মারা গেছে অনেক আগেই। বুধবার হাটের দিন খুগু গুড় হাটির আমতলায় বসে। একদিন গেলাম। তাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ? আমাকে চিনতে পেরেছো? তাকিয়ে রইল! নিরব থেকে ভঙ্গিমায় বুঝালো মাঝা-মাঝি কোন কিছু। আমি বললাম চৌধুরী বাড়ির আলম। ঐ যে অনেক আগে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসতে। হু ঠিক আছে! কিবা আছুইন? বললাম ভালো আছি। শুকরিয়া। তুমি কেমন আছ? মালিক রাখছে এক রকম। দুইজনের চতুস নয়নের দৃষ্টি বিনিময় হলো অনেকক্ষণ। তারপর থেকে আমাদের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হলো।
সবচেয়ে বড় কথা আমি গ্রামের বাড়ি গেলে এখনও তাকে দিয়ে জুতা সেলাই-কালি করিয়ে নেই। একবার কালি করালে প্রায় দুই-তিন মাস তেমনি থাকে। অথচ ঢাকায় জুতো কালি করালে পাঁচ-ছয় দিনে নষ্ট হয়ে যায়। খুগুর পেশার প্রতি এই আন্তরিকতা ও উৎকর্ষতা আমাকে ভীষণ সম্মোহিত করেছে। উপাখ্যান আমার অনেক পরিচিতদেরকে জানিয়েছি। ওকে একবার জিজ্ঞেস করলাম। তুমি কি দিয়ে কালি কর যে তা সহজে নষ্ট হয় না দুই-তিন মাস থাকে? সেই সহজ সরল হাসি আর নিরবতা! আসলে তাঁর পেশার গোপনীয়তা। খুগুর কথা এখনও মাঝে মাঝে স্মরণ করি। তাঁর পুত্র রিপনের সাথে কথা বলে তাঁর বাবার শারীরিক ও সার্বিক অবস্থার খবরাদি নেই। রিপন জানে আমি তাঁর পিতার অত্যন্ত সজ্জন ও শুভাকাঙ্খি। তাই সুযোগ হলে সেও তাঁর পিতাকে আমার সাথে কথা বলার জন্য ফোনটি ধরিয়ে দেয়। খুগুর জাপিত জীবনের সরলতা ও পেশাদাড়িত্বের বিষয়টি আমার স্মৃতিতে অম্লান। খুগু এখন শৈশব পেড়িয়ে যৌবন আর এখন প্রবীণ। ষাটোর্ধ খুগুর জন্য প্রার্থনা পরম করুণাময় খুগু ও তার পরিবারকে যেন সুখে-শান্তিতে রাখেন।
লেখক পরিচিতি :
মোঃ শামছুল আলম চৌধুরী
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
চৌধুরী বাড়ি, ডাকুরী, গোপালপুর, টাঙ্গাইল।