আজ শনিবার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্লোগান নিয়ে ১৯তম জাতীয় সম্মেলন করতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ১১ টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬৩ বছরের এই দলের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। মহাজোটের সব শরিক দলের নেতাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বিকেল ৩টা থেকে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হবে। কাউন্সিল শেষে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
সকালে সম্মেলনস্থলে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তুলবেন দলীয় পতাকা। একই সময়ে দলের সাংগঠনিক জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক নিজ নিজ কমিটির পক্ষ থেকে দলীয় পতাকা উত্তোলন করবেন।
এরপর শেখ হাসিনা কবুতর উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। অতিথিদের আসন গ্রহণের পর তিনটি দেশাত্মবোঁধক ও দলীয় সঙ্গীত পরিবশেন করা হবে। বাংলা ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরসহ ১১টি ভাষায় একটি গান গাওয়া হবে এবং তার সঙ্গে পরিবেশিত হবে নৃত্য। চার ধর্মগ্রন্থ থেকে 'উদ্ধৃতি' পাঠ করার মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে। শোক প্রস্তাব পাঠ করবেন দপ্তর সম্পাদক আব্দুল মান্নান খান। এরপর শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের পর অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহবায়ক ও দলের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বক্তব্য রাখবেন। এরপর বক্তব্য দেবেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। দুপুরে সবার জন্য থাকবে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন।
বিকেলে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কাউন্সিল অধিবেশন শুরুর পর প্রথমে সাত বিভাগের সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করা হবে। এরপর ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের সংশোধন উত্থাপন ও অনুমোদন করা হবে। নির্বাচন কমিশনের নাম প্রস্তাব ও অনুমোদনের পর বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। শেখ হাসিনাসহ নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে আসন গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন আসন গ্রহণ করে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই। সেই সম্মেলনে আব্দুল জলিলের বদলে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে 'সংস্কারপন্থী' হিসাবে পরিচিতি পাওয়া তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দলের সভাপতি-মণ্ডলী থেকে বাদ পড়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। এবারের সম্মেলনে সারাদেশ থেকে যোগ দেবেন ছয় হাজার ৩০০ কাউন্সিলর।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ছয় ধারার 'খ' উপ-ধারায় ২৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন কাউন্সিলর থাকার কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের ৭৩টি সাংগঠনিক জেলা থেকে ছয় হাজার ৩০০ জন কাউন্সিলর সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে জানান আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মৃনাল কান্তি দাস।ডেলিগেট ও কাউন্সিলরসহ প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্মেলন সফল করতে অভ্যর্থনা, প্রচার, গঠনতন্ত্র সংশোধনসহ আওয়ামী লীগের ১০টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সারাদেশ থেকে কাউন্সিলরদের তালিকা ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে এসেছে। ডেলিগেট কার্ড, পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, স্বেচ্ছাসেবকদের পোশাকসহ সম্মেলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ তৈরির কাজও শেষ। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার আদলে তৈরি করা হচ্ছে মঞ্চ।
জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। আমন্ত্রণপত্র, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট বিতরণের কাজও শেষ করেছে কাউন্সিলের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদ। আড়াই হাজার স্বেচ্ছাসেবক ১১০টি দলে ভাগ হয়ে সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করবেন। অতিথিরা গাড়িসহ তিন নেতার মাজার সংলগ্ন গেইট দিয়ে সম্মেলনস্থলে প্রবেশ করবেন। অন্যরা ঢুকবেন টিএসসির সামনের গেইট, কালি মন্দির গেইট, চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের গেইট এবং শিশুপার্ক সংলগ্ন গেইট দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীসহ নির্দিষ্ট কয়েকজন অতিথি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেইট দিয়ে সম্মেলনস্থলে যাবেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাঙ্গালী জাতির গৌরবের ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এদেশের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পুরনো ঢাকার কেএম দাস লেনের বশির সাহেবের রোজগার্ডেন বাসভবনে একটি রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
দলের প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলে শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক। এর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে। এতে সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে দলটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয় এবং নামের অংশ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ করা হয়। এ অধিবেশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বহাল থাকেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে দলের আন্তর্জাতিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়।
ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তখন মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদূর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছর 'আন্ডারগ্রাউন্ড' রাজনীতি করার পর ৬৪ সালে দলটির কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তর্কবাগীশ শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন।
১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এর পরে '৬৮ ও '৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তারা অপরিবর্তিত থাকেন। এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান।
'৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় এএইচএম কামরুজ্জামানকে এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন জিল্লুর রহমান।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবারও স্থগিত করা হয়।
১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় মহিউদ্দিন আহমেদ এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে।
পরবর্তীতে '৭৭ সালে এই কমিটি ভেঙে করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এতে দলের আহ্বায়ক করা হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে।
'৭৮ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক উকিলকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আবদূর রাজ্জাক।
এরপরেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব, উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়া। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
দেশে ফেরার আগেই ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আবদূর রাজ্জাক।
পরে ১৯৮৩ সালে আবদূর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। '৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।
'৯২ ও '৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং জিল্লুর রহমান দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনা এবং আবদুল জলিল দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বর্তমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
আর এই কাউন্সিলের মাধ্যমে তারুণ্যনির্ভর কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। আজ দলের ১৯তম জাতীয় সম্মেলন।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩