ফলোআপ
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন :
টাঙ্গাইলের গোপালপুরে বুধবার ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভাটি ছিল একটা ভিন্নরকম অনুভূতির। বক্তাদের কথায় ঝরে পড়ছিল যেন অগ্নিবারুদ। প্রচন্ড ক্ষোভ আর ঘৃণার সাথে ছিলো যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারসহ বিচারের দাবি।
এ গ্রেফতার আর বিচার চাওয়াটা ছিল একজন কুখ্যাত আলবদর কমান্ডার ও যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে। যিনি একাত্তরে পরাজিত ও আত্মসমর্পন করা ৯৩ হাজার পাকিস্তানী হানাদার সেনাদের সাথে প্রথমে ভারেতের কারাগারে অন্তরীন এবং পরে পাকিস্তান গিয়ে সেদেশের নাগরিকত্ব গ্রহন করেন। সেখানে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক জুড়ে নানা যড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। সেই কুখ্যাত আলবদরের নাম হলো মনিরুজ্জামান কোহিনূর। যিনি এখন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি। বিজিএমের সদস্য।
বক্তারা অভিযোগ করেন, পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়ার পর আলবদর কোহিনূর পাকিস্তানে অবস্থানরত একাত্তরের আরেক ঘাতক ও কুখ্যাত দালাল পিডিবির প্রধান (ময়মনসিংহের) নুরুল আমীন সরকারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। যে নুরুল আমীন বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন, যিনি একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং বঙ্গবন্ধু সরকার যার নাগরিকত্ব বাতিল করেন। যে নূরুল আমীন সরকারের কারণে বায়ান্নে রফিক বরকতরা ঢাকার রাজপথে বাংলা ভাষার দাবিতে রক্ত দিয়েছিলেন।
উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ওই আলোচনা সভায় একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কুখ্যাত আলবদর কমান্ডার কোহিনূরকে গ্রেফতার ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দাবি জানানো হয়। উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ইউএনও বিকাশ বিশ্বাসের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর ও ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য ছোট মনির।
বক্তব্য রাখেন গোপালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুছ ইসলাম তালুকদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গোপালপুর সার্কেল) আমীর খসরু, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সোবহান তুলা, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল হক, মহিলা ভাইসচেয়ারম্যান মরিয়ম আক্তার মুক্তা, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট শামসুল আলম, টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ সদস্য এবং পৌর আওয়ামীলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম, আলমনগর ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মোমেন, প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন প্রমূখ।
বক্তারা অভিযোগ করেন, ৭১ সালের জুন মাসে ঝাওয়াইল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সম্পাদক এবং সুরেন্দ্রবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মসলিম উদ্দীনকে টাঙ্গাইল শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে ধরে নিয়ে যায় আালবদররা। পরে জেলা আলবদর কমান্ডার মনিরজ্জমান কোহিনূরের যোগসাজশে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার পরিবার আর লাশ ফিরে পায়নি। আলবদর কমান্ডার মনিরুজ্জামানের বাড়িও গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের বেডাডাকুরি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের প্রয়াত মুসলিম লীগ নেতা সবুর উদ্দীন মাস্টারের পুত্র।
মনিরুজ্জামান কোহিনূর ৭১ সালে টাঙ্গাইল জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ১১ ডিসেম্বর কাদেরীয়া ও ভারতীয় বাহিনীর আক্রমনে পাকিস্তানী হানাদাররা পশ্চাৎপসরন করে ঢাকায় আশ্রয় নেন। ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ৯৩ হাজার খান সেনা নিয়ে যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। আলবদর কমান্ডার কোহিনূর পাকিস্তানী সেনা হিসাবেই সেখানে আত্মসমর্পন করেন।
এরপর ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি খানসেনাদের সাথেই ভারতের জব্বলপুর কারাগারে বন্দী ছিলেন। পরে শিমলা চুক্তিনুযায়ী ভারতের কারাগার থেকে পরাজিত পাকিস্তানী সেনারা মুক্তি পান। আলবদর কমান্ডার মনির্জ্জুামান কোহিনূর ছাড়া পেয়ে তাদের সাথে পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ও গ্রহন করেন। পাকিস্তানী নাগরিক হিসাবেই তিনি জাপান যান।
২০০২ সালে একটি মহলের যোগসাজশে কৌশলে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব সংগ্রহ করে বাংলাদেশ আসেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশেই অবস্থান করছেন এবং এলাকায় কোটি টাকা দানখয়রাতের রাজত্ব খুলে নিয়েছেন। কোহিনূর তার প্রকৃত নাম হলেও বাংলাদেশে ফেরার পর তিনি মনিরুজ্জামান নাম ধারণ করেন। এ নামেই এখন তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট। তবে এলাকায় এলে দানখয়রাতে তিনি কোহিনূর নাম ঊল্লেখ করেন।
সরকার ২০০০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবি মসলিমউদ্দীনের নামে ২ টাকার একটি স্মারকটিকেট প্রকাশ করেন। কিন্তু শহীদ পরিবার আজো এ নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার পায়নি। অথচ একটি প্রভাবশালী মহলের প্রশ্রয়ে আলবদর কমান্ডার মনিরুজ্জামান কোহিনূর সদম্ভে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বক্তারা তাকে দ্রুত গ্রেফতার এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসির দাবি জানান।
উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার জানান, কোহিনূর খুনি পরিবারের সন্তান। তার বাবা মুসলিমলীগ করতেন। ভাই মহসীন দেশে থাকতে ছাত্র শিবির করতেন। এখন প্রবাসে জামায়াত করেন। আরেক ভাই এনামুল হক ছাত্রদল করতেন। এলাকায় সন্ত্রাসী এবং খুনখারাপীর সাথে জড়িত ছিলেন। পরে নিজ দলের প্রতিপক্ষের হাতে এনামুল খুন হন। আলবদর কোহিনূর মসলিম উদ্দীনের মতো ত্যাগী রাজনীতিবিদ এবং একজন আদর্শ শিক্ষককে একাত্তরে খুন করে পাকিস্তানে নাগরিকত্ব নিয়ে অবস্থান করেন। ঘাতক মনে করেছিল তার কুকীর্তির কথা এলাকাবাসি ভুলে গেছে। এখন কোহিনূরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হবে।
সংসদ সদস্য ছোট মনির বলেন, এ কুখ্যাত ঘাতকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী আইনে মামলা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোহিনূরকে দিয়েই শুরু হবে গোপালপুরের আলবদর ও রাজাকারদের আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া।